রাষ্ট্র তার গায়ে রক্তের দাগ লেগে থাকতে দেবে না

কামরুন নাহার, সাথি: উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ট্র্যাজিক কাহিনী ম্যাকবেথে রাজা ডানকানকে হত্যার পর ট্র্যাজিক নায়ক ম্যাকবেথের হাতের রক্তের দাগ ধুয়ে দিতে পারেনি কোন জায়গার পানি। এই রক্তের তাড়নায় প্রেমিক বলেন, আর স্ত্রী বলেন, জীবন চলার সহযোদ্ধা বলেন, যে নামেই অভিহিত করেন না কেন, তার(লেডি ম্যাকবেথের) মৃত্যুর সময়ও ম্যাকবেথ এক মিনিট সময় দিতে পারেন নি, বরং বিরক্ত হয়েছেন। ম্যাকবেথ হারিয়ে ফেলেছিল মনের জোর। যার সাহস, শক্তি আর বুদ্ধিমত্তায় একের পর এক রাজ্য জয়লাভ করছিল রাজা ডানকানের সেনাবাহিনী। যার উপর খুশি হয়ে রাজা তার কাঁধের উপর ফুল(পদমর্যাদা) লাগিয়েছিলেন, এমনি কি তার বাড়িতে এক রাতের জন্য অতিথিও হয়েছেন তিনি। যার (লেডি ম্যাকবেথ) উৎসাহে এই অভিভাবকের মত জনপ্রিয় রাজা ডানকানকে হত্যা করল সেই ম্যাকবেথ, তাতে কি ম্যাকবেথ লাভবান হয়েছিলেন?

নিউটনের তৃতীয় সূত্র: প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। বিজ্ঞান বলছে, সকল শক্তি অবিনশ্বর। শুধুমাত্র অবস্থার পরিবর্তন হয়।

কেরানীগঞ্জের হযরতপুর ইউনিয়নের মধুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে দুর্বৃত্তের গুলিতে শাহিদুল ইসলাম শুভ (১১) নামের এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, চার জেলায় ছয়জন নিহত হয়েছে বৃহস্পতিবার। আহত শতাধিক।

যদিও প্রমাণের কাজ বিচারালয়, পুলিশ-চিকিৎসকের। তবুও কিছুক্ষণের জন্য গণমাধ্যমের কথায় সত্য ধরে নিলাম, রানা মোল্লার নেতৃত্বে ২০ থেকে ৩০ জন অস্ত্রধারী কেন্দ্রে হামলা চালায়। রানা আওয়ামী লীগের প্রার্থী আয়নালের ক্যাডার বলেও স্থানীয়রা দাবি করছেন। এ হামলায় ঢালিকান্দি গ্রামের আলাল মোল্লার ছেলে শিশু শাহিদুল ইসলাম নিহত হয়।

শিশু শাহিদুলের বাবাকে প্রতিপক্ষ ধরেই কথা বলছি, (আমার জানা নেই শাহিদুলের অভিভাবকরা কোন পক্ষকে সমর্থন করেন কি না) শাহিদুল নামে এই শিশুটি যে মারা গেল, তাতে কি পুরো নির্বাচনের বিজয় এনে দিলে তার বাবা-মা(স্বজনদের) যে অন্তর্দহন ও যে ক্ষতি হল, এর পরিমাণ করে তা শোধের বিষয়টি অনুমান করতে পারেন বা ক্ষতির সাথে তুলনা করলে তা কি এ্যাটোমিক পরিমাণ হবে বলে কি মনে হয়? যদি হবে বলে মনে হয়, তবে আপনার ছেলেটিকে শাহিদুলের জায়গায় বসিয়ে কল্পনা করুন। আশা করছি, বিবেক থাকলে কিছুটা উত্তর পেয়ে যাবেন।

পরাজিত দলের হয়ে কল্পনা করুন, আপনার শাহিদুল যদি বেঁচে থাকতো আর আপনি পরাজিত প্রার্থী বা পরাজিত দলের সমর্থক হতেন, তাহলে কি শাহিদুল হারানোর যন্ত্রণার চেয়ে কম কষ্ট পেতেন না? আরেকটি কথা ভাবেন, একদিকে পরাজিত, অন্যদিকে ছেলেকে হারান। এরপর যে কষ্ট, তা অনুমেয় কী?

নিজেকে বিজয়ী দলের একজন ভাবেন, সমর্থিত প্রার্থীকে জয়ী করার জন্য নিজের ছেলেকে হারান। ভাবুন, ভাবুন, কতটা লাভবান আপনি? কিছুটা উত্তর পেয়েছেন আশা করছি। এবার ভাবুন, দলের হয়ে একজনকে মারলেন(হয়ত অজ্ঞাতভাবেই); কিন্তু কেন মারলেন? নিজেকে খুনি বলুন, দেখুন কেমন লাগে। বিনিময়ে প্রাণের নেতার কাছে আরেকটি পরিচয় হল আপনার, আর তা খুনি। কেমন লাগে ভাবুন? আপনি কি মনে করছেন খুন করার পর নেতা আপনাকে বাঁচাবেন? ভুল ভাবছেন আপনি। এই নেতা তার শক্তি পাকাপোক্ত করার জন্য আপনাকে নিয়ে যা করার তাই করবেন।

বিশ্বজিত হত্যাকারীরা কেউ নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে মারেনি। বিশ্বজিতের সাথে কারো কোন বিরোধ ছিল না। এতে অপরাধী প্রমাণিতরা একজনও রক্ষা পায়নি। বাঁচায়নি কোনো নেতা। ১৯৭১ সালে অপরাধ করে কামারুজ্জামান, নিজামী, মুজাহিদ কেউ রক্ষা পায়নি।

পৃথিবীর মাটি এতোটাই পবিত্র যে, কোনো অপরাধী তার অপরাধ ঢেকে রাখতে পারে না। অপরাধীকে অপরাধী প্রমাণিত করার কাজ রাষ্ট্রের, রাষ্ট্র তার গায়ে এক বিন্দু পরিমাণ রক্তের দাগ লেগে থাকতে দেবে না। এটা আপনি বিশ্বাস করুন বা নাই করুন সেটা আপনার ব্যাপার।

মহাকাল আবহমান। এই মহাকাল অপরাধীকে নিয়ে চলতে চাই না, চলবে না।

আশা করছি, সচেতন সমাজের মানুষ বেশি কিছু না হলেও খুনি হতে চাইবেন না। ভালো থাকুন।

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী

আরও পড়ুন...