তাবলীগ জামায়াতের কোন সংবিধান নেই। অলিখিত সংবিধানও নেই। এ সংগঠনের কোন লিখিত আইন, বিধিবিধান ও উপবিধি নেই। তবুও তাবলীগ সংগঠন এবং আন্দোলন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং সুশৃঙ্খল আন্দোলন। তাবলীগ জামায়াত এবং আন্দোলনের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনন্য। ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ/সংগঠকদের এ আন্দোলনের ব্যবস্থাপনা হতে অনেক কিছু শিক্ষা নেয়ার আছে। গবেষণা করার আছে। গবেষণা করলে তারা দেখতে পাবেন- সংস্থা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাদের বহু মূল্যবান তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা কত প্রাসঙ্গিক। বিংশ শতাব্দীর ব্যবস্থাপনা প্রকৌশল ও বিজ্ঞানে তাবলীগ আন্দোলন অত্যাশ্চর্য অবদান রেখেছে বলা যেতে পারে।
সর্ববৃহৎ সাংগঠনিক কার্যক্রমঃ কোন কোন মাপকাঠিতে তাবলীগ আন্দোলনকে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ইসলামী আন্দোলন বলা যেতে পারে। এ মাপকাঠি হতে পারে আন্দোলনের জন্য ব্যয়কৃত অর্থ এবং মনুষ্য মাস বা মনুস্য ঘন্টা। পৃথিবীর ছয়টি মহাদেশের লাখ লাখ, এমনকি কোটি কোটি মুসলিম এ আন্দোলনে সময় বিনিয়োগ করে থাকেন। তা করেন অত্যন্ত নিষ্ঠা, আনুগত্য ও উৎসাহের সঙ্গে। তাবলীগের উদ্ধুদ্ধকরণ ক্ষমতা অনন্য।
কেন্দ্রীয় কমিটি বা মজলিসে শুরাঃ বাংলাদেম তাবলীগ জামায়াতের একটা কেন্দ্রীয় কমিটি আছে। এটিকে বলা হয় মজলিসে শূরা। এ কেন্দ্রীয় কমিটির কোন আনুষ্ঠিক নির্বাচন বা মনোয়ন অনুষ্ঠিত হয় না। সদস্য ছাড়াও বহু ব্যক্তি কমিটির মিটিং এ অংশগ্রহণ করে থাকেন। তবে আলোচনায় অংশগ্রহন করার জন্যে নয়, উদ্দেশ্য-জিকির করা এবং আলোচনা শ্রবণ। তাবলীগে যারা অপেক্ষাকৃত বেশী অবদান রেখেছেন তারাই এ কমিটির আলোচনার সময় কথাবার্তা বলেন। যারা কম অবদান রেখেছেন তারা চুপ থাকেন (অবদানের মাপকাঠি হচ্ছে তাবলীগে সর্বোচ্চ বেশী চিল্লা/দিনের জন্য সময় ব্যয়)। মজলিসে শূরার মিটিং-এ অংশগ্রহন করা কারও জন্য নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু জুনিয়ররা সাধারণত সিনিয়রদের উপস্থিতিতে কথা বলেন না, অনুরুদ্ধ বা নির্দেশিত না হলে।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিযোগিতাহীনতাঃ তাবলীগ আন্দোলনে ক্ষমতা বা পদমর্যাদার জন্যে কোন প্রতিযোগিতা নেই, নেতৃত্বের জন্য কোন্দল নেই। যিনি অতীতে কেন্দ্রীয় শূরার আমীর একবার নির্বাচিত হতেন, তিনি আমৃত্যু সে পদ অলংকৃত করতেন। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যে কোন আন্দোলন নেই। নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কোন পরচর্চা নেই্ গীবত নেই। কাদা নিক্ষেপ নেই। কারও মানহানী করার প্রবণতা নেই।
আমীর বা মহাসচিববিহীন সংগঠনঃ বিশ্ব তাবলীগ জামায়াতের সর্বশেষ বা তৃতীয় আমীর ছিলেন মরহুম হযরত মাওলানা এনামুল হাসান (রহঃ)। তৎপূর্বে আমীর ছিলেন হয়রত মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ ইলিয়াস (রহঃ)। মরহুম মাওলানা এনামুল হাসানের (রহঃ) ইন্তেকালের পর বিশ্ব তাবলীগ জামায়াতের আমীর নির্বাচন করা হয়নি। আমীরের পদই বিলুপ্ত হয়ে গেছে ধরে নেয়া যায়। পাকিস্তানের বর্তমান আমীর হচ্ছেন- মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব। ভারতের আমীর হচ্ছেন মাওলানা মোহাম্মদ সাদ। হয়তো তারপর কোন আমীর মনোয়ন হবে না। তৎপূর্বে আমীর ছিলেন হযরত মাওলানা আবু বশীর (রহঃ)। বাংলাদেশে তাবলীগ জামাআতের আজীবন আমীর ছিলেন মরহুম হযরত মাওলানা আব্দুল আজীজ (রহঃ)। তার ইন্তেকালের পর কোন আমীর মনোনয়ন করা হয়নি। সকল নির্বাহী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় মজলিসে শূরার সভায়। মজলিসে শূরা অধিবেশনকালে একজন শূরা সদস্যকে সভাপতি করে নেয়া হয়। সভার সিদ্ধান্তের নোট নেয়া হয়। কোন কার্যবিবরণী লেখা হয় না। এ নিয়ে কোন সমস্যা হয় না। আমীর, মহাসচিব বা সচিব ছাড়া এত বড় সংগঠন চলতে পারে- এমন নজির বোধহয় বিশ্বে আর নেই।
প্রধান কার্যালয়ঃ বাংলাদেশে তাবলীগ জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বা হেডকোয়ার্টার হল- ঢাকা মহানগরীতে অবস্থিত কাকরাইল মসজিদ। এ মসজিদে কোন টেলিফোন নেই। কোন টাইপরাইটার নেই্ কোন রেজিষ্টার নেই। ফাইল নেই। তাবলীগের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে কোন লিখিত চিঠি কোথাও প্রেরণ করা হয় না। তাবলীগ সম্বন্ধে কোন চিঠি কেউ লিখলে লেখক ব্যক্তিগত দায়িত্বেই তা লিখে থাকেন এবং ব্যক্তিগত ব্যয়েই তা প্রেরণ করেন।
কেন্দ্রীয় ফান্ডঃ বাংলাদেশ তাবলীগ জামায়াতের কোন কেন্দ্রীয় ফান্ড নেই্ চাঁদা নেই। কোন ব্যাংক একাউন্ট নেই। কোন কেন্দ্রীয় বাজেট নেই। কোন লিখিত হিসাবরক্ষন পদ্ধতি নেই। অথচ কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু তহবিল তছরুপ বা দুর্নীতির কোন অভিযোগ বা খবরাখবর নেই।
সমালোচনার প্রতি উপেক্ষাঃ তাবলীগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে বহু ধরনের কথাবার্তা হয়। বহু প্রবন্ধ-পুস্তিকা তাদের বিরুদ্ধে লিখা হয়েছে, কিন্তু এসব সমালোচনা খন্ডন করে কোন জবাব তাবলীগ জামায়াত থেকে দেয়া হয় না। যদিও ব্যক্তিগত দায়িত্বে কেউ কেউ কিছু বলে থাকেন, কিন্তু কেন্দ্রীয় মুরুব্বিগন সমালোচনার কোন জবাব না দিয়ে তা উপেক্ষা করেন এবং ছবর করার নসীহত করে থাকেন। তর্ক করে, যুক্তি দেখিয়ে কাউকে ভুল প্রমানিত করা বা পরাস্ত করা তাবলীগের নীতি নয় বরং ছবর, সহনশীলতা, ইকরাম ও সম্মান দেখিয়ে তাদের মন জয় করে নেয়াই তাবলীগ জামা’তের নীতি।
মূল্যায়নঃ প্রতিনিয়তই তাবলীগকারীদের মূল্যায়ন হচ্ছে। কিন্তু সমালোচনার কোন সুযোগ নেই- সম্মুখে বা পেছনে। প্রয়োজন নেই। মুজাকিরা এবং আত্মসমালোচনার ফলে সমালোচনার প্রয়োজন তিরোহিত হয়েছে। তাবলীগ জামাআতের জীবদ্দশায় অথবা মৃত্যুর পর কারও সমালোচনা নেই। ব্যর্থতার জন্যে সম্মুখে বা পিছনে নিন্দা নেই। যে কোন ব্যক্তির ইজ্জত সুরক্ষিত এবং অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। এই সম্পদ আত্মসাতের জন্যে কারও কোন প্রবণতা নেই।
প্রচার বিমুখতাঃ তাবলীগ আন্দোলনের কোন প্রেস রিলিজ, প্রকাশনা, প্রচার নেই। তাবলীগের বিশ্ব সম্মেলন(বিশ্ব ইজতেমা) কোন তারিখে অনুষ্ঠিত হবে তা উল্লেখ করে কোন প্রেস রিলিজ ইস্যু করা হয় না। তবুও লাখ লাখ লোক নির্ধারিত সময়ের আগে তাবলীগের বার্ষিক সম্মেলনে সমবেত হন। গত কয়েক বছর যাবৎ সাংবাদিকগন নিজ উদ্যোগে খবর সংগ্রহ করে প্রকাশ করে থাকেন। তাবলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন বা ইজতেমায় কে কোন অধিবেশনে সভাপতি বা বক্তা তার কোন ঘোষনা দেয়া হয় না। তবুও লাখ লাখ মুসল্লি নির্ধারিত সময়ের আগে তাবলীগের বার্ষিক সম্মেলনে সমবেত হন। শ্রোতারা বক্তৃতা শুনেন। কে বক্তৃতা করছেন তা একজন আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করেই জেনে নেন। কে বক্তা এ বিষয়টি তাবলীগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের নিকট বিন্দুমাত্র গুরুত্বপূর্ন নয়। কি বলা হয়েছে তা-ই গুরুত্বপূর্ন। টঙ্গীর ন্যায় প্রায় দু’মাইল লম্বা প্যান্ডেলে কে বক্তৃতা করছেন তার চেহারা দেখা বা বোঝা যায় না। বক্তার চেহারা দূরের কথা- মঞ্চ যে কোথায় তাও বহু স্থান থেকে দেখা যায় না। সংবাদকর্মীদের সুবিধার্থে ২০০২ সালে সর্বপ্রথম এক জনের ব্যক্তিগত অর্থায়নে “বিশ্ব ইজতেমা সংবাদ সংস্থা” নামে একটি যুগোপযোগী তথ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে বিশ্ব ইজতেমার ব্যবস্থপনা শীর্ষ মুরুব্বিদের সমর্থন না পেলে সংস্থাটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ২০০৭ সাল থেকে অদ্যবদী চলমান টঙ্গী প্রেস ক্লাবের ব্যবস্থাপনায় সাংবাদিকদের সুবিধার্থে মাঠের উত্তর পার্শ্বে মিডিয়া সেল প্রতিবছর স্থাপন করা হয় কিন্তু সংবাদ কর্মীদের চাহিদা পূরণ করতে পারেনি।
অন্যের প্রতি ইকরাম বা সম্মানঃ তাবলীগ জামায়াত এর আন্দোলন অসাধারন সাফল্য ও প্রসারের অন্যতম কারণ হল অপরের প্রতি সম্মান, ইকরাম, বিবেচনা ও শ্রদ্ধাবোধ। তাবলীগ আন্দোলন আসহাবে সুফফা ও পরবর্তীকালের সুফী দরবেশদের আদর্শ্যে উজ্জীবিত। তারা কোন পাপী বা অন্যায়কারীকে ঘৃনা করতেন না। যেমন করতেন না দেশে দেশে ইসলাম প্রচারকারী সুফী দরবেশগণ। অন্যের প্রতি বিবেচনা এবং ভালবাসা এ আন্দোলনের শক্রদেরও জয় করে নেয়। এ আন্দোলনের মধ্যে কোন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নেই। তাদের সকল পদক্ষেপই বিরুদ্ধাবাদীদের প্রতি ইতিবাচক।
সামর্থ্য অনুযায়ী অবদানঃ তাবলীগ আন্দোলনে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী অংশগ্রহণ এবং অবদান রাখতে উদ্ধুদ্ধ করা হয়। যদি কোন নিবেদিত প্রান ব্যক্তি বছরে এক চিল্লা (৪০ দিন) নয় বরং তিন চিল্লা তাবলীগে কাটাতে চান, কিন্তু আর্থিক সঙ্গতির কারনে তা পারের না, তাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব তা-ই করতে বলা হয়। আল্লাহ আল-কুরআনে বহুবার পৃথিবীতে পরিভ্রমনের নির্দেশ দিয়েছেন। তাবলীগ জামায়াতের বিদেশ ভ্রমনের জন্যে উদ্ধুদ্ধ করা হয়। কিন্তু যার যতটুকু আর্থিক সামর্থ্য সে অনুসারেই বিদেশ সফর করতে বলা হয়। যাদের বিদেশ ভ্রমনের সামর্থ্য নেই, তাদের দেশের অভ্যন্তরেই তাবলীগের কাজে বের হতে অনুরোধ করা হয়।
দীনের মেহনতের অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত তাবলীগ আন্দোলন শুধু অতীতে নয়, বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সারাবিশ্বে বিপুল সাড়া জাগিয়েছে। বিশ্ব মুসলিমের মনকে নাড়া দিয়েছে। এভাবেই তাবলীগ জামায়াতের কার্যক্রম চলতে থাকবে আজীবন। ইনশাআল্লাহ।
লেখক: এম. ইব্রাহীম সরকার ,সাংবাদিক।