বাবা-মা যদি শিরক কিংবা প্রকাশ্য পাপাচারে লিপ্ত থাকে, সেক্ষেত্রে সন্তানের জন্য তাদের আনুগত্য কিংবা তাদের কথা শোনা কি ওয়াজিব? এসব কারণে কি তাদের সঙ্গে সম্পর্কে ছিন্ন করা যাবে? সন্তানের জন্য বাবা-মার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা কিংবা ছিন্ন করার বিধানই বা কী?
বাবা-মা যদি কাফের হয় কিংবা নামে মুসলিম হয়; ইসলামি শরিয়তের কোনো বিধানেরই তোয়াক্কা না করেন। ছেলে-মেয়ে পরিপূর্ণভাবে ইসলামকে ফলো করলে আঁড় চোখে দেখেন, নিষেধ করেন কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন; তবে সেক্ষেত্রে করণীয় কী?
আবার অনেক বাবা-মা এমন আছেন যারা কবর পূজা, মাজারে সেজদা দেওয়া কিংবা (ভণ্ড) বাবার পায়ে সেজদা করেন; এ কাজে সন্তানকে আনুগত্য করার নির্দেশ দেন; তবে সন্তান কি এ সব কাজে আনুগত্য করবে? নাকি বাবা-মার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে?
এখানে দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়-
১. বাবা-মার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা বা সম্পর্ক ছিন্ন করা।
২. তাদের ভুল ও গুনাহের নির্দেশ পালন করা।
বাবা এবং মা কাফের-অবিশ্বাসী, গুনাহগার বা পাপাচার যা-ই হোক না কেন কখনো সুসম্পর্ক নষ্ট বা ছিন্ন করা যাবে না। সন্তানের জন্য বাবা-মার সঙ্গে সুসম্পর্ক নষ্ট করা বা ছিন্ন করা বৈধ নয়। তবে তাদের কথায় বা নির্দেশে ইসলামি শরিয়তের বিরোধী কোনো কাজ করা যাবে না। কোনো কাজে আমল করা যাবে না। তাদের গুনাহের কাজের অনুসরণ ও অনুকরণ করা যাবে না।
ইসলামি শরিয়তের বিপরীতে তাদের অনুসরণ এবং অনুকরণ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি তাদের কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তাদের সঙ্গে ভালো ও উত্তম আচরণ করতে হবে। তাদের সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করতে হবে।
বাবা-মা অন্যায় কাজে জড়িত থাকলেও তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। তাদের সঙ্গে নরম ও কোমল আচরণ অব্যাহত রাখতে হবে। দুটি বিষয়ই খুব সতর্কতার সঙ্গে ম্যানেজ করতে হবে।
বিষয় দুটি সম্পর্কে কোরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমের একাধিক আয়াতে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন-
১. وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا ۖ وَإِن جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا ۚ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ
‘আর আমি মানুষকে তার মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছি; তবে ওরা যদি তোমাকে আমার সঙ্গে এমন কিছুকে অংশদার সাব্যস্ত করতে বাধ্য করে, যার সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের কথা মান্য করো না। আমারই কাছে তোমাদের প্রত্যাবর্তন; এরপর তোমরা যা কিছু করেছ, আমি তা তোমাদেরকে জানিয়ে দেব। (সুরা আনকাবুত : আয়াত ৮)
২. وَإِن جَاهَدَاكَ عَلَىٰ أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا ۖ وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا ۖ وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ۚ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ
‘বাবা-মা যদি তোমাকে আমার সঙ্গে এমন বিষয়কে শরিক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে সহাবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। এরপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে জ্ঞাত করবো।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৫)
৩. হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ فِيمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ مَا لَمْ يُؤْمَرْ بِمَعْصِيَةٍ، فَإِنْ أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلاَ سَمْعَ عَلَيْهِ وَلاَ طَاعَةَ
‘সব মুসলমানেরই নেতার কথা শোনা এবং আনুগত্য করা অবশ্য কর্তব্য। তা হোক তার পছন্দের বা অপছন্দের; তাকে যে পর্যন্ত গুনাহের কাজের নির্দেশ না দেওয়া হবে। যদি তাকে গুনাহের কাজের নির্দেশ দেওয়া হয় তাহলে তা না শুনা এবং না মানাই তার কর্তব্য।’ (তিরমিজি)
৪. হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ
‘আল্লাহর অবাধ্যতায় কোনো মাখলুকের আনুগত্য করা জায়েজ নেই।’ (মুসনাদে আহমাদ)
৫. হজরত মুসআব ইবনে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তার বাবা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর সম্পর্কে কোরআনের কিছু আয়াত অবতীর্ণ হলো। তিনি বলেন-
حَلَفَتْ أُمُّ سَعْدٍ أَنْ لَا تُكَلِّمَهُ أَبَدًا حَتَّى يَكْفُرَ بِدِينِهِ، وَلَا تَأْكُلَ وَلَا تَشْرَبَ، قَالَتْ: زَعَمْتَ أَنَّ اللهَ وَصَّاكَ بِوَالِدَيْكَ، وَأَنَا أُمُّكَ، وَأَنَا آمُرُكَ بِهَذَا. قَالَ: مَكَثَتْ ثَلَاثًا حَتَّى غُشِيَ عَلَيْهَا مِنَ الْجَهْدِ، فَقَامَ ابْنٌ لَهَا يُقَالُ لَهُ عُمَارَةُ، فَسَقَاهَا، فَجَعَلَتْ تَدْعُو عَلَى سَعْدٍ، فَأَنْزَلَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ فِي الْقُرْآنِ هَذِهِ الْآيَةَ: {وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي}
‘তাঁর মা শপথ করে ফেলেছে যে, যতক্ষণ তিনি ইসলামকে অস্বীকার না করবেন ততক্ষণ তার সঙ্গে কথা বলবেন না; খাবেন না এবং পানও করবেন না। সে বললো, আল্লাহ তাআলা তোমাকে আদেশ করেছেন, মা-বাবার কথা মানতে। আর আমি তোমার মা। আমি তোমাকে এ আদেশ করছি। মা তিনদিন পর্যন্ত কিছু খেলেন না। কষ্টে সে বেহুশ হয়ে গেলে উমারাহ নামক তার এক ছেলে তাকে পানি পান করালো। মা সাদের উপর বদ-দোয়া করতে লাগলো। তখন আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে এ আয়াত নাজিল করলেন-
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي
আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যব্যাবহার করতে। তবে ওরা যদি তোমার উপর বল প্রয়োগ করে, আমার সঙ্গে এমন কিছু শরিক করতে; যার সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই। তুমি তাদের আনুগত্য করো না।’ (সুরা আনকাবুত : আয়াত ৮) ‘আর পৃথিবীতে তাদের সাথে বসবাস করবে সদ্ভাবে’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৫)।’ (মুসলিম)
সর্বোপরি কথা হলো-
বাবা-মার সঙ্গে সব সময় উত্তম আচরণ করতে হবে। ইসলামের নির্দেশনা এমনই। তবে তাদের নির্দেশে ইসলামি শরিয়তের বিরোধী কোনো কথা কিংবা কাজকে সমর্থন করা যাবে না কিংবা মানা যাবে না। অবিশ্বাসী হলেও তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। যেমনটি করেছিলেন হজরত আসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহা। হাদিসে এসেছে-
হজরত আসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে আমার আম্মা মুশরিক অবস্থায় আমার কাছে এলেন। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ফতওয়া চেয়ে বললাম-
وَهِيَ رَاغِبَةٌ، أَفَأَصِلُ أُمِّي؟ قَالَ: ্রنَعَمْ صِلِي أُمَّكِ
‘তিনি আমার প্রতি খুবই আকৃষ্ট, এমতাবস্থায় আমি কি তার সঙ্গে সদাচরণ করব? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে সদাচরণ কর।’ (বুখারি)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, কোরআন-সুন্নাহর উপর যথাযথ আমল করা। বাবা-মা মুশরিক কিংবা ইসলাম বিদ্বেষী হলেও তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। তাদের সঙ্গে নরম ও কোমল কথা বলা। তাদের জন্য হেদায়েতের দোয়া করা। পক্ষান্তরে তাদের ইসলাম বিরোধী কাজের নির্দেশ কোনোভাবেই মানা যাবে না।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন-সুন্নাহর উপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। ইসলামের সৌন্দর্য সবার সামনে তুলে ধরার তাওফিক দান করুন। আমিন।