নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু ব্যক্তি ভ্রমণভিসায় বাংলাদেশে এসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এরপর তাদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে মূল্যবান পার্সেল পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেন। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তারা বাংলাদেশে অবস্থান করে অর্থ হাতিয়ে নিতেন। এ পর্যন্ত তারা দুই কোটিও বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাদের দেশে পাচার করেছেন। বাংলাদেশে এসে তারা দামি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। কিন্তু তাদের কাগজপত্র বেশিরভাগ সময় বাসার মালিকদের কাছে দিতেন না। এসব অভিযোগে সাত বিদেশি নাগরিকসহ সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের নয় সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (১১ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ১১টা থেকে বুধবার সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত র্যাব-৪ এর একটি দল র্যাব-৮ এর সহযোগিতায় অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে রাজধানীর পল্লবী থানা, রুপনগর থানা ও দক্ষিণখান থানা এলাকা থেকে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতাররা হলেন- নাইজেরিয়ার নাগরিক উজেকি ওবিননারুবেন (৪২), দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাতমবিখনা গেবুজা (৩৬), নাইজেরিয়ার ইফুনানিয়া ভিভিয়ান নাওকি (৩১), সানডে সেদারেক ইজিম (৩২), চিনেদু মোসাস নাজি (৩৬), কলিমস ইফেসিনাসি তালিকি (৩০) ও সিদিম্মা ইবেলি ইলোফর (২৬)। এছাড়াও তাদের সহযোগী দুই বাংলাদেশি হলেন- ফেনীর নাহিদুল ইসলাম (৩০) ও নরসিংদীর সোনিয়া আক্তার (৩৩)।
র্যাবের অভিযানে তাদের কাছ থেকে ৮টি পাসেপোর্ট, ৩১টি মোবাইল সেট, ৩টি ল্যাপটপ, একটি চেক বই, তিনটি পেনড্রাইভ ও নগদ ৯৫ হাজার ৮১৫ টাকা জব্দ করা হয়।
বুধবার (১২ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক।
তিনি বলেন, গ্রেফতাররা সংঘবদ্ধভাবে দীর্ঘদিন ধরে অভিনব কায়দায় বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যোগাযোগ করতেন। তারা মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ফেসবুকসহ নানা মাধ্যম ব্যবহার করে নিজেদেরকে পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতেন। পরবর্তীতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও প্রেমের সম্পর্ক তৈরির পর এক পর্যায়ে দামি উপহার বাংলাদেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার জাল ছড়ানো হয়। এক পর্যায়ে বাংলাদেশের কাস্টমস অফিসার পরিচয়ে তাদেরই এক নারী সহযোগী ভিকটিমকে ফোন করে বলেন তার নামে একটি পার্সেল বিমানবন্দরে এসেছে। পার্সেলটি ডেলিভারি করতে কাস্টমস চার্জ হিসেবে মোটা অংকের টাকা মোবাইল ব্যাংকিং অথবা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বারে পরিশোধ করতে বলা হয়।
অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, যেহেতু পার্সেলে অতি মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী রয়েছে তাই কাস্টমস চার্জ একটু বেশি হয়েছে বলে তাদেরকে বলা হয়। প্রতারিত ব্যক্তি সরাসরি টাকা প্রদান করতে বা দেখা করতে চাইলে প্রতারকরা এসএমএসের মাধ্যমে জানায়, এই মুহূর্তে তারা বিদেশে অবস্থান করছেন কিংবা জরুরি কোনো মিটিংয়ে আছেন। বাংলাদেশি সহজ-সরল মানুষ তাদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট মোবাইল ব্যাংকিং অথবা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে প্রতারিত হয়ে আসছিলেন। প্রতারিত ব্যক্তি অর্থ পরিশোধ করার পর তার নামে প্রেরিত পার্সেলটি সংগ্রহ করার জন্য বিমানবন্দরে সংশ্লিষ্ট অফিসে গিয়ে দেখেন, তার নামে কোনো পার্সেল আসে নাই। তখন তিনি ওই বিদেশি বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে আর পাওয়া যায় না। তখন বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
প্রতারণার কৌশল হিসেবে টার্গেট নির্ধারণ: গ্রেফতার আসামিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেয়েদের নামে ভুয়া আইডি খুলে বিভিন্ন প্রোফাইল ঘেটে বড় বড় ব্যাবসয়ী, হাই প্রোফাইল চাকরিজীবীসহ উচ্চবিত্ত ব্যক্তিদেরকে টার্গেট করতেন।
বন্ধুত্ব স্থাপন: ভিকটিম নির্ধারণ করার পর তাদেরকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ভিকটিমদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতেন। ভিকটিমদের কাছে নিজেকে পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর ঊধ্র্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন। ভিকটিমকে বিভিন্ন সময়ে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার ভুয়া ছবি পাঠাতেন বিশ্বাস স্থাপনের জন্য। সম্পর্কের এক পর্যায়ে বিভিন্নভাবে ভিকটিমকে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে প্রলুব্ধ করতেন।
নিজের অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ: বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পর প্রতারকরা জানান, তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে কিন্তু তারা তা খরচ কিংবা দেশে নিতে পারছেন না। প্রতারকরা সেই ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা ভিকটিমের কাছে পাঠাতে চান এবং বলেন তাদের কাছে রেখে দিতে, পরবর্তীতে যেকোনো সময় নিয়ে নেবেন। চাকরিজীবীদের বলেন তাদের দিয়ে জনসেবামূলক কাজে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবেন এবং এতে তারা একটি নির্দষ্ট হারে কমিশন পাবেন। আর যারা ব্যবসায়ী তাদেরকে বলা হতো, তার ব্যবসায় অর্থলগ্নি করবেন ও তিনি ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কমিশন পাবেন। যাতে করে সহজ সরল মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে তাদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে প্রভাবিত হন।
উপহার প্রদান: ভিকটিমকে আকৃষ্ট করতে প্রতারক চক্রটি বিভিন্ন উপহার পাঠানোর প্রলোভন দেখায় ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিকটিমের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার নাম, ঠিকানা নিয়ে ছোট ছোট উপহার পাঠায়। এতে করে উপহার পেয়ে ভিকটিম বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং এক পর্যায়ে প্রতারক চক্রের সদস্যরা বলেন দামি পার্সেল পাঠিয়ে দিয়েছি।
অর্থ সংগ্রহ: পার্সেল পাঠানোর কিছুদিন পর তাদের বাংলাদেশি নারী সহযোগী বিমানবন্দর কাস্টমস অফিসার পরিচয়ে ভিকটিমকে ফোন করে বলেন, তার নামে একটি পার্সেল বিমানবন্দরে এসেছে। পার্সেলটি ডেলিভারি করতে কাস্টমস্ চার্জ হিসেবে মোটা অংকের টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়। যেহেতু পার্সেলে অতি মূল্যবান এবং এভাবে বিদেশ থেকে কোনো পার্সেল দেশে আনা আইনসিদ্ধ নয় তাই চার্জ কিছুটা বেশি দিতে হবে। এজন্য নকল টিন সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজ বানাতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। কেউ কেউ টাকা না দিতে চাইলে তাদেরকে মামলার ভয়াভীতি দেখাতো হতো। এক পর্যায়ে সহজ সরল ভুক্তভোগীরা তাদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে মামলার ভয়ে সংশ্লিষ্ট মোবাইল ব্যাংকিং অথবা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেন। এভাবে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়ে আসছিল।
র্যাব-৪ এর অধিনায়ক আরও বলেন, আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের এসব বিদেশি নাগরিকেরা ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে রাজধানীর পল্লবী, রুপনগর ও দক্ষিণখান এলাকায় ভাড়া বাসায় অবস্থান করে গার্মেন্টস ব্যাবসা শুরু করেন। গার্মেন্টস ব্যাবসার আড়ালে তারা বাংলাদেশি সহযোগীদের নিয়ে এমন অভিনব প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাদের অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ ও গ্রেফতার দুজনের নামে আগেও মামলা রয়েছে। গ্রেফতার সোনিয়া আক্তার ও নাহিদুল ইসলাম এই আন্তর্জাতিক চক্রের দেশীয় সহযোগী। মূলত তাদের মাধ্যমেই এই প্রতারক চক্রের বিদেশি নাগরিকরা ভিকটিম সংগ্রহ, বন্ধুত্ব স্থাপন, কাস্টমস্ অফিসার পরিচয় এবং শেষে অর্থ সংগ্রহ করে আসছিল।
গ্রেফতার নাইজেরিয়ার নাগরিক উদিজি ওবিননা রুবেন ২০১৭ সালে ভ্রমণভিসায় বাংলাদেশে আসেন। ২০২০ সালে তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা হওয়ায় তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। তিনি নিজেকে একজন গার্মেন্টস ব্যাবসায়ী বলে পরিচয় দেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতারণাই তার মূল পেশা। তিনি এই আন্তর্জাতিক প্রভারক চক্রের মূলহোতা।
গ্রেফতার দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক নতোমবিখনা গেবুজা ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি ভ্রমণভিসায় বাংলাদেশে আসেন। তার ভিসার মেয়াদ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।
গ্রেফতার নাইজেরিয়ান ইফুনানিয়া ভিভিয়ান ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ভ্রমণভিসায় বাংলাদেশে আসেন। ২০২১ সালের জুলাইতে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়। গ্রেফতার নাইজেরিয়ার নাগরিক সানডে ইজিম ২০১৯ সালের ২২ মে ভ্রমণভিসায় বাংলাদেশে আসেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়।
গ্রেফতার নাইজেরিয়ার আরেক নাগরিক চিনেদু মোসেস নানজি ২০১৯ সালের এপ্রিলে ভ্রমণভিসায় বাংলাদেশে আসেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়। নাইজেরিয়ার নাগরিক কলিমস ইফেসিনাসি তালিকি ২০১৯ সালের জুনে ভ্রমণভিসায় বাংলাদেশে আসেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়। তিনি নিজেকে ফুটবলার হিসেবে পরিচয় দেন।
গ্রেফতার নাইজেরিয়ার নাগরিক সিদিম্মা ইবেলি ইলোফোর ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভ্রমণভিসায় বাংলাদেশে আসেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়।
গ্রেফতার প্রত্যেক আসামিই নিজেকে একজন গার্মেন্টস ব্যাবসায়ীসহ বিভিন্ন পরিচয় ব্যবহার করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতারণাই তাদের মূল পেশা।
গ্রেফতার নাহিদুল ২০০৮ সালে ঢাকার একটি স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০১০ সালে একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে রেস্টুরেন্ট ও একটি কল সেন্টারে কাজ করেন। ২০১৭ সালে ফ্যাশন ডিজাইন বিষয়ে ডিপ্লোমা করে ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া যান ও ২০২১ সালে দেশে ফিরে আসেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি গ্রেফতার সোনিয়া আক্তারের স্বামী।
গ্রেফতারকৃত সোনিয়া ২০০৬ সালে ঢাকার একটি স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০০৮ সালে একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত একটি অ্যাম্বাসিতে চাকরি করেন তিনি।
২০০৯ সালে প্রথম বিয়ে হয় সোনিয়ার। তার স্বামী নেশাগ্রস্ত হওয়ায় ২০১৭ সালে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। ২০১৮ সালের শেষের দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাইজেরিয়ার নাগরিক উদেজি রুবেনের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয়ের মাধ্যমেই তিনি এ প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। প্রতারণার কাজে সহযোগিতার জন্য ভিকটিম প্রতি প্রতারণার ২৫ শুতাংশ অর্থ সোনিয়া আক্তারকে প্রদান করতেন রুবেন। সোনিয়া আক্তারের নিজের নামে দক্ষিণখানে একটি চারতলা বাড়ি ও একটি প্রাইভেটকার রয়েছে।
সোনিয়া ও নাহিদুল নাইজেরিয়ার নাগরিক রুবেনের সঙ্গে উত্তরার জসিমউদ্দীন এলাকায় মাসে একাধিকবার দেখা করতেন। গত এক বছরে ৩০ থেকে ৩৫ জন ভিকটিমকে প্রতারিত করে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে তারা স্বীকার করেছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব-৪ এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, তারা এ পর্যন্ত প্রায় দুই কোটি টাকার বেশি প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছেন। এই টাকা তারা হুন্ডির মাধ্যমে তাদের দেশে নিয়ে গেছেন।