রাঙ্গাঁর হলফনামাতেও তথ্যের গড়মিল

পিবিএ, ঢাকা– ‘ঋণ খেলাপি’ রুহুল আমিন হাওলাদারের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ার পর জাতীয় পার্টির মহাসচিবের দায়িত্ব পাওয়া পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গাঁর হলফনামাতেও তথ্যের গড়মিল পাওয়া গেছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা তিনি জমা দিয়েছেন, তাতে পুরনো একটি মামলার তথ্য পুরো গায়েব করে দেওয়া হলেও তার মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেছেন রংপুরের রিটার্নিং কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক এনামুল হাবীব।

রংপুর জেলা ও মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি রাঙ্গাঁ এবারও রংপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির লাঙ্গলের প্রার্থী। জোটসঙ্গী আওয়ামী লীগ এ আসনে কোনো প্রার্থী দেয়নি।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামায় রাঙ্গা জানিয়েছিলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে কোতোয়ালি থানায় ২০০৯ সালের ২১ জানুয়ারি দায়ের করা একটি মামলায় তিনি অভিযুক্ত। ওই মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ হয়েছে এবং তার কপি তিনি যুক্ত করে দিয়েছেন।

আর এবারের হলফনামায় তিনি বলেছেন, বর্তমানে কোনো ফৌজদারি মামলায় তিনি অভিযুক্ত নন। অতীতেও তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয় নাই। অতীতের মামলার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যের ঘরে তিনি লিখেছেন ‘প্রযোজ্য নহে’।

রাঙ্গাঁর মনোনয়নপত্রে তথ্যের এই গড়মিল নিয়ে কথা বলতে চাননি নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।

ইসি সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা পিবিএকে বলেন, মনোনয়নপত্র নিয়ে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বুধবার পর্যন্ত আপিল করার সুযোগ রয়েছে। তাই আপাতত তারা এ বিষয়ে কোনো কথা বলবেন না। কারও আপত্তি থাকলে তিনি আপিল করতে পারেন।

নির্বাচন কমিশনের আরেকজন কর্মকর্তা হলফনামার তথ্য বাছাই ও মনোনয়নপত্র গ্রহণের বিষয়ে গত নভেম্বরে ইসির জারি করা একটি পরিপত্রের কথা বলেছেন।

সেখানে বলা হয়েছে, অতীতে প্রার্থীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কোনো ফৌজদারি মামলার রেকর্ড আছে কি না, থাকলে তার রায় কি ছিল- এ বিষয়ে প্রার্থী সকল তথ্য দেবেন এটাই প্রত্যাশিত। তবে অতীতের মামলা সংক্রান্ত, বিশেষ করে অনেক পুরনো মামলা হলে, বিশদ তথ্য প্রার্থীর কাছে সঙ্গত কারণে নাও থাকতে পারে।

“তাই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়ে গেছে বা খালাস পেয়েছেন এমন ক্ষেত্রে বিশদ তথ্য না দিতে পারার কারণে মনোনয়নপত্র বাতিল করা হবে না। তবে দণ্ডিত হয়ে থাকলে এবং তা উল্লেখ না করার বিষয় প্রমাণিত হলে মনোনয়নপত্র গ্রহণযোগ্য হবে না।”

আগের হলফনামায় যে মামলার তথ্য দেওয়া হয়েছিল, তা বাতিল হয়েছিল কি না বা তিনি খালাস পেয়েছিলেন কি না সে তথ্য না দিয়ে রাঙ্গাঁ এবার সরাসরি দাবি করেছেন, অতীতে কোনো ফৌজদারি মামলা তার বিরুদ্ধে হয়নি।

এর কারণ জানতে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব টেলিফোনে পিবিএকে বলেন, “দুদকের একাট মামলা হয়েছিল, ওটা তো ওয়ান ইলেভেনের সময়ের মামলা। এটা অব্যাহতি হয়ে গেছে, তাই এটার তথ্য না দিলেও চলবে। এই জন্য আমি দিইনি।”

স্ত্রীর সম্পদের ঘর এবার ফাঁকা

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্ত্রীর নামে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকার সম্পদ থাকার তথ্য দিয়েছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রাঙ্গাঁ। তবে এবার স্ত্রীর আয় ও সম্পদের ঘর পুরো ফাঁকা রেখেছেন তিনি।

গতবারের হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, রাঙার স্ত্রীর হাতে নগদ ৪ লাখ ২০ হাজার ৩২৪ টাকা, ব্যাংকে ১৫ লাখ ২০ হাজার টাকা, ১৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা দামের বাস বা মোটর গাড়ি, ৬০ হাজার টাকা দামের গয়না, ৬০ হাজার টাকা দামের ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী এবং ২০ হাজার টাকার আসবাবপত্র ছিল।

এছাড়া স্ত্রীর নামে থাকা স্থাবর সম্পদের তালিকায় ৯৩ হাজার টাকা দামের কৃষি জমি এবং ১৬ লাখ টাকা দামের অকৃষি জমির তথ্য দিয়েছিলেন রাঙ্গাঁ।

হলফনামার তথ্য বাছাই ও মনোনয়নপত্র গ্রহণের বিষয়ে ইসির নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, কোনো প্রার্থী আয়কর দাতা হলে, তিনি তার রিটার্ন ও সম্পদের বিবরণী দাখিল করলে হলফনামায় স্ত্রীর বা নির্ভরশীলদের আয় ও সম্পদের ঘরে বিস্তারিত তথ্য না দিলেও মনোনয়নপত্র গ্রহণযোগ্য হবে, কেননা আয়কর রিটার্নেই এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য থাকে।

স্ত্রীর নামে সম্পদের ঘর ফঁকা রাখার কারণ জানতে চাইলে মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ পিবিএকে বলেন, “আমি নিয়ম মেনেই সব দিয়েছি। আমার মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষিত হয়েছে। কোনো সমস্যা থাকলে তো প্রশ্ন উঠত, বৈধ ঘোষণা হত না। তা তো হয়নি “

রাঙ্গাঁর সম্পদ বেড়ে দ্বিগুণ

বর্তমান সরকারের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাঁচ বছরে মসিউর রহমান রাঙ্গাঁর আয় বেড়েছে ছয় গুণ, আর সম্পদের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণের বেশি। হলফনামা অনুযায়ী, মসিউর রহমান রাঙ্গাঁর বার্ষিক আয় ৮৭ লাখ ৫৪ হাজার ২৫৫ টাকা। কৃষি, বাড়িভাড়া, ব্যবসা, চাকরি এবং অন্যান্য উৎস থেকে এ টাকা আয় হয় তার।

দশম সংসদ নির্বাচনের আগে দেওয়া হলফনামায় তার বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছিল ১৪ লাখ আট হাজার ৩৪ টাকা। এ হিসেবে পাঁচ বছরে তার আয় বেড়ে ছয়গুণ হয়েছে। রাঙ্গাঁ এবারের হলফনামায় পাঁচ কোটি ৬৩ লাখ ১৮ হাজার টাকার সম্পদের হিসাব দিয়েছেন। দশম নির্বাচনের আগে তিনি দুই কোটি ৮০ লাখ ৫৯ হাজার টাকার তথ্য দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, এই সময়ে তার সম্পদ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

গত নির্বাচনের হলফনামায় রাঙ্গা পেশা হিসেবে শুধু পরিবহন ব্যবসার তথ্য দিয়েছিলেন। এবার পরিবহন ব্যবসা ছাড়াও ফিলিং স্টেশনের মালিকানা এবং কমিশন এজেন্ট হিসেবে ব্যবসা করার তথ্য দিয়েছেন তিনি।

জাতীয় পার্টির এই নেতার এক কোটি ৮৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদের মধ্যে ব্যাংকে নগদ জমা আছে ২৩ লাখ ১৪ হাজার ১২৪ টাকা এবং আর বিদেশি মুদ্রায় আছে তিন লাখ ৯৪ হাজার ৪২২ টাকা। স্থায়ী আমানত হিসেবে ৮৯ লাখ ৫৬ হাজার টাকার বিনিয়োগ আছে তার।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এক কোটি নয় লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ টাকার অস্থাবর সম্পদের মালিক ছিলেন মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ। যার মধ্যে নয় লাখ ৪০ হাজার ৩৪২ টাকা নগদ, ৯০ লাখ ৫৮ হাজার ৭৩৪ টাকা ব্যাংকে এবং দুই লাখ ৮১ হাজার ৭৭৯ টাকা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ হিসেবে ছিল।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি রাঙ্গাঁ এবার জানিয়েছেন, তার মালিকানায় মোট ৬৪ লাখ টাকা দামের বাস ও মোটরগাড়ি রয়েছে। গতবারের হলফনামায় রাঙ্গাঁর নামে তিন লাখ এবং স্ত্রীর নামে ১৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা দামের যানবাহন থাকার তথ্য দেওয়া হয়েছিল।

পাঁচ বছরে ইলেকট্রনিক সামগ্রী বেড়েছে রাঙ্গাঁর। এক লাখ ৭০ হাজার টাকার ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী এখন বেড়ে পাঁচ লাখ ৯০ হাজার টাকার হয়েছে। তবে আগের মতই ১৬ হাজার টাকার স্বর্ণালঙ্কার, এক লাখ ২০ হাজার টাকার আসবাবপত্র এবং ৫৪ হাজার টাকার অন্যান্য অস্থাবর সম্পত্তি থাকার তথ্য দিয়েছেন তিনি।

হলফনামা অনুযায়ী, রাঙ্গাঁ এখন তিন কোটি ৭৪ লাখ ৩২ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদের মালিক। পাঁচ বছর আগে যা ছিল এক কোটি ৭১ লাখ ১৮ হাজার টাকা।

বর্তমানে ৮৬ লাখ ১৬ হাজার ৭০০ টাকার কৃষি ও ৫৯ লাখ চার হাজার ৪৬৩ টাকার অকৃষি জমি, এক কোটি ৪৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩০ ও ৭৩ লাখ ৬২ হাজার ৭৮২ টাকা দামের দুটি দালান এবং ১০ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকার ফিলিং স্টেশনের মালিক তিনি।

দশম নির্বাচনের আগে দেওয়া হলফনামায় ছয় লাখ ৭৫ হাজার টাকার কৃষি জমি, ছয় লাখ ৩৬ হাজার ৫০০ টাকার অকৃষি জমি, এক কোটি ১৫ লাখ ১০ হাজার ৫৭৪ টাকার দালান এবং ৪২ লাখ ৯৬ হাজার ১৯০ টাকার বাড়ি দেখিয়েছিলেন রাঙ্গাঁ।

আয় আর সম্পদের সঙ্গে দায়ও বেড়েছে এই সাংসদের। বর্তমানে ৯৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪১৫ টাকার ব্যাংক ঋণ রয়েছে তার। যা পাঁচ বছর আগে ছিল ৭৩ লাখ ২৪ হাজার ৩১৬ টাকা।

পিবিএ/এমটি/এইচএইচ

আরও পড়ুন...