পিলখানা ট্র্যাজেডির ১০ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। দেশের ইতিহাসে বর্বরতম এ হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে বিচারিক আদালতের পর দ্বিতীয় ধাপে হাইকোর্টেও রায় হয়েছে। তবে তা ১৫ মাস আগের কথা। এতদিনেও রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি না পাওয়ায় আটকে আছে আরও একটি ধাপ। এখন শুধু অপেক্ষা পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি প্রকাশিত হওয়ার। এর পর পরবর্তী কার্যক্রম হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ আপিল বিভাগে চূড়ান্ত আপিল করবে। এটি নিষ্পত্তি হলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির মঞ্চে নিতে সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে রিভিউ ও রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়ও সুরাহা হতে হবে। রাষ্ট্রপক্ষের প্রত্যাশা- জঘন্যতম এ হত্যাকাণ্ডে হাইকোর্টের দেওয়া রায় সর্বোচ্চ আদালতে বহাল থাকবে। এ ছাড়া বিস্ম্ফোরক আইনে করা আরেকটি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।
পিলখানা হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতে যাদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল, তাদের মধ্যে বিদ্রোহের অন্যতম পরিকল্পনাকারী ডিএডি তৌহিদসহ ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্ট রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ে ১৮৫ আসামিকে যাবজ্জীবন, ১৯৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা এবং খালাস দেওয়া হয় ৪৯ জনকে। বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ এ রায় দেন। তবে ১৫ মাসেও রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশ না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ আপিল করতে পারছে না।
২০০৯ সালের বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ে করা হত্যা মামলায় ৮৫০ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিচারিক আদালতে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। এদিকে, বিস্ম্ফোরক আইনে করা অপর মামলা গত ১০ বছরেও শেষ হয়নি। এক হাজার ৩৪৫ জন সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত ৭৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ৪ মার্চ সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী তারিখ ধার্য রয়েছে। সর্বশেষ গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণ হয় ঢাকার বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সিনিয়র বিচারক ইমরুল কায়েসের আদালতে। এ মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ বলেন, হত্যা মামলায় মোট ২৭৮ আসামির খালাস হয়েছে। তারা বিস্ম্ফোরক মামলারও আসামি। এই মামলার বিচার কাজ শেষ হলে ২৭৮ আসামি বের হয়ে যাবেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষ চাইছে, আসামিরা যেন বের হতে না পারেন। হয়তো এ কারণেই মামলার বিচারকাজে বিলম্ব করা হচ্ছে।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, হত্যা ও বিস্ম্ফোরক মামলার বিচার কাজ একসঙ্গে চলছিল। হত্যা মামলা শেষ হওয়ার পর আসামিদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এর পর মামলার কাজ কিছুদিন বিলম্ব হলেও এখন যথারীতি চলছে। আসামিপক্ষও সহযোগিতা করছে। চলতি বছরেই বিস্ম্ফোরক মামলার বিচার কাজ শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বিডিআর জওয়ানদের ওই রক্তাক্ত বিদ্রোহের পর ৫৭টি বিদ্রোহের মামলার বিচার হয় বাহিনীর নিজস্ব আদালতে। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর পুরান ঢাকার বকশীবাজার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালত রায়ে বিডিআরের সাবেক ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপির সাবেক এমপি নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু (প্রয়াত), স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন। তবে হাইকোর্টে কয়েকজনের সাজা কমানো হয়। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১৫২ আসামির মধ্যে ১৪ জন পলাতক। এর মধ্যে বন্দি অবস্থায় তোরাব আলীসহ দুই আসামি মারা গেছেন।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষ আশা করছে, আগামী মাসে হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশিত হবে। সে ক্ষেত্রে রায়ের কপি পেতে আসামিপক্ষকে আরও অপেক্ষা করতে হবে। আদালত সূত্রে জানা গেছে, হাইকোর্টের দেওয়া ১১ হাজার ৪১২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রস্তুত। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি শওকত হোসেন রায়টি পড়ছেন। এর পর অপর দুই বিচারপতি জাফর আহমেদ ও বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার স্বাক্ষর করবেন।
জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আশা করি, তাড়াতাড়ি পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাওয়া যাবে। যেহেতু এটা অনেক বড় রায়, তাই লিখতে সময় লাগছে। তিনি বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পেলে খালাসপ্রাপ্তদের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সারোয়ার কাজলের প্রত্যাশা, আগামী মার্চ মাসের মধ্যে হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়া যেতে পারে। এ মামলার পলাতক ছাড়া করাগারে থাকা ফাঁসি ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা আপিল করার সুযোগ পাবে বলে জানান তিনি।
এ মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছিল। একটি হত্যা ও অপরটি বিস্ম্ফোরক মামলা। হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতে গত ৫ বছর আগে নিষ্পত্তি হলেও বিস্ম্ফোরক মামলাটি এখনও বিচারাধীন। তিনি বলেন, প্রত্যাশা ছিল হাইকোর্টের রায়ের কপি দ্রুত পাওয়া যাবে। তা না পাওয়ায় চূড়ান্ত আপিল করা যাচ্ছে না। ফলে আসামিদের কারাগারে থাকতে হচ্ছে। এ ছাড়া ১৩৯ জনের ফাঁসি বহাল আছে। তারা ছয় বছর ধরে কনডেম সেলে আছে। তাদের আপিল দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে- এটাই আইনের বিধান।
ফিরে দেখা পিলখানা হত্যাকাণ্ড :২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানা ট্র্যাজেডিতে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ম্ফোরক আইনে দুটি মামলা দায়ের করেন তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক নবজ্যোতি খিসা। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর হয়। ২০১০ সালের ১২ জুলাই পিলখানা হত্যা মামলায় ৮২৪ জনকে আসামি করে চার্জশিট দেয় সিআইডি। পরে সম্পূরক চার্জশিটে আরও ২৬ জনকে আসামি করা হয়। পিলখানা হত্যা মামলার ২৩৩তম কার্যদিবসে মামলায় ১২৮৫ জনের মধ্যে ৬৫৪ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন। ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ওই বছরের ২২ আগস্ট অভিযোগ গঠন করা হয়।
পিলখানা বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ের করা সব বিদ্রোহ মামলার বিচার শেষ হয়েছে। ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর সদর রাইফেলস ব্যাটালিয়নের ৭২৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিদ্রোহ মামলার বিচার শেষ হয়। বিদ্রোহের ঘটনায় ১১টি বিশেষ আদালতে ৬ হাজার ৪৬ জওয়ানকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এদের মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে ৫ হাজার ৯২৬ জনের। খালাস পান ১১৫ জন। পিলখানা বিদ্রোহের পর বিডিআরের নাম, লোগো, পতাকাও পরিবর্তন করা হয়।
কর্মসূচি : পিলখানা ট্র্যাজেডিতে নিহতদের স্মরণে আজ সোমবার বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক নিহতদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। মঙ্গলবার বিকেলে বাদ আসর পিলখানার কেন্দ্রীয় মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল উপস্থিত থাকবেন।