শিশু ঝরে পড়া কমবে, পুষ্টিহীনতা দূর হবে

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে ‘মিড ডে মিল’ চালু করা জরুরি

মোঃ এমদাদ উল্যাহ, চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা): ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এজন্য বর্তমান প্রজন্মকে গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। সুস্থ্য দেহ ও সুস্থ্য মনের সমন্বয়ে স্বাস্থ্যবান ও শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব। ‘দুপুরের খাবার স্কুলে খাব, রোগমুক্ত জীবন গড়বো’-এ স্লোগানে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে ২০২৩ সালের মধ্যেই দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল বা দুপুরের খাবার সরবরাহ করার চিন্তা করছে সরকার। এরই মধ্যে বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাইলট ভিত্তিতে মিড ডে মিল চালু করেছিল সরকার। এর উদ্দেশ্য হলো; বিদ্যালয়ে ভর্তিকরণ, শিশুদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখা, তাদের উপস্থিতি বাড়িয়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন করে তোলা এবং একই সঙ্গে তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো। তবে খিচুড়ি প্রকল্প বাতিল হওয়ায় আবারও মিড ডে মিল চালু প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন শিক্ষাবীদরা।

জানা গেছে, শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সূতিকাঘার হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। পড়াশোনার পাশাপাশি শিশুর মন ও দেহের সুষ্ঠু বিকাশের দিকে খেয়াল রাখাও বিদ্যালয়ের দায়িত্ব। এ লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে মিড ডে মিল চালুকরণসহ শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক বিকাশের দিকে লক্ষ রাখা উচিত। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় মিড-ডে মিল বলতে বোঝায় দুপুরের খাবার নিশ্চিত করা। এটি মূলত প্রযোজ্য তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য, যারা দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিদ্যালয়ে অবস্থান করে। দুপুর ১টা ৩০ মিনিট থেকে ২টা পর্যন্ত মধ্যাহ্ন বিরতিতে তারা এ খাবার গ্রহণ করবে।
বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করে দেখা গেছে, দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিদ্যালয়ে থাকা ৩য়-৫ম শ্রেনীর ছাত্র-ছাত্রীরা দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকার কারণে পড়াশোনায় মন দিতে পারে না। এতে করে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। আবার যেসব ছেলে-মেয়েরা মধ্যাহ্ন বিরতিতে বাড়ি যায়, তারা প্রায়শই আর বিদ্যালয়ে ফিরে আসে না। অনুপস্থিতির হার বৃদ্ধি এবং ঝরে পরার এটাও একটা উল্লেখযোগ্য কারন।

চৌদ্দগ্রাম পৌর এলাকার সোনাকাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মজিবুর রহমান বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে মিড-ডে মিল চালু করা প্রয়োজন। এতে করে শিক্ষার্থীদের পুষ্টিহীনতা কেটে যাবে এবং উপস্থিতির হার বাড়বে। মিড ডে মিলে ভাত, শাক কিংবা ডাল, ডিম এগুলোই যথেষ্ট। অথবা সবজি খিচুড়ি দেওয়া যেতে পারে। খাবার গ্রহণের পর শিক্ষার্থীরা লোখাপড়ায় মনযোগী হয়ে উঠবে। ফলে বিদ্যালয় হতে পালানোর প্রবণতা কমবে এবং স্কুলে ছাত্র ছাত্রীদের উপস্থিতির হার বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষকরা বর্তমানে মিড-ডে মিল এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে। প্রত্যেক অভিভাবক অবশ্যই তার সন্তানদের খাদ্যের বিষয় সচেতন এবং সতর্ক হতে হবে। ভবিষ্যতে এটি প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সমাজপতিরা দানের তাৎক্ষণিক প্রতিদান চায়। ছোটদের জন্য খরচ করলে তাৎক্ষণিক প্রতিদান পাওয়া যায় না বলেই মিড ডে মিলে সমাজপতিদের সম্পৃক্ত করা যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে মঙ্গলবার কথা হয় মিয়াবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ফেরদৌস আরা বেগমের সঙ্গে। তিনি ২০১০ সালের ১৪ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এসেসম্যান্ট প্রশিক্ষণে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কেরলা রাজ্যে যান। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনায় বলেন, কেরলায় স্কুল থেকে রান্না করা মিড ডে মিল হিসেবে ভাত ও ডাল দেয়া হয়। সেখানে উপস্থিতির হার ৯৯%। অভিভাবকদের চাওয়া, ছেলে-মেয়েরা আমাদের চেয়ে আরও উন্নত হোক, আরও ভালো কিছু শিখুক। স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যবৃন্দ নিজ উদ্যোগে অথবা এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সহায়তায় মিড ডে মিল চালু রেখেছে। এছাড়া তামিলনাড়ুতে মধ্যবিত্ত ও ধনী পরিবারের শিক্ষার্থীরা বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার নিয়ে স্কুলে আসে। পরে স্কুল কর্তৃপক্ষ খাবারগুলো একত্র করে দুপুর বেলায় বিরতির সময় সব শিক্ষার্থীর মাঝে সমানভাগে বিলি করে দেয়।

তিনি বলেন, সেখানে প্রতিদিন সকালে আশ-পাশের দোকানে ১৮ বছরের নিচে কোন ছেলে-মেয়েকে দেখা যায় না। বিকেলে অভিভাবকদের মোটর সাইকেলের পিছনে করে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে দেখা যায় ছেলে-মেয়েদের।

ফেরদৌস আরা বেগম আরও বলেন, অভিভাবক সমাবেশের মাধ্যমে অভিভাবকদের বোঝাতে হবে তার সন্তানটি যদি দুপুরে বাড়িতে অবস্থান করত, তবে সে নিশ্চয়ই দুপুরে খাবার খেত। এ খাবারটি যদি তাকে টিফিন বক্সে দিয়ে দেয়া হয়, তবে স্কুলের বিরতিতে সে খেতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যবৃন্দ নিজ উদ্যোগে অথবা এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সহায়তায় মিড ডে মিল চালু করা যায়। ভাত, সবজি, ডাল, ডিম, পাউরুটি, কলা, বিস্কুট, খিচুড়ি ইত্যাদি খাবার অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের জন্য মিড-ডে মিল হিসেবে দিতে পারেন। বর্তমানে দেখা যায়, কোনো কোনো শিক্ষার্থী বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসে, আবার কেউ কেউ টাকা দিয়ে দোকান থেকে অস্বাস্থ্যকর খাবার কিনে খায়। এতে তারা অসুস্থ্য হয়ে যায়। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, বাড়ি থেকে নিয়ে আসা খাবার তাদের সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত জরুরি, তাহলে সহজেই মিড-ডে মিল চালু করা সম্ভব। এছাড়া স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে বিদ্যালয়ে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেন। এর পাশাপাশি যদি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে একটি করে টিফিন বক্স তুলে দেয়া যায়, তবে মিড-ডে মিল কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে।

আতাকরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী জেসমিন আক্তারের দিনমজুর পিতা শাকিল মিয়া বলেন, আমার আর্থিক অবস্থা দূর্বল। তাই মেয়েকে স্কুলে যাওয়ার সময় টাকা বা দুপুরের খাবার দিতে পারি না। তাই মেয়ে বেশির ভাগ সময় স্কুলে যেতে চায় না। তাছাড়া অনেক সময় দুপুরের খাবার ঠিকমত না খাওয়ার কারণে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। সরকার মিড ডে মিল চালু করলে আমার মেয়ের মতো সব শিক্ষার্থীরা এর সুফল ভোগ করতে পারবে। স্কুলে উপস্থিতির হার বাড়বে।

শিক্ষাবীদ ও অধ্যাপক কাজী শেখ ফরিদ বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতে ১৯৯৫ সাল থেকে মিড ডে চালু রয়েছে। যেসব এলাকায় মিড ডে চালু সেখানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার শতভাগের কাছাকাছি। মিড ডে মিল খাওয়া শিক্ষার্থীরা শারিরীক ও মানসিকভাবে অনেক ফুটফুটে। বাংলাদেশেও সরকারের উদ্যোগে বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে চালু করা প্রয়োজন। এতে করে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধসহ নানাবিধ উপকার হবে।

চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘ছাত্র-ছাত্রীরা নিয়মিত দুপুরের খাবার খেলে দেহে পুষ্টি থাকে। অন্যথায় শরীরে নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে পুষ্টিহীনতায় ভোগে। যেভাবেই হোক কোমলমতি ছেলে-মেয়েদের মিড ডে মিল চালু করলে শারিরীক ও মানসিক দুই দিকে উপকার হবে। সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষ মিড ডে মিলের বিষয়টি ভেবে দেখা প্রয়োজন’।

আরও পড়ুন...