ফারুক মঈনউদ্দীন : কেনিয়ার মাসাইমারার রিসোর্টে পৌঁছার পর রিসেপশনিস্ট যখন ‘জাম্বো’ বলে সম্ভাষণ করলেন, তখন বুঝতে পারিনি শব্দটির ইংরেজি অর্থ, ‘হ্যালো’। যথাক্রমে সোহাইলি ও ইংরেজি ভাষার এ দুটো শব্দের কোনো বাংলা প্রতিশব্দ নেই, কারণ আমরা এভাবে সম্ভাষণ জানাই না। তাই আমাদের ভাষায় এটির কোনো প্রতিশব্দ নেই। ছোটবেলায় পাঠ্যবইতে দেখেছিলাম ‘হ্যালো’ শব্দটির বাংলা করা হয়েছে ‘ওহে’। কেনিয়ায় সেবার আরও শিখেছিলাম ‘আসান্তে সানা’, অর্থাৎ ‘অনেক ধন্যবাদ’, ‘কারিবু সানা’ মানে ‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম’। পাঠক লক্ষ্য করবেন, ধন্যবাদের প্রত্যুত্তরে ‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম’ বলার যে রীতি, সেটির কোনো বাংলা পরিভাষা নেই, তাই কেউ বাংলায় ধন্যবাদ জানালে তার জবাব দিতে হয় ইংরেজিতে ‘নেভার মেনশন’ কিংবা ‘ইউ আর ওয়েলকাম’ বলে। এ রকম অনেক শব্দ বা মৌখিক প্রকাশভঙ্গির বাংলা নেই বলে- এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে বাংলা খুব দরিদ্র ভাষা। কিন্তু বিদেশিদের সম্ভাষণ জানাতে আমাদের ‘হ্যালো’ই বলতে হয়, যেহেতু শব্দটির কোনো বাংলা পরিভাষা নেই, কিন্তু ‘থ্যাংক ইউ’র বাংলা প্রতিশব্দ থাকলেও আমরা কেনিয়ানদের মতো ‘আসান্তে সানা’র মতো বাংলায় ‘ধন্যবাদ’ বলি না।
‘ছেলেবেলায় বাংলায় পড়িতেছিলাম বলিয়াই সমস্ত মনটার চালনা সম্ভব হয়েছিল। শিক্ষা জিনিসটা যথাসম্ভব আহার-ব্যাপারের মতো হওয়া উচিত। খাদ্যদ্রব্যে প্রথম কামড়টা দিবামাত্রেই তাহার স্বাদের ‘সুখ’ আরম্ভ হয়। পেট ভরিবার পূর্ব হইতেই পেটটি খুশি হইয়া জাগিয়া ওঠে- তাহাতে তাহার জারক রসগুলোর আলস্য দূর হইয়া যায়। বাঙালির পক্ষে ইংরেজি শিক্ষায় এটি হইবার জো নাই। তাহার প্রথম কামড়েই দুই পাটির দাঁত আগাগোড়া নড়িয়া-ওঠে মুখবিবরের মধ্যে একটা ছোটখাটো ভূমিকম্পের অবতারণা হয়। তারপর সেটাতে লোষ্ট্র জাতীয় পদার্থ নহে, সেটা যে রসে পাক-করা মোদকবস্তু, তাহা বুঝিতে-বুঝিতেই বয়স অর্ধেক পার হইয়া যায়। বানানে ব্যাকরণের বিষয় লাগিয়া নাক-চোখ দিয়া যখন অজস্র জলধারা বহিয়া যাইতেছে, অন্তরটা তখন একেবারেই উপবাসী হইয়া আছে। অবশেষে বহুকষ্টে অনেক দেরিতে খাবারের সঙ্গে যখন পরিচয় ঘটে, তখন ক্ষুধাই যায় মরিয়া। প্রথম হইতেই মনটাকে চালান করিবার সুযোগ না পাইলে মনের চলৎশক্তিতেই মন্দা পড়িয়া যায়। তখন চারিদিকে খুব কষিয়া ইংরেজি পড়াইবার ধুম পড়িয়া গিয়াছে, তখন যিনি সাহস করিয়া আমাদিগকে দীর্ঘকাল বাংলা শিখাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, সেই আমার স্বর্গগত সেজ দাদার উদ্দেশে সকৃতজ্ঞ প্রণাম নিবেদন করিতেছি।’
মাতৃভাষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি ছাড়া যা বলতে চাই, সেটা বোঝানো কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছিল না। সকল দেশে সকল মানুষের মধ্যে মাতৃভাষার প্রতি যে নাড়ির টান সেটি সার্বজনীন, কতিপয় ঔপনিবেশিক দাস মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ ছাড়া এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে নিজ ভাষার মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য ও তৃপ্তি খুঁজে পায় না। তবু মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের যে আলাদা গর্ব থাকার কথা ছিল, সেটি এখন আর বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডটাতে সীমাবদ্ধ না থাকলেও আমাদের নিজেদের মধ্যেই যেন রয়েছে গোপন হীনম্মন্যতা, তা না হলে দোকানের নাম থেকে শুরু করে বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রে পর্যন্ত আমরা বাংলা ব্যবহার করতে লজ্জা পাই। সরকারি প্রতিষ্ঠানও এই মানসিক জটিলতা থেকে মুক্ত নয়, তা না হলে সরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানির নাম আমরা ‘টেলিটক’ রাখতাম না। আমাদের যখন ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’, পাশের দেশে সেটা প্রথম থেকেই ‘দূরদর্শন’। এ রকম আরও উদাহরণ খুঁজে বের করা গেলেও এই লেখার স্বল্প পরিসরে সেসবের উপস্থাপনের সুযোগ সীমিত। আবার ‘তূর্ণা নিশীথা’, ‘ঊর্মি অরুণা’ কিংবা ‘ঊর্মি গোধূলি’র মতো চমৎকার নামও আমাদের আছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ঝুলিতে।
ওপরে কেনিয়ার অভিজ্ঞতালব্ধ উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট যে মাতৃভাষার মধ্যে মানুষের আত্মপরিচয়ের বিষয়টি সহজাত। আর সেটি এখন বাংলাদেশের কয়েকজন তরুণের আত্মাহুতির কল্যাণে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিস্তৃত। একটি ভাষাকে বিজাতীয় ভিনভাষী শাসকদের যে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল, সেই বিজয়গাথা আজ আর আমাদের নিজেদের একার নয়, বিশ্বের দেশগুলো আজ মাতৃভাষা চর্চার গৌরব ও প্রয়োজনীয়তা যে অনুভব করছে, সেটা আমাদের দেশের কিছু অকুতোভয় তরুণের দেখানো পথ ধরেই এসেছে, এটাই আমাদের অনেক অপ্রাপ্তির মধ্যে একটা প্রাপ্তি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে ঘাঁটি গেড়ে বসার পর থেকে সর্বত্র ইংরেজি ভাষা চালু করেছিল। তখন স্কুল-কলেজগুলোতেও বাংলা ছিল নিষিদ্ধ ভাষা। ১৯১০ সাল পর্যন্ত ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বাংলা ভাষার কোনো স্থান ছিল না। ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন প্রাদেশিক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী আজিজুল হকের পৃষ্ঠপোষকতায় সপ্তাহব্যাপী এক শিক্ষা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে তার ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার মাধ্যমে সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষাদানের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। তিনি তখন আন্তর্জাতিক শিক্ষা সংঘের ভারতীয় শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কিন্তু তৎকালীন সরকার রবীন্দ্রনাথের সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। উৎসবের শেষ দিনে রবীন্দ্রনাথ একটি প্রবন্ধও উপস্থাপন করেছিলেন। সেই প্রবন্ধে তিনি শিক্ষার সকল স্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের জোর দাবি জানান। তিনি বলেন, বাংলা ভাষার দোহাই দিয়ে যে শিক্ষার আলোচনা বারংবার দেশের সামনে এনেছি, তার মূলে আছে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। জীবন স্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বাহির হইতে দেখিলে আমাদের পরিবারে অনেক বিদেশি প্রথার চলন ছিল, কিন্তু আমাদের পরিবারের হৃদয়ের মধ্যে একটা স্বদেশাভিমান স্থির দীপ্তিতে জাগিতেছিল। স্বদেশের প্রতি পিতৃদেবের যে একটি আন্তরিক শ্রদ্ধা তাঁহার জীবনের সকল প্রকার বিপ্লবের মধ্যেও অক্ষুণ্ণ ছিল, তাহাই আমাদের পরিবারস্থ সকলের মধ্যে একটি প্রবল স্বদেশপ্রেম সঞ্চার করিয়া রাখিয়াছিল। তখন শিক্ষিত লোকে দেশের ভাষা এবং দেশের ভাব উভয়কেই দূরে ঠেকাইয়া রাখিয়া ছিলেন। আমাদের বাড়িতে দাদারা চিরকাল মাতৃভাষার চর্চা করিয়া আসিয়াছেন।’ তার প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষার ভিতের ওপর গড়ে উঠেছিল বলেই তিনি স্বশিক্ষালব্ধ ইংরেজি দিয়ে নিজের কবিতাকে ভাষান্তর করে আন্তর্জাতিক সাহিত্যানুরাগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে রবীন্দ্রনাথ মাতৃভাষা বাংলার প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন বলেই নিতান্ত তরুণ বয়সে তিনি লিখেছেন, ‘ইংরাজিতে যাহা শিখিয়াছ তাহা বাংলায় প্রকাশ কর, বাংলা সাহিত্য উন্নতি লাভ করুক ও অবশেষে বাংলা বিদ্যালয়ে দেশ ছাইয়া সেই সমুদয় শিক্ষা বাংলায় ব্যাপ্ত হইয়া পড়ুক।’
মাতৃভাষার মাধ্যমে সকল ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সুনির্দিষ্ট ভাবনা ছিল বলেই তিনি বলেছিলেন, ‘কোন শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে চাইলে, গভীর করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে তাহাকে চিরপরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়।’
ইংরেজি ভাষাভাষী নয় এমন কয়েকটি উন্নত দেশের উদাহরণ থেকেই বক্তব্যটির সত্যতা অনুভূত হয়। চীন, জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্সের মতো দেশগুলো নিজেদের ভাষায় জ্ঞানচর্চার মাধ্যমেই উন্নতি লাভ করেছে প্রযুক্তি ও শিক্ষার সকল শাখায়। একই সঙ্গে নিজেদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে, ছড়িয়ে দিয়েছে, শিক্ষাকে করেছে নিজেদের জন্য সুলভ। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে প্রথমে নিজেদের ভাষার উৎকর্ষ সাধন এবং তার সঙ্গে শিক্ষার প্রসারের মধ্য দিয়ে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে মাতৃভাষায় নিজেকে প্রকাশ করা যে রকম সহজ ও মসৃণ, সেটি বিদেশি ভাষায় হওয়ার সুযোগ কম। হারুকি মুরাকামিকে মাঝেমধ্যে আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে হয়। এ প্রসঙ্গে মাতৃভাষার ঐশ্বর্যের কথা তিনি লিখেছেন এভাবে, আমাকে যখন গুরুগম্ভীর কোনো বিষয় নিয়ে জাপানি ভাষায় কথা বলতে হয়, আমি যেন শব্দের সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছি- এ রকম একটা অনুভূতি আমাকে ভাসিয়ে নেয়। আমার সামনে অনির্দিষ্ট সংখ্যক বিকল্প থাকে, থাকে অনির্দিষ্ট সম্ভাবনা। লেখক হিসেবে জাপানি ভাষা এবং আমার মধ্যে একটা দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। তাই আমাকে যদি অনির্দিষ্ট আকারের বড় শ্রোতৃমণ্ডলীর সামনে কথা বলতে হয়, আমি অঝোর ধারায় নেমে আসা শব্দের মহাসাগরের সামনে সংশয়ী আর হতাশ হয়ে পড়ি। নিজ মাতৃভাষায় স্বাচ্ছন্দ্যই বরং তাকে শব্দের মহাসমুদ্রের মধ্যে বিপাকে ফেলে দেয়।
আবার স্বল্প জনসংখ্যার দেশগুলোও যে মাতৃভাষার বাইরে পা না ফেলে টিকে থাকতে পারে, তার উদাহরণ মঙ্গোলিয়া। একবার উলানবাটোরে সুখবাতার স্কয়ারে দেখি মেলা বসেছে, কিন্তু কিসের মেলা বোঝার উপায় নেই। কিছুক্ষণ পরপর মাইকে আমাদের দেশের বার্ষিক স্পোর্টসের মতো ঘোষণার সুরে মনে হচ্ছে কোনো একটা প্রতিযোগিতা হয়তো। মেলার ভিড়ের সঙ্গে মিশে গিয়ে উদ্ধার করার চেষ্টা করি উপলক্ষটা। একে ওকে জিজ্ঞেস করি, স্পিক ইংলিশ? সবারই একই জবাব, নো। একটা গের-এর দরজায় অভ্যর্থনাকারী দুই সুসজ্জিতা তরুণী দাঁড়িয়ে, ওদের জিজ্ঞেস করি, স্পিক ইংলিশ? ওরা আমার কথার জবাব না দিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ‘অ্যাংলো’ বলে হেসে গড়িয়ে পড়ে।
আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করি। একজন ইয়েস বলার পর জিজ্ঞেস করি, এখানে কী হচ্ছে? লোকটি কিছু না বুঝে লাজুক হেসে শুধু বলে, নো নো। আমারও রোখ চেপে যায়, ঘটনাটা কী বের করতেই হবে। সামনে দেখি ‘টিভি ফাইভ’য়ের এক রিপোর্টার বুম হাতে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ক্যামেরার চোখ উপেক্ষা করে ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি ইংরেজি জানে কি না। ও ‘ইয়েস, লিটল ইংলিশ’ বললে জানতে চাই কী হচ্ছে এখানে। ও খুব কায়দা করে বলে, অ্যা ফেয়ার। বলি, ফেয়ার তো দেখতেই পাচ্ছি, কিসের ফেয়ার? সে অনেক হাতড়েও আর কোনো ইংরেজি শব্দ খুঁজে পায় না। মেলাটা কিসের তার ইংরেজি জবাব জানতে সে এদিক-ওদিক কাউকে খোঁজে। আমি বলি, ইংরেজি জানে এমন কাউকে খুঁজে বের করো। ছেলেটি ক্যামেরার সামনে থেকে বের হয়ে ইংরেজি জানা কাউকে খুঁজতে গিয়ে ভিড়ের ভেতর বেমালুম গায়েব হয়ে যায়। ক্যামেরার পেছনের মেয়েটি অসহায়ের মতো এদিক-সেদিক তাকায়। বুঝতে পারি, ছেলেটি হয় জুতসই কাউকে খুঁজে বের করতে গেছে, অথবা স্রেফ কেটে পড়েছে আপাতত।
টিভি ফাইভের ছেলেটি ভেগে যাওয়ার পর ইংরেজি জানা আর কাউকে খুঁজে না পেয়ে অনির্দিষ্টভাবে ঘুরে একটা ঘেরা জায়গার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। ঘেরার ভেতরে কয়েক দলে ভাগ হয়ে কিছু ছেলেমেয়ে মিলে আলাদা আলাদা দেয়াল
গাঁথছিল ইট মসলা দিয়ে। ঘেরার পাশে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক দর্শকদের উদ্দেশে আবারও গলা তুলে জিজ্ঞেস করি, অ্যানিবডি স্পিক ইংলিশ হিয়ার? এবার কাজ হয়, পাশ থেকে এক মঙ্গোলীয় তরুণী এগিয়ে এসে বলে, ইয়েস, আই ক্যান। এবার মেয়েটি খোলাসা করে বলে, ২০১৫ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হবে ‘ওয়ার্ল্ড স্কিলস কম্পিটিশন’, অর্থাৎ বিশ্ব দক্ষতা প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতায় মঙ্গোলীয় প্রতিযোগীদের অংশগ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে এখানে চলছে দেশীয় প্রতিযোগিতা। ছয় লাখ বর্গমাইলের দেশটির ৩১ লাখ জনসংখ্যার বেশিরভাগই মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষা জানে না, কিন্তু তারাও প্রস্তুতি নিচ্ছে বিশ্ব দক্ষতা প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য।
ম্যাকডোনাল্ডসে খাবারের অর্ডার দিতে ভাষা কোনো সমস্যা নয়। মেন্যু কার্ডে খাবারের ছবি দেখিয়ে দিলেই চলে। কিন্তু সেবার চীনের এক ম্যাকডোনাল্ডসে ছবিতে দেখানো নির্দিষ্ট খাবারের সঙ্গে বাড়তি কয়েকটা আইটেম যোগ করতে গিয়েই বাধল বিপত্তিটা। কাউন্টারের মেয়েটাকে যতই বোঝাই, কিছুই বুঝতে পারে না। ভুল-শুদ্ধ দু’ভাবেই ইংরেজিতে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কোনো ফল হয় না। অগত্যা সারির পেছনে দাঁড়ানো এক ইউরোপীয় সায়েব চীনা ভাষা জানেন বলে নিজে থেকেই এগিয়ে এসে দোভাষীর দায়িত্ব নিয়ে আমাদের কাছ থেকে শুনে নিয়ে চীনা ভাষায় মেয়েটিকে বুঝিয়ে দিলেন। এবার মেয়েটি ‘আঁ হা হা ওকে ওকে’ বলে খুব সমঝদারের মতো হাসে, যেন আমরা ইংরেজি জানি না বলেই ওকে বোঝাতে পারছিলাম না।
মেইনল্যান্ড চায়নায় গিয়ে ভাষা সমস্যার কারণে প্রায় উপোসে মরার জোগাড় হলেও হংকংয়ের অবস্থা মোটেই তেমন নয়। হংকং যদি দেড়শ’ বছর ব্রিটিশ উপনিবেশ না থাকত, তাহলে ওদের অবস্থাও চীনের মতোই হতো। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের ঔপনিবেশিক পরিবেশে থাকার কারণে এখানকার গড়পড়তা মানুষের ইংরেজিটা ভালোই রপ্ত আছে।
ভারতবর্ষে অবশ্য ইংরেজি নিয়ে তেমন কোনো ঝামেলা হয় না; বরং সেবার চেন্নাই গিয়ে ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলতে চাইলে সে জানায় হিন্দি জানে না, ইংরেজি অথবা তামিল বলতে হবে। মুম্বাইতে আবার অন্য অবস্থা, এখানকার গড়পড়তা মানুষ কয়েকটা ভাষায় চালিয়ে যেতে পারে। শিক্ষিত মানুষমাত্রই ইংরেজি, মারাঠি, হিন্দি ও গুজরাটি- এই চারটা ভাষায় স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারে। শুদ্ধ হিন্দি বা উর্দুটা যেমন শ্রুতিমধুর, মারাঠি বা গুজরাটি তেমন নয়। মুম্বাইয়া মারাঠিরা হিন্দিকেও মারাঠি ধাঁচে অনেকটা কাঠখোট্টা করে ফেলেছে। মারাঠি ভাষার সুরটা কেমন ঝগড়াটে শোনায় কানে। কাউকে লাইনে অপেক্ষায় থাকার জন্য হিন্দিতে বলা হয় ‘কৃপয়া প্রতীকষা করেঁ, আপ কাতারমে হ্যায়।’ মারাঠিতে সেটা ‘কৃপয়া প্রতীকষা করা, আপুন রাঙ্গিতাহাৎ।’ আবার গুজরাটির সঙ্গে বাংলার কিছু মিল দেখতে পেয়ে চমৎকৃত হতে হয়। ‘কেমন আছো’ গুজরাটি ভাষায় ‘কেম ছো’। তবে কেবল এটুকুই, জবাবে বলা হয় ‘মাজামা ছু’, মানে ‘আমি ভালো আছি’। ‘তোমার নাম কী’ বোঝাতে ‘তামারু নাম সু ছে’। এসব ভারতের আঞ্চলিক ভাষা হলেও সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ভাষা বাইশটি।
ভারতীয় ব্যাংক নোটের সামনের পিঠে ইংরেজি ও হিন্দিতে টাকার অঙ্ক কথায় লেখা থাকলেও পেছনে মোট পনেরোটি ভাষায়ও (অহমিয়া, বাংলা, গুজরাটি, কন্নড়, কাশ্মীরি, কঙ্কানি, মালয়ালাম, মারাঠি, নেপালি, উড়িষ্যা, পাঞ্জাবি, সংস্কৃত, তামিল, তেলেগু ও উর্দু) লেখা হয়। পরবর্তী সময়ে মৈথিলি, বোড়ো, ডোগরি, মনিপুরি, সাঁওতালি ও সিন্ধিকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়া হলেও ভারতীয় টাকায় সেসব ব্যবহার হয় না।
হংকংয়ের মতো আমরাও দুইশ’ বছর ব্রিটিশ শাসনে ছিলাম, কিন্তু হংকংবাসীর মতো ইংরেজি আমরা শিখতে পারিনি। তার পরিবর্তে শুদ্ধ বাংলাও কি রপ্ত করতে পেরেছি? সর্বক্ষেত্রে ভুল বানান, ভুল ভাষার ছড়াছড়ি দেখে এ কথাই প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের যেসব সড়কের নামের সঙ্গে ‘সরণি’ আছে, সেগুলোর কপালে দুর্ভোগ অনিবার্য, কারণ ‘সরণি’ বানানটি যতভাবে করা সম্ভব ততভাবেই লেখা হয়; কেবল লেখা হয় না সঠিক বানানটি। এসব দেখার কেউ নেই।
বাংলা ভাষার এ দুরবস্থার কথা বলার সময় আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বলার সময় কিন্তু ইংরেজির প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা হচ্ছে না। বাংলাদেশ ইংরেজিভাষী নয় এমন উন্নত দেশগুলোর সমকক্ষ নয় বলে ইংরেজিকে পরিহার করে কেবল বাংলার সাহায্যে আমাদের বিশ্ববাজারের মহাসড়কে চলাচল সম্ভব হবে না, চলতে চাইলেও সেটি হবে ধীরগতির হালকা যানের মতো বেমানান, হাস্যকর ও যোগ্যতাহীন। সুতরাং প্রকৃত শিক্ষাকে আত্মস্থ করার জন্য মাতৃভাষা এবং বৈশ্বিক উন্নয়নের অংশীদার হওয়ার জন্য ইংরেজি ভাষা দুটোর প্রতিই সমান গুরুত্ব দিতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের তীব্র ও বিস্তৃত অভিঘাতকে মোকাবেলা করার জন্য আমাদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে, আর প্রকৃত শিক্ষার ভিত রচনা হয় মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে। এই ভিত দৃঢ় হলে বিশ্বস্বীকৃত ভিনদেশি ভাষা রপ্ত করা কঠিন হবে না।
পিবিএ/শআ