সান্ধ্য আইনের বেড়াজালে রাবির আবাসিক ছাত্রীরা

মনির হোসেন মাহিন,রাবি: সান্ধ্য আইনের বেড়াজালে পড়ে দীর্ঘদিন থেকে ভোগান্তি আর বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ছয়টি হলের আবাসিক ছাত্রীরা। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ছাত্রীরা আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। সর্বশেষ গত বছরের ৫ নভেম্বর সান্ধ্য আইন বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তাপসী রাবেয়া হলের ছাত্রীরা। আন্দোলনের মুখে সাময়িকভাবে দাবি মেনে নিলেও শেষ অবধি কথা রাখেনি প্রশাসন উল্টো তাদের ঘাড়েই সওয়ার হয়েছে আইনটি।

বিতর্কিত এই সান্ধ্য আইন অনুযায়ী, শীতকালে মেয়েদের হল গেট সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে এবং গ্রীষ্মকালে ৭টা ৩০ মিনিটে বন্ধ হয়ে যায়। আবার সকাল ৬টার আগে কেউ অনুমতি ব্যতিত হলের বাইরে যেতে পারেনা।

এই সান্ধ্য আইনের র্কাযকারিতা কী? নিরাপত্তাই কি প্রধান বিষয়? প্রশাসন কি আদৌ একজন মেয়ে শিক্ষার্থীর সারাদিনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে?-এমন সব প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন আবাসিক হলগুলোর ছাত্রী শিক্ষার্থীরা।

হলের ছাত্রীরা বলছেন, ছেলেদের হলগুলোতে তো এসব হয়না, তাহলে আমাদের ক্ষেত্রে শুধু এমন নিয়ম কেন পালন করতে হবে?এখানে সান্ধ্য আইন করে লিঙ্গ বৈষম্য করা হয়েছে। সান্ধ্য আইনের নামে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর একধরনের বৈষম্যমূলক বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। যেটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের জন্য মোটেও কাম্য নয়। তারা আরো বিশ্ববিদ্যালয় একটি মুক্তবুদ্ধি চর্চার জায়গা, এখানে ছেলে-মেয়ে অবাধ বিচরণ করবে এবং ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সবক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাবে এইটি স্বাভাবিক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রোকেয়া ও রহমতুন্নেছা হলের কয়েকজন আবাসিক ছাত্রী জানান, টিউশনিসহ বিভিন্ন কাজে তাদের প্রায়ই হলে ফিরতে রাত হয়ে যায়। এজন্য তাদের হল গেটে জবাবদিহি করে খাতায় নাম স্বাক্ষর দিয়ে রুমে যেতে হয়। পরবর্তীতে এই ছাত্রীদের অভিভাবকের কাছে তা অভিযোগ আকারে পাঠানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অন্যান্য পাবলকি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে যেখানে রাত আটটার পরেও একজন ছাত্রী হল থেকে বের হওয়ার স্বাধীনতা পাচ্ছেন সখোনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে মেয়েদেরকে হলে প্রবশে করতে বাধ্য করা হচ্ছে।

ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি শাকিলা খাতুন বলেন, আমরা শুরু থেকেই সান্ধ্য আইন বাতিলের জন্য কাজ করে আসছি। যার কারনে আমরা বিভিন্ন সময় সান্ধ্য আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। সান্ধ্য আইন নিয়ে তারা যেটি করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তারা এটা করতে পারেন না। এটা আমাদের জন্য অসম্মানজনক। শিক্ষক হিসেবে তারা যে মন্তব্য করেছেন এটার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত।

তিনি বলেন, এখানে সান্ধ্য আইন করে লিঙ্গ বৈষম্য করা হয়েছে। ছেলেদের হলে কোন আইন নেই। কিন্তু মেয়েদের হলে আইন। এটা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মোটেও কাম্য নয়।এতে করে ছাত্রীদের মানসিক অবস্থা আরও চাপের সম্মুখীন হবে। যদি রাত সাড়ে ৮টার পরে এতই সমস্যা তাহলে প্রশাসন আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুক। এটা তাদের দায়িত্ব। এটা না করে কর্তৃপক্ষ একটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক জেলখানার কয়েদিদের মতো নিয়ম জারি করেছে যা মেনে নেয়া অসম্ভব। আশা করি কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হল ছাত্রলীগের সভাপতি তাজরীন মেধা বলেন, সা সকাল নয়টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত ক্লাস/ল্যাব করার পরেও একজন ছাত্রী না বরং প্রতিটা শিক্ষার্থীরই বিভিন্ন ধরণের কাজ থাকে।কেউ টিউশন করায়,কেউ পার্ট টাইম জব করে,কেউ বিভিন্ন ক্লাব/প্রোগ্রামের কাজ করে,তাছাড়া লাইব্রেরী তে অনেকে পড়ালেখা করে।এগুলোর বাহিরেও ব্যক্তিগত কাজ তো থাকেই। অনেকে বলবেন পড়তে এসেছ,ক্লাস করে হলে যাবে।কিন্তু একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর কি নিজ ক্যাম্পাসে সময় কাটানোর মত কোনো অধিকার নেই? ক্লাস-পরীক্ষা ছাড়াও একজন মানুষের বাকি অনেক কাজ থাকে আর রিফ্রেশমেন্ট তো অবশ্যই দরকার। যেহেতু একাডেমিক ক্লাসের টাইম অনেক বেশি,সেখানে একজন শিক্ষার্থীর হলে ঢোকার সময় দেড় ঘন্টা এগিয়ে দিলে সব দিক থেকেই সমস্যা সৃষ্টি হবে বলে আমি মনে করি।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড.মো.সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় একটি মুক্ত চর্চার জায়গা। এখানে ছেলে-মেয়ে অবাধ বিচরণ করবে, ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সবক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের নিরাপত্তা ও তাদেরকে সুরক্ষিত রাখার জন্য হল প্রাধ্যক্ষের মাধ্যমে ছাত্রীদের সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার আগে হলে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি করা মানে আমাদের এই মুক্ত বিশ্বে কাউকে শৃঙ্খলিত করা নয়। একজন সন্তানকে সবকিছু থেকে নিরাপদে রাখতে পারা আমাদের সকল অভিভাবকের প্রথম দায়িত্ব। আমাদের বাবা-মায়েরা যেমন আমাদের নিয়ে ভাবেন তেমনি আমরাও শিক্ষার্থীদের কল্যাণ ভেবেই এটা করেছি বা প্রস্তাব করা হয়েছে। বাবা-মায়েরা সন্তানকে শুধুমাত্র বিপদ থেকে রক্ষার জন্যই সন্ধায় বাসায় ফিরতে বলেনা, এটা এই কারণেও বলে যেন তারা পড়াশোনা করতে পারে।

উপ-উপাচার্য বলেন,এটা শুধুমাত্র বিপদের আশঙ্কা থেকে নয় একজন বাবা-মার মত আমরাও শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে এগুলি বলার চেষ্টা করেছি। যদি পড়ার টেবিলে সময়মতো ফিরতে পারে তবে পড়াশোনায় অধিক সময় দেওয়ার সুযোগ তৈরী হবে। তবে এটি মানে এই নয় যে জরুরী কোনো প্রয়োজনে তাকে বঞ্চিত করে রাখা হবে।

অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম আরো বলেন, যদি এটি শিক্ষার্থীদের কল্যাণের চিন্তা থেকেই করা হয় তবে শুধু ছাত্রীদের জন্য কেন এই আইন? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন- নিঃসন্দেহে এই যুক্তিকে আমি অস্বীকার করি না। কিন্তকিন্তু আমরা বাবা-মার মত করেই ভাবার চেষ্টা করি। বাবা মায়েরাও কিন্তু ভাবছেন। বাবা-মা আসলে সন্তানদের মঙ্গলার্থেই ভাবেন। তবে এ নিয়ে আগামী ২০ মে সকলের অংশগহণ ও মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহিত হবে।

ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে পিবিএ’র সাথে থাকুন:

 

আরও পড়ুন...