খতীব ও ইমামগণ কি চাকুরী করেন?

সম্প্রতি সমাজের মসজিদসমুহে দায়িত্বরত খতীব,পেশ ইমাম,মুয়াজ্জিন এবং খাদেমদের নিয়ে কিছু বিষয় আলোচিত হচ্ছে। বিশেষ করে অতি নিম্নস্কেলের সম্মানী অথচ একটু কম -বেশী হলেই প্রশ্নের বাণ,চাকুরীচ্যুত ইত্যাদির কারণে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।ফলে দায়িত্বপালনে যথাযথ নিষ্ঠার অভাব,অনীহা,বঞ্চিত মনোভাব, অন্য পেশার প্রতি আগ্রহ ইত্যাদি তো আছেই এমনকি এর সাথে তাদের মধ্যে অসততা,জেদি,প্রতারণা কিংবা তাগুদের এজেন্ট হিসাবে কাজ করার নজীরও মিলছে। এর কারণ হিসাবে মসজিদ কমিটির মানসিকতা তারা আল্লাহর কাজ করেন। অল্পে সন্তুষ্ট,মসজিদের ফান্ডে এর চেয়ে বেশী সামর্থ নেই ইত্যাদি কত না যুক্তি বিদ্যমান।

স্বাভাবিকভাবেই এর প্রতিক্রিয়ায় তাদের পক্ষ থেকে দাবি ঊঠেছে :
(১) মানানসই বেতন স্কেল আপডেটকরন।
(২).প্রতিমাসে ও সময়মত বেতন বা সম্মানী পরিশোধ করতে হবে,অনিয়মিত ও আদায়ের উপর নির্ভর করলে চলবে না।
(৩) যেহেতু চাকুরী করি,সেহেতু বোনাস দিতে হবে।
(৪) খতীব সাহেবদের দাবি “আমাদের চুক্তি ৫২টি খুতবা,এর বাহিরে কোন কাজের জন্য ডাকা যাবে না,সম্ভব হলে আসব কিন্তু উপযুক্ত TA+DA দিতে হবে।
(৫) ছোট নোট বা কয়েন দেওয়া যাবে না এবং
(৬) দুই ঈদের জন্য আলাদা চুক্তি কর‍তে হবে। ইত্যাদি।

আমার বিশ্বাস- প্রত্যেক সচেতন,বিবেকবান এবং শিক্ষিত মুসলমান উপরোক্ত দাবির সাথে একমত না হয়ে পারবেন না।কেননা, তারাও আমাদের মতোই সামাজিক মানুষ,তাদের পরিবার আছে,সন্তানাদি আছে এবং বিবিধ সামাজিক দায়িত্ব আছে।মসজিদের কাজ করেন বলেই সেগুলো এড়ানোর সুযোগ নেই।প্রত্যেকের নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী পরিকল্পিত জীবন যাপনের অধিকার আছে।

আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান তার কর্মজীবনের প্রায় পুরোটাই পাশাপাশি দুইগ্রামের একটি জামাতে ইমামতি করেছেন।তখনকার নিয়ম্নানুযায়ী মসজিদ কমিটি বছরশেষে যা সম্মানী দিয়েছেন তাতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন।তাকে ৫২টি খুতবাহ,তারাবীহ,দুই ঈদ,শবে বরাত,ক্বদর,আশুরা ইত্যাদি দুই গ্রামের‍্ যাবতীয় বিয়ে-শাদি,জানাজা-আকিকাহ,মিলাদ-খতম ইত্যাদি এককভাবে সামাল দিতে হতো।রমাদ্বান মাসে হাট থেকে ফিরে কিছু খেয়ে বা না খেয়েই আবার ছুটতেন তারাবীহ পড়ানোর জন্য।মাঝে মাঝে প্রচন্ড ক্লান্ত হতে দেখেছি।তথাপি মুসুল্লীদের পক্ষ হতে বোনাস বা এক লিটার দুধপানের জন্য কোন সম্মানী নিতে দেখি নাই।উপরন্ত কেহ খতম বা মিলাদের আয়োজন করেছে তিনি শিক্ষকতা কিংবা পারিবারিক প্রয়োজনে ব্যস্ত থাকায় যেতে পারেন নাই বা দেরিতে পৌছেছেন -এজন্য খোটা দিত অনেকেই।(কেন যেতে পারেন নাই? তাকে কি আমরা বেতন দেই না? ইত্যাদি।অবশ্য আব্বা এগুলো ভ্রুক্ষেপ করেন নাই এবং কারো বিরুদ্ধে আপত্তিও রাখেন নাই)।

এখনো আমাদের সমাজে অনেকেই ইমাম -মুয়াজ্জিনদের একটু বেশী দিতে প্রস্তাব করলেই মুখ কালো করে বক বক করে।বেনামাজি দের জানাজা,বিবাহ ইত্যাদিতে যেতে দেরি করলেই প্রশ্ন তুলে “করবেনা কেন আমরা বেতন দেই না?”

অনেকেই আবার অনৈতিক বিয়ে পড়ানোর জন্য ইমাম সাহেবকে চাপ প্রয়োগে বাধ্য করেন।

সুতরাং সমাজের মানসিকতা ও অবহেলাপুর্ণ আচরণের কারণেই খতীব,ইমাম ও মুয়াজ্জিনগণ “চাকুরী করি- সুতরাং চাকুরীর সুযোগ সুবিধা দিতে হবে” মর্মে দাবি করছেন ও দায়িত্বপালনে অনিয়ম করছেন ***কিন্তু এটা সঠিক নয় এবং সংশ্লিষ্ট পদ ও দায়িত্বের সাথে বেমানান ও অশোভন।

তবে সমাজে শিক্ষার হার বেড়ে গিয়াছে এবং উপরোক্ত আচরনের পরিবর্তন আসছে।অনেক মসজিদেই খতীব,ইমাম ও খাদেমদের যথাযথ সম্মানী,সুবিধা ও মর্যাদা দেওয়া হয় এবং এর হাওয়া বাকি মসজিদগুলোতেও শুরু হয়েছে,আলহামদুলিল্লাহ।

মসজিদের খতীব যিনি ওই এলাকায় জনগনের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে মানসিক,আধ্যাত্মিক,অর্থনৈতিক এবং সাংষ্কৃতিক নির্দেশক এবং ডাক্তার তথা রোগ নিরাময়কারি মোটিভিটর।তার ভুমিকা খিলাফতের সাথে সংশ্লিষ্ট।হজরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম তার ছেলেকে সাথে নিয়ে যে মোনাজাত করেছিলেন:রাব্বানা ওয়াব আসফিহিম…….. ইয়াতলু আলাইহিম আয়াতিকা ওয়া ইউজাক্কিহিম) এই দায়িত্ব তারই অংশবিশেষ।

২য় খলিফা হজরত ওমর (রা:) এক রাতে এক বিধবা মহিলাকে খাদ্যের অভাবে পাত্রে পানি নিয়ে জ্বাল দিতে দিতে অনাহারি বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতে দেখলেন।সংগে সংগে তিনি রুমে ফিরে প্রয়োজনীয় খাদ্য নিয়ে রওয়ানা করবেন। এমন সময় একজন এসে আমিরুল মুমিনিন সম্বোধন করে বস্তাটি বহনের অনুমতি চাইল।তিনি বলেছিলেন”না তা হয় না। এমনিতেই আমি প্রজাদের খাদেম হয়েও তাদের অনাহারে খাদ্যের সংস্থান করতে দেরি করেছি। আল্লাহপাকের কৈফিয়তের কোন জবাব নেই আমার কাছে।অধিকন্তু এই বোঝা তোমার মাথায় দিয়ে আরও যে অপরাধী হব””।

অন্যান্য সাহাবীগনকে যাকে যে দায়িত্ব নিযুক্ত করা হয়েছিল তারা সেখানেই নিষ্ঠার সাথে জবাবদিহির অনুভুতি নিয়ে কাজ করেছেন-কখনো চাকুরী মনে করেন নাই।
সুতরাং কোন খতীব বা ইমাম যদি মনে করেন যে তিনি চাকুরী করেন এবং সেই অনুযায়ী পেশাদার আচরন করেন,তাহলে তার পিছনে ইক্তেদা করা প্রশ্নসাপেক্ষ।
আল্লাহপাক সকলকেই নিজ নিজ দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করার তাওফীক দিন।

লেখক: মোঃ তাহমিদুর রহমান, কলামিষ্ট।

আরও পড়ুন...