কেমন ছিলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রম ও শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা

ইমরান হোসাইন,কুবি: করোনা ভাইরাসের কারণে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ ছিলো দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলাে। এই দীর্ঘ বন্ধের ফলে যখন সারা দেশে শিক্ষা-কার্যক্রম স্থবির, ঠিক তখনই উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও অনলাইনে শ্রেনী পাঠদান শুরু করেছিলো। দীর্ঘ সময় ধরে চলে এই অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রম। ক্লাস, এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশনের পাশাপাশি অনেক গুলো বিশ্ববিদ্যালয় সেমিস্টার ফাইনাল পরিক্ষাও নিয়েছে অনলাইনের মাধ্যমে। সম্প্রতি করোনা প্রভাব কমে আসায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সশরীরে ক্লাস এবং পরিক্ষা নেওয়া শুরু করেছে। কেমন ছিলো দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সেই অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে –

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক বলেন, দেশে দেশে যখন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো তখন শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল অনলাইন ক্লাস। প্রথম দিকে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিগত জটিলতার কারনে অনলাইন ক্লাস নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু পরবর্তীকালে সেশনজট এড়াতে ও শিক্ষা কার্যক্রম বহাল রাখতে অনলাইন ক্লাস শুরু করা জরুরী হয়ে পড়েছিলো। এরপর দীর্ঘ বিরতির পর আমরা অনলাইন ক্লাস শুরু করি। এতে আমাদের সেশনজটের আশংকা কিছুটা হলেও কাটে। যদিও অনলাইন ক্লাসে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাছাড়া অনলাইন ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারটি সাধারন হলেও অনলাইন পরিক্ষার বিষয়টি আমাদের জন্য ছিলো চ্যালেঞ্জিং। তবে শুরুতে অপরিকল্পনীয় হলেও শিক্ষকদের সহযোগিতায় অনলাইন পরীক্ষাটি দেওয়াও সম্ভবপর হয়ে উঠেছিলো। সবমিলিয়ে অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রম করোনা মহামারীর সমসাময়িক সময়ের জন্য উপযোগী ছিলো।

সাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাব্বির রহমান বলেন, অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রম ব্যাপারটা একটু তেতো হলেও ইন্টারেস্টিংও ছিলো বটে আমাদের জন্য। এর আগে এরকম অনলাইন পাঠদানের অভিজ্ঞতা ছিলো না। কোন ভাবে নেটওয়ার্ক সমস্যা কাটিয়ে ক্লাস গুলো অনলাইনে শেষ করলাম তখনই পরীক্ষার নোটিশ আসলো। নোটিশ টা পড়ে বুক টা কিঞ্চিৎ কেপে উঠলো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম পরীক্ষা তাও আবার অনলাইনে, কোন কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। যাই হোক, পরীক্ষার নিয়মাবলি দেওয়া দিলো। পরীক্ষা হবে রিটেন আর ভাইবার মাধ্যমে। রিটেন অংশ টা হবে ওপেন বুক সিস্টেম। লিখে উত্তরপত্র ই-মেইল এ সাবমিট করতে বলা হলো আর পরের দিন এই কোর্স এর উপর ভাইবা। সময়মত পরীক্ষা শুরু হলো, লিখার অংশ টা নিয়ে না ভাবলেও ভাইবা টা অনেক ভাবিয়েছে। প্রথমত জীবনের প্রথম ভাইবা তার উপর অনলাইন ভাইবা। ভাইবার আগে সিনিয়র ভাই আপুদের দারস্থ হই, জেনে নিলাম কি ধরনের প্রশ্ন করতে পারে। দিকনির্দেশনার পাশাপাশি সাথে সাহস ও দিয়েছে। কোনভাবে দুই টা সেমিস্টার অনলাইনে শেষ করলাম। সেশনজট হতে কিছুটা রক্ষা পেলাম। যদিও পরিক্ষা দিতে গিয়ে নেটওয়ার্ক, ডিভাইস সহ বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়েছে। সব মিলিয়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও করেনার সাময়িকি সময়ের জন্য যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত ছিলো।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, সারাক্ষণ ইন্টারনেট আর স্মার্ট ফোনে ডুবে থাকা। এসব ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যে পড়াশােনা করাটা যেমন সুষ্ঠু হয়না তেমনি মন মেজাজও ঠিক রাখা যায় না। ফোনে দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে অনেক সময় চোখের সমস্যা, ঘুম চলে আসা, নেটওয়ার্ক অসুবিধা, বিদ্যুৎ বিভ্রান্ত, ডাটা কিংবা ওয়াইফাইয়ের ভােগান্তিসহ নানা জটিলতায় পড়তে হয়। পরীক্ষায় নির্ধারণকৃত সময়ে উত্তরপত্র জমা দেয়ার ক্ষেত্রে ভােগান্তি সবচেয়ে বেশি হয়। স্বল্প সময়ে অধিক প্রশ্ন সমাধান করার অসুবিধাও কম নয়। তবে, সবমিলিয়ে সেশনজট থেকে মুক্তি পাওয়ার সুবিধা আর এত ঝামেলার মধ্যেও দিন শেষে কিছু না কিছু শিখতেমপারার ক্ষেত্রে অনলাইন অনেক বড় প্ল্যাটফর্ম হতে পেরেছে বলে মনে করি। এটা শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির সঙ্গে যতটা দূরদর্শী করতে পারছে ততটা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সহজ ও দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিতে

গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজনীন নওশী বলেন, করোনা ভাইরাসের প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি পড়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আগে থেকেই নড়বড়ে ছিলো। এখন করোনাতে সেটা যেন ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ক্লাসরুমে বসে স্যারদের লেকচারের প্রতি যে মনোযোগ আসতো, তা এখন অনলাইন ক্লাসরুম ও পরীক্ষার জন্য ফোন বা পিসি স্ক্রিনে আসেনা। তাছাড়া আমাদের দেশ আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে ঠিকই কিন্তু এখনো অন্যান্য দেশের মতো প্রযুক্তিগত দিক থেকে এতোটা উন্নত হতে পারেনি। যার ফলে অনলাইনে ক্লাস,পরিক্ষা এবং এসাইনমেন্ট জমা দিতে গিয়ে পড়তে হয়েছে বিভিন্ন সমস্যায় । ভিডিও চালু রাখা থেকে শুর করে নেটওয়ার্ক সমস্যা, ওয়াইফাই সমস্যা, সময়মতো বিদ্যুৎ না থাকা সবকিছুই যেন ছিলো নাজেহাল অবস্থা। তাই আমি বলবো আমাদের দেশে অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রমের পুরোপুরি সুফল পেতে হলে প্রযুক্তিগত দিক থেকে আরো উন্নতি করতে হবে।

সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সুমাইয়া জাহান তৃপ্তি বলেন, প্রথম যখন অনলাইনে ক্লাসের কথা শোনলাম অনেকটাই ভ্যাবাচেবা খেয়ে গেলাম। কারণ এর আগে কখনো আমরা অনলাই ক্লাস কিংবা পরিক্ষা কোনটাই দেয়নি এটা ছিলো সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। আগে কেবল বইপুস্তকে পড়াশোনা করে স্বশরীরে ক্যাম্পাসে পরীক্ষা দিতাম। কিন্তু লকভাউনে নিজেরাই মােটামুটি সবকিছু ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছি। অনলাইন পরীক্ষা অন্যান্য দেশে সচরাচর হলেও আমাদের দেশে তা এখনাে ততটা আপডেট হয়নি। তার মধ্যে একটা কারণ নেটওয়ার্কিং সমস্যা। কখন যে কোন দিকে নেটওয়ার্ক ধরে আর যায় তা বলা দুষ্কর। ওয়াইফাই এখনাে সব জায়গায় তার গণ্ডি ছড়াতে পারেনি। যেখানে ওয়াইফাইয়ের রাজত্ব সেখানে চলে বিদ্যুতের খবরদারি। মােটামুটি অনলাইন জগতে আসতে হলে সবকিছুরই উন্নয়ন জরুরি। কিন্তু এই সময়ে অনলাইনে পরীক্ষাটা সময়ােপযােগী সিদ্ধান্ত।

তবে আরাে আগে যদি পরীক্ষা হতাে তাহলে শিক্ষার্থীরা বেশি উপকৃত হতাে।

সরকারি আনন্দমোহন করলেজের শিক্ষার্থী মাসুদ রানা বলেন, অনলাইনে শিক্ষা-কার্যক্রম আমাদের জন্য ছিলো সম্পূর্ণ একটি নতুন অভিজ্ঞতা। প্রথমদিকে যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার কথা বলা হয় আমরা শিক্ষার্থীরা কিছুটা আতংকে ছিলাম। কারণ বাংলাদেশের ইন্টারনেট সুবিধা তেমন উন্নত নয় তাছাড়া আমাদের অনেকেরই বাড়ি গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে ইন্টারনেট সুবিধা নেই বললেই চলে। পরবর্তীতে সবকিছু উপেক্ষা করে ক্লাস শুরু হয়। প্রথম দিকে অসুবিধা হলেও আস্তে আস্তে মানিয়ে নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দের সহযোগিতায় অনলাইনে ক্লাস করা আরো সহজ হয়েছিলো। সবমিলিয়ে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা কিছুটা হলেও লাভবান হয়েছি।

আরও পড়ুন...