স্বপ্ন দেখতে দেখতেই পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পর্যটন সেক্টরকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন গঠন করেন। পরবর্তী সময় পর্যটন মন্ত্রণালয়, ট্যুরিজম বোর্ড গঠিত হয়। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশে সময়ের সাথে পর্যটনের এগিয়ে চলা যেন কচ্ছপ গতিকেও হার মানিয়েছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর আমাদের বাংলাদেশ। সেই সৌন্দর্যটাকেও পর্যটকদের মাঝে ছাড়িয়ে দিতেও যেন কার্পন্য দেখতে পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে বাংলাদেশী পর্যটকরা দেশ-দেশান্তরে ছুটে বেড়ায়।। অথচ বিধাতা নিজ হাতে যেন সৌন্দর্যকে বিছিয়ে দিয়েছেন আমাদের এই বাংলাদেশে। আছে নদ-নদী, পাহাড়, বন-জঙ্গল, আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশি। মাঝ সমুদ্রে রয়েছে ছোট ছোট অসংখ্য দ্বীপ।
কি নেই বাংলাদেশের? নেই পর্যটনকে গুরুত্ব দিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশটাকে বিশ্বের মাঝে তুলে ধরার স্বপ্নদ্রষ্টা। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর নতুন করে স্বপ্ন না দেখে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নটাকেই বাস্তবায়ন করুন। দেশ এগিয়ে যাবে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে ট্যুরিজম শিল্প।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও দেশে কোনো আইকনিক ল্যান্ডমার্ক স্থাপন করতে পারিনি। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। পর্যটনকে আয়ের অন্যতম উৎস সৃষ্টিকারী অনেক দেশ রয়েছে বিশ্বে। শুধুমাত্র কিছু আইকনিক ল্যান্ডমার্ক দর্শনের জন্য বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে থাকে। বিদেশী পর্যটক কোনো দেশে ভ্রমণ করলে সেই দেশের ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি, হোটেল ইন্ডাস্ট্রি, এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি সুরক্ষিত হয়।
শুধু এশিয়ার নয় বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ সিঙ্গাপুর। আর সিঙ্গাপুরের অন্যতম নিদর্শন মেরিনা বে স্যান্ডস, গার্ডেন বাই দ্যা বে, সিঙ্গাপুর ফ্লাইয়ার, মারলায়ন সবই মনুষ্য সৃষ্টি। এমনকি সমুদ্রে জেগে উঠা দ্বীপ স্যান্টোসা-কে এমন ভাবে সাজিয়েছে যেন সকল শ্রেণীর পর্যটকদের জন্য আঁতুরঘর। আর ইউনির্ভাসেল স্টুডিও যেন পৃথিবীকেই তুলে ধরা হয়েছে। বক্তব্যে নয়, কর্মে হোক সিঙ্গাপুরের আদলে বাংলাদেশ।
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের পেট্রোনাস টাওয়ার যা টুইন টাওয়ার নামেই বিখ্যাত হয়ে আছে। বিশ্বের নানা দেশ থেকে মালয়েশিয়ায় বেড়াতে আসার মূল উদ্দেশ্যই থাকে টুইন টাওয়ার দর্শন। মালয়েশিয়া ভ্রমণে এসে কেউ টুইন টাওয়ারে যাবে না, তা হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না। আর গেনটিং হ্ইাল্যান্ড এর কথা না বললেই। একটি পরিত্যাক্ত পাহাড় বেস্টিত এলাকাকে মনের মাধুরি মিশিয়ে কিভাবে চিত্তাকর্ষক করা যায় তা না দেখলে বোঝা যাবে না। আধুনিক ক্যাবল কার চড়ার অভিজ্ঞতাও গেনটিং ভ্রমণে অর্জন করা যায়।
প্রশাসনিক শহর পুত্রযায়া – মালয়েশিয়ার এ এক অন্যতম নিদর্শন। বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে গড়ে উঠা শহরগুলির মধ্যে অন্যতম। এর বিশেষত প্রতিটি স্থাপনার শিল্পকর্ম সম্পূর্ণ আলাদা। আর্কিট্যাকচারাল ডিজাইনগুলো পর্যটকদের মূল আকর্ষণ। রিলিজিয়াস টু্রস্টিদের আকর্ষণও রয়েছে পুত্রযায়া মসজিদকে ঘিরে। হিন্দু ধর্মালম্বী সহ সাধারন পর্যটকদের জন্য বাটু ক্যাব একটি আকর্ষণীয় স্থান। বাংলাদেশী শ্রমিকদের শ্রমে ঘামে গড়ে উঠা আধুনিক মালয়েশিয়াকেও উদাহরণ হিসেবে নিতে পারে বাংলাদেশ।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি অপেরা হাউজের সৌন্দর্যের কথা সকলের জানা। সিডনি হারবার সহ সব শিল্প কর্মই এক একটি আইকনিক ল্যান্ডমার্ক। এর সৌন্দর্য দর্শনে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকরা অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করে থাকেন।
একটি মসজিদকে কেন্দ্র করেও ট্যুরিস্ট জোন সৃষ্টি হতে পারে। মিশরের আল-আজহার মসজিদ তেমনি একটি আকর্ষণীয় স্থান। যেখানে বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়সহ সকল ধর্মের পর্যটকরা আল আজহার মসজিদে ভ্রমণ করে থাকেন। আর মিশরের পিরামিডের কথা না বললেই নয়। বিশ্বের ইতিহাস আর ঐতিহ্যর স্বাক্ষী মিশরের পিরামিড।
পৃথিবীর সব রঙ্গীন সৌন্দর্যের স্রোত যেন এসে মিশে গেছে আমেরিকার বিভিন্ন গন্তব্যে। নিউ ইয়র্কের স্ট্যাচু অব লিবার্টি, এম্পেয়ার স্টেট বিল্ডিং, ব্রুকলেন ব্রিজ কিংবা সান ফ্রান্সিসকোর গোল্ডেন গেট ব্রিজ, ওয়াশিংটনের দি হোয়াইট হাউজ, শিকাগোর ক্লাউড গেট বা লস এঞ্জেলেসের হলিউড সাইন সবই যেন এক একটি আইকনিক ল্যান্ডমার্ক।
ইউরোপ যেন আধুনিক বিশ্বের সূতিকাগার। আর যুক্তরাজ্যের লন্ডন যেন সেই আধুনিকতার কেন্দ্রবিন্দু। লন্ডন আই, বিগ বেন, ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে, টাওয়ার ব্রিজবাকিংহাম প্যালেস, লন্ডন টাওয়ার সব যেন নান্দনিকতার ভরপুর। আইকনিক ল্যান্ডমার্কের সমাহার। পর্যটক আকর্ষণের মূল অস্র। সুযোগের অপেক্ষায় থাকে পর্যটকরা সেই সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের কথা সবাই জানে। এর সৌন্দর্য বিস্তৃতি ঘটায় পর্যটকদের মাঝে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ইতিহাস ঐতিহ্যের নিদর্শন তাজ মহল, কুতুব মিনার, রেড ফোর্ট আছে। রয়েছে ইন্ডিয়া গেট। আধুনিক সৌন্দর্যের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল রয়েছে কলকাতায়।
আর মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক শহর আরব আমিরাতের দুবাই যেন অপেক্ষা করে রাতের আলো ঝলমলে রূপের জন্য। প্রতিদিনই নতুন করে জাগ্রত হয় পর্যটকদের আনন্দ দেয়ার জন্য। সুউচ্চ স্থাপনা বুর্জ আল খালিফা যেন এক আশ্চর্যজনক স্থাপনা। দুবাই মেরিনার কথা না বললেই নয়। সব কিছুই যেন তৈরী হয়ে আছে পর্যটকদের জন্য।
আমরা আধুনিকতার ছোঁয়া পেতে চাই পুরাতন ধ্যান ধারনায়। যা পর্যটন শিল্পের এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে আছে। নিজেদের ঐতিহ্য আর সামাজিক ইতিহাসকে সাথে নিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করার জন্য আধুনিক সুযোগ সুবিধা আর নতুনত্বের ছোয়ায় আইকনিক ল্যান্ডমার্ক সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।
দেশের আকর্ষণীয় স্থাপনাগুলো বিশ্বের পর্যটকদের কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে। লুই আই কানের স্থাপনা জাতীয় সংসদ ভবন, জাতীয় স্মৃতি সৌধ আধুনিক বিশ্বের অন্যতম স্থাপনা কিংবা বর্তমান সময়ে স্থাপিত পদ্মা সেতুতে রয়েছে নান্দনিকতার স্পর্শ। সুষ্ঠ ও সঠিক পরিকল্পনায় রাজধানী ঢাকা কিংবা অন্যান্য শহরে নান্দনিক স্থাপনার আইকনিক ল্যান্ডমার্ক স্থাপন করলে আন্তর্জাতিক পর্যটক বাংলাদেশ ভ্রমণে আগ্রহী হয়ে উঠবে।
রিলিজিয়াস, আর্কিউলজিক্যাল, নদী কেন্দ্রিক ট্যুরিজম গড়ে উঠতে পারে। বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ গুলোকে মালদ্বীপ কিংবা থাইল্যান্ডের আদলে ট্যুরিজম স্পট হিসেবে তৈরী করা সম্ভব হলে জাতীয় আয়ের প্রধানতম খাত হয়ে উঠবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প। পর্যটন শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠলে দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণেও অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।
শুধুমাত্র কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত কিংবা সুন্দবনের সৌন্দর্য এর উপর নির্ভর না করে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশ সাধনে দেশে আইকনিক ল্যান্ডমার্কের স্থাপনা পর্যটকদের বর্তমান সময়ের কাছে প্রত্যাশা।
লেখক : মোঃ কামরুল ইসলাম,মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স