শিক্ষকদের রাজনীতির বাইরে রাখার প্রস্তাব উঠছে ডিসি সম্মেলনে

সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত (এমপিওভুক্তি) বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের রাজনীতির বাইরে রাখার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। শিক্ষকতা ছাড়া যেন অন্য কিছু করতে না পারে সেজন্য একটি বিধিমালা তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে। একটি বিধিমালা থাকলে শিক্ষার মান বাড়বে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) ভেঙে দুই ভাগ করার সুপারিশও করা হয়েছে।

ডিসি সম্মেলন সামনে রেখে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রস্তাবটি নিয়ে আগামী ২৪ জানুয়ারি বিকেল সোয়া ৩টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ডিসিদের সেশনে আলোচনা হবে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এতে উপস্থিত থাকবেন।

আগামী ২৪ জানুয়ারি শুরু হয়ে ২৬ জানুয়ারি শেষ হবে তিন দিনের জেলা প্রশাসক সম্মেলন। এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ৬৪ জেলার ডিসির কাছে প্রয়োজনীয় প্রস্তাব আহ্বান করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তাদের কাছ থেকে আসা সেসব প্রস্তাব ইতোমধ্যে যাচাই-বাছাইও সম্পন্ন হয়েছে। এ নিয়ে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
সংশ্নিষ্টরা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এটাই শেষ ডিসি সম্মেলন। সে কারণে এবারের ডিসি সম্মেলনকে সরকারের জন্যও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ একাধিক সূত্রে জানা যায়, নওগাঁ ডিসির পক্ষ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) ভেঙে দুই ভাগ করার সুপারিশও করা হয়েছে। এতে একটির ভাগের নাম ‘মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর’ও অন্যটির নাম ‘উচ্চশিক্ষা অধিদফতর’ প্রস্তাব করা হয়েছে। এক অধিদফদতরে কাজের পরিমাণ বেশি হওয়ায় তা বাস্তবায়নে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সে কারণে সেবা গ্রহীতার সংখ্যা বেশি হওয়ায় তিনি মাউশিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করার যুক্তি দেখিয়েছেন।

জানা গেছে, বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের রাজনীতি থেকে বিরত রাখতে আচরণ বিধিমালা প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছেন ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম। প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ থাকছে। এতে শ্রেণি কার্যক্রমে তাদের দায়সারা আচরণ পরিলক্ষিত হয়। বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার মতো সুনির্দিষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন করা হলে শিক্ষকতা পেশায় থেকে রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণে শিক্ষকদের নিরুৎসাহিত করা সম্ভব হবে। শিক্ষকতার পাশাপাশি ঠিকাদারি, সাংবাদিকতাসহ একাধিক পেশায় নিয়োজিত থাকার প্রবণতা রোধ হওয়া এবং শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে আন্তরিক হবেন। এতে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার মানোন্নয়নের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটা সম্ভব হবে।

মাদারীপুরের ডিসি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ থেকে জারি করা সবপত্র ও পরিপত্রের একটি অনুলিপি ডিসি এবং উপজেলা কর্মকর্তাদের পাঠানোর সুপারিশ করেন। ঝিনাইদহের ডিসি বেসরকারি এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য আচরণবিধি তৈরি করার প্রস্তাব তুলে ধরেছেন।
ভোলার ডিসি নিজ খরচায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা জারির সুপারিশ করেছেন। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস সম্পর্কে সঠিক ইতিহাস জানতে এবং দেশপ্রেম তৈরি এই উদ্যোগ কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি।

ঝালকাঠির ডিসি শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য ২৪ ঘণ্টার একটি চ্যানেল খোলার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।

কিশোরগঞ্জের ডিসি সুপারিশপত্রে হাওরাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে গ্রীষ্মকালীন ছুটি ২৫ এপ্রিল থেকে ১২ মে পর্যন্ত কার্যকর করার প্রস্তাব করেন। বর্তমানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৩ জুলাই থেকে ১৯ জুলাই এবং প্রাথমিকে ২৮ জুন থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত ছুটি আছে। কিন্তু বর্ষাকাল শুরু হলে হাওরাঞ্চলে ২৫ এপ্রিল থেকে ১২ মে সময়ে নৌকা বা পায়ে হেঁটে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া-আসা করতে প্রচণ্ড অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় বলে সেটি পরিবর্তন চান তিনি।
জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কর্মপরিধির সঙ্গে পদবি সামঞ্জস্য করার সুপারিশ করেছেন চুয়াডাঙ্গার ডিসি। তিনি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা আর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে পদবি রূপান্তরের সুপারিশ করেন। চুয়াডাঙ্গার ডিসি পাঠ্যপুস্তকে ট্রাফিক ও সড়ক পরিবহন আইনের ধারণা দেওয়ার সুপারিশ করেন। আর কক্সবাজারের ডিসির প্রস্তাব হচ্ছে- সেখানে একটি বিশেষায়িত মেরিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সমুদ্রসম্পদ কাজে লাগানো এবং মহেশখালী কেন্দ্রিক বাস্তবায়নাধীন বিশাল প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন পরবর্তীকালে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হবে সে ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয় ভূমিকা রাখবে।

এর আগে গত বছর ডিসি সম্মেলনে শিক্ষাসংক্রান্ত ১০টি প্রস্তাব এসেছিল। সেগুলোর অধিকাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে বলে জানা গেছে। গত বছরের প্রস্তাবের মধ্যে আছে- স্কুল ভর্তিতে বয়স সংশোধন, বিভাগীয় শহরে কারিগরি শিক্ষাবোর্ড, অধ্যক্ষ-প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পুনর্গঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করা, কারিগরি শিক্ষার প্রসার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর্থিক স্বচ্ছতায় ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন, ভূমি সংক্রান্ত বিষয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তকরণ, উপজেলা পর্যায়ে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিটি গঠন, টেক্সটাইল কলেজ স্থাপন, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার সুপারিশ করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন...