সেই মার্চ এই মার্চ : বাঙালির অবিরাম এগিয়ে যাওয়া

march-PBA

পিবিএ ডেস্ক: আবার এসেছে মার্চ। একই সঙ্গে আত্মত্যাগ ও গৌরবের এই মাস। বেদনা ও আনন্দের মাস। গণহত্যার সূত্রপাত একাত্তরের এ মাসেই। বঙ্গবন্ধু মুক্তি ও স্বাধীনতার ডাক দেন এই মাসেই। অসহযোগ আন্দোলনের হাত ধরে বাঙালি স্বশাসনের স্বাদ পেয়েছিলেন এ মাসেই। পুরো জনগোষ্ঠীকে একটি অখ- জাতিতে রূপান্তর করেন তিনি এই বিক্ষুব্ধ মার্চেই। সাতই মার্চের পর গেরিলাযুদ্ধের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যায় বাংলাদেশের তরুণরা। তাই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ডাক পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে অকুতোভয় বাঙালি তরুণরা। সাধারণ ঘরের এই ছেলেমেয়েরাই স্বদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান তথা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের জীবন বাজি রেখে নেমে পড়ে বাংলাদেশের সকল প্রান্তে। এদের আটাত্তর শতাংশই ছিল কৃষকসন্তান। বাদবাকিরা শহর থেকে আসা মধ্যবিত্তের সন্তান। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু ও তার সহ-নেতারা। তারা ছিলেন সকলেই গ্রাম থেকে শিক্ষার-সন্ধানে নগরে আসা মধ্যবিত্ত। তাই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ও পাটাতনে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে চিন্তা-চেতনার এতটা মিল। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর এক গবেষণায় দেখেছি এরা বয়সে খুবই নবীন। গড় বয়স মাত্র বাইশ-তেইশ বছর। প্রশ্ন করেছিলাম তারা কেন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন? তাদের বেশিরভাগেরই উত্তর ছিল স্বাধীনতা অর্জনের বাসনা। তা ছাড়া তারা হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তাদের মা-বোনদের সম্ভ্রম রক্ষার তাগিদ অনুভব করেছিলেন। আর স্বপ্ন ছিল কায়েমি স্বার্থবাদীদের হাত থেকে স্বদেশকে রক্ষা করে তাকে শান্তি ও সমৃদ্ধির দেশে পরিণত করা। তাদের এই স্বপ্নের সাথে ঠিকই মিল খুঁজে পাই বন্দিজীবন থেকে মুক্ত জাতির পিতার কথায়। ১৯৭২ সালের ৮ মার্চ তিনি লন্ডন পৌঁছেন। ওই দিন লন্ডনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, “আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।” এর দুদিন পর ১০ জানুয়ারি দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে নেমেই তিনি উচ্চারণ করেন, “এই অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায়। … আমি ফিরে যাচ্ছি তাদের বিজয়ী হাসি রৌদ্রকরে। আমাদের বিজয়কে শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করার।” এর পর ঢাকা বিমানবন্দর থেকে পরিবারের সদস্যদের কাছে না গিয়ে তিনি সরাসরি চলে যান রেসকোর্স ময়দানে। মৃত্যুর একেবারে কাছাকাছি থেকে ফিরে আসা বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে কীভাবে গড়ে তুলবেন সেই সব কথা বলতে থাকেন। “আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায় তা হলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে, পূর্ণ হবে না। … বিধ্বস্ত বাংলাকে গড়ে তুলুন। নিজেরা সবাই রাস্তা তৈরি করতে শুরু করুন। … আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।” কী দূরদর্শী ছিল তার সেদিনের ওই উচ্চারণ! এর পর পরই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই তিনি স্বদেশকে নতুন করে গড়ে তোলার কাজে নেমে পড়েন। রাতদিন পরিশ্রম করেন। সোনার বাংলার যে স্বপ্ন তাকে আজীবন তাড়া করত সেই স্বপ্নের ছোঁয়া পান দেশবাসী ২৬ মার্চ, ১৯৭২। প্রথম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে তিনি বলেন, “আজ আমি যখন সোনার বাংলার দিকে তাকাই, তখন দেখতে পাই যুদ্ধবিধ্বস্ত ধূসর পা-ুর জমি, ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম, ক্ষুধার্ত শিশু, বিবস্ত্র নারী, আর হতাশাগ্রস্ত পুরুষ। আমি শুনতে পাই সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ, নির্যাতিত নারীর ক্রন্দন ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার ফরিয়াদ। আমাদের সরকার যদি এদের মুখে হাসি ফোটাতে না পারে, লাখ লাখ ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে তুলে দিতে না পারে এক মুষ্টি অন্ন, মুছে দিতে না পারে মায়ের অশ্রু ও বোনের বেদনা, তা হলে সে স্বাধীনতা মিথ্যা, সে আত্মত্যাগ বৃথা। … আমি ভবিষ্যৎ বংশধরদের সুখী ও উন্নততর জীবন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।” বাঙালির সুখ ও শান্তির জন্য কী অমানুষিক পরিশ্রমই না তিনি করেছেন। তাই মাত্র সাড়ে তিন বছরেই সকল বিধ্বস্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ করে একটি স্থিতিশীল সমাজ ও অর্থনীতি বিনির্মাণে তিনি অনেকটা পথই পাড়ি দিয়েছিলেন। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র, বাংলাদেশ এক ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে বিদ্রƒপ ও তাচ্ছিল্য, ম্যালথাসের ভঙ্গুর তত্ত্বের প্রতীক ব্যর্থ রাষ্ট্রের দুর্নাম ঘুচিয়ে, বৈরী প্রকৃতি ও দুর্ভিক্ষ শক্ত হাতে মোকবিলা করে তিনি সুজলা সুফলা বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে অনেকটাই সফল হয়েছিলেন। তার আমলের শেষ বর্ষে প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। পঁচাত্তরে আমন ফলনের বাম্পার হওয়ার কথা। ষড়যন্ত্রকারীরা এ সুযোগ তাকে দেয়নি। হঠাৎ করে রাতের অন্ধকারে হামলা করে দেশবাসীর কাছ থেকে তাকে শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। এর পর দেশ চলে যায় বাংলাদেশবিরোধী শক্তির হাতে। সৌভাগ্য আমাদের এই যে দীর্ঘ একুশ বছরের সংগ্রাম ও আন্দোলন শেষে ১৯৯৬ সালে তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। দ্রুতই ফিরে আসে মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনাভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ। সুদৃঢ় হাতে আটানব্বইয়ের মহাবন্যা মোকাবিলা করে তিনি দেশবাসীর গভীর আস্থা অর্জন করেন। একজন বন্যার্তকেও না খেয়ে মরতে দেননি। কিন্তু দেশ যখন স্থিতিশীল উন্নয়নের পথে ফের ২০০১ সালে ঘটে ছন্দপতন। আবার ষড়যন্ত্র। আবার স্বদেশ হাঁটতে থাকে ‘অদ্ভুত এক উটের পিঠে’ বাংলাদেশবিরোধী উল্টো পথে। এর পরের সংগ্রাম ও আন্দোলন, সামরিক হস্তক্ষেপ, জেল-জুলুমের কথা আমরা সবাই জানি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা ফিরে আসেন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে। এর পর আরও দুবার লাগাতার তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। সরকারের ধারাবাহিকতার সুযোগ পেয়ে তিনি স্বদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় নিরন্তর নয়া নয়া মাইলফলক যোগ করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক ছাড়পত্র পেয়ে গেছে বাংলাদেশ। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, এসডিজি পূরণের অভিপ্রায়, ২০৪১ সালে উন্নত বালাদেশ গড়ার লক্ষ্য নির্বাচন এবং জলবায়ু সহিষ্ণু উন্নত বাংলাদেশকে টেকসই করার জন্য বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ গ্রহণ করে তিনি আমাদের সুদূরের সমৃদ্ধ বাংলাদেশের এক সোনালি স্বপ্নের সাথে সংযুক্ত করে ফেলেছেন। এই স্বপ্নের অভিমুখে উন্নয়ন অভিযাত্রায় পুরো সমাজকে তিনি এখন সংগঠিত করছেন। সুশাসন দেওয়ার চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে অর্থনীতিকে যেসব সাফল্য অর্জন করেছেন সেসবের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য তিনিও তার বাবার মতো রাতদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আর সে কারণেই শত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও দ্রুত এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে নিয়ে এই গৌরবমাখা মার্চে আমরা গর্বিত হতেই পারি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদীপ্ত এই লড়াকু জাতির সামনে এখন অপার সম্ভাবনা হাতছানি। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সামাজিক শান্তি, রাজনৈতিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতা যে কোনো মূল্যে বজায় রাখতে হবে। সবাই মিলে হাতে হাত ধরে এগিয়ে যেতে পারলে আমাদের অন্তরের গহিনে থাকা অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য নিশ্চয় অর্জন করা সম্ভব হবে। সারা বিশ্ব অবাক দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ভঙ্গিটি অবলোকন করছে। এখন দরকার নিজেদের ওপর আস্থা রেখে জোর কদমে এগিয়ে যাওয়া।

লেখক: ড. আতিউর রহমান : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

পিবিএ/এফএস

আরও পড়ুন...