বরকতময় রাত শবে বরাতের ফজিলত

শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ‘লাইলাতুন মিন নিসফি শাবান’ বলা হয়। মুসলিম উম্মাহর কাছে এ রাত শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত হিসেবে পরিচিত। সঠিক হোক আর না-ই হোক এ দিন মুসলিম উম্মাহ বিভিন্ন রুসুম রেওয়াজে মেতে ওঠে। তবে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ‘এ রাতের ফজিলত ও মর্যাদা অনেক বেশি।

বরকতময় লাইলাতুম মিন নিসফা শাবান তথা শবে বরাতের এ রাতে আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার স্থাপনকারী (মুশরিক) ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া সব ক্ষমাপ্রার্থনাকারীকে আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দেন।

বর্তমান মুসলিম সমাজে শাবান মাস ও লাইলাতুল বারাআত-এর ইবাদত-বন্দেগি নিয়ে যদিও বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি অবস্থা বিরাজ করছে; তথাপিও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস অনুযায়ী লাইলাতুল বারাআতের গুরুত্ব অত্যাধিক।

এ রাতের ইবাদত-বন্দেগির ব্যাপারে হাদিসের দলিল থাকায় মুসলিম উম্মাহর ‘লাইলাতুন মিন নিসফি শাবান’ শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতের ইবাদতের ব্যাপারে মসজিদে গিয়ে রুসুম-রেওয়াজ পালনসহ কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি করা যেমন ঠিক নয়; তেমনি এ রাতের কোনো আলম-ইবাদত করাই যাবে না বলে অবহেলা বা ছাড়াছাড়িও ঠিক হবে না।

ইসলাম মানুষকে ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা প্রদান করেছে। তাই উম্মাতে মুহাম্মাদি সহিহ হাদিস মোতাবেক সঠিকভাবে শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেদেরকে নিয়োজিত করে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করা আবশ্যক।

লাইলাতুল বারাতের ফজিলত
হজরত মুয়ায ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআ’লা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতিত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’

নিসফা শাবানের আমল প্রসঙ্গে
হজরত ইবনুল হারিস থেকে বর্ণিত- হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধরণা হল তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল।
যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা! অথবা বলেছেন, ও হুমাইরা! তুমি কি এ আশংকা করছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন?
আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। তখন প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভাল জানেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন ইরশাদ করেন- এটা হলো অর্ধ-শাবানের রাত। (শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত) আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই। (শুয়াবুল ইমান, বাইহাকি)

এই হাদিসের শিক্ষা
১. দীর্ঘ নফল নামাজ পড়া, যাতে সেজদাও দীর্ঘ হবে;
২. কোরআন তেলাওয়াত করা;
৩. নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরুদ পড়া;
৪. ইসতেগফার পড়া বা ক্ষমা প্রার্থনা করা;
৫. একনিষ্ঠ মনে আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করা;
৬. রাতের কিছু সময় ঘুমানো (এমন যেন না হয় যে, সারা রাতের দীর্ঘ ইবাদতের ফলে ক্লান্তিতে ফজরের নামাজের জামাত ছুটে যায়।)
৭. পরদিন রোজা পালন করা। কেননা ইবনে মাজাহ’র হাদিসে এসেছে,
হজরত আলী ইবনে আবু তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “পনের শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখ। কেননা, এ রাতে সুর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। আছে কি কোনো রিজিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিজিক দেব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা ডাকতে থাকেন।’ (ইবনে মাজাহ)

তাছাড়া প্রতি আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ তথা আইয়ামে বিজের রোজা রাখার বিষয়টি সহিহ হাদিস দ্বারাই প্রমাণিত। আর শাবান মাসের এ দিনটিও আইয়ামে বিজের অন্তর্ভূক্ত। প্রিয়নবি নিজেও আইয়ামে বিজের রোজা রাখতেন।

তবে শবে বরাতকে কেন্দ্র করে বর্তমান সমাজে নানা ধরনের রুসুম রেওয়াজ তথা, হালুয়া-রুটি, খিচুরি-শিরনী, পথ-ঘাট, মসজিদ, বাড়িঘর সাজানো ও আতশবাজি করার প্রথা চালু রয়েছে। তা থেকেও বিরত থাকতে হবে। তবে লাইলাতুল বারাআতের উপলক্ষ মনে না করে মিসকিনদের মাঝে সওয়াবের নিয়তে হালুয়া রুটি বা ভালো খাবার-দাবার অর্থ-কড়ি বিতরণ করতে কোনো নিষেধ নেই।

বিশেষ করে-
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো দোয়াটি বেশি বেশি পড়ে আল্লাহর সাহায্য কামনা করাও উম্মাতে মুহাম্মাদির একান্ত কর্তব্য।
اَللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِىْ شَعْبَانَ وَ بَلِّغْنَا رَمَضَانَ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা বারিকলানা-ফি শাবান ওয়া বাল্লিগনা- রামাদান।
অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জন্য শা’বান মাসে বরকত দাও এবং আমাদেরকে রমযান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও। অথ্যাৎ আমাদের নেক হায়াত দান করো, যাতে আমরা রমযান মাস পেয়ে রমযানের বরকত লাভ করতে পারি।

আবার এভাবেও দোয়া করতেন-
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা বাল্লিগনা রামাদান ওয়া আই’ন্না আ’লা সিয়ামিহি ওয়া ক্বিয়ামিহি।’
অর্থ : হে আল্লাহ! আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন এবং রমজানে (দিনের বেলায়) রোজা পালন এবং (রাতের জেগে) নামাজ পড়ার তাওফিক দান করুন।’

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে উল্লেখিত বিষয়গুলোর প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেয়ার তাওফিক দান করুন। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী লাইলাতুল বারাআতের ফজিলত, বরকত ও মাগফেরাত লাভে সচেষ্ট হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

আরও পড়ুন...