পিবিএ ডেস্ক: অনেকেই আছেন যারা সেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পেয়ে সুখে শান্তিতে বেঁচে আছেন। অনেকেই আবার ব্যর্থ হয়ে দুঃখকষ্টে দিন পার করছেন। অনেকেই আছেন এ দু’দলের মাঝামাঝি পর্যায়ে; এরা নিজ প্রচেষ্টা অনুযায়ী ফল পেয়েছেন। প্রশ্ন হল, কীভাবে সেই সাফল্য অর্জন সম্ভব? চলুন জেনে নিই, কীভাবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই সাফল্য অর্জিত হতে পারে—
{১} ঈমান এবং সৎ কর্ম, আলোচ্য সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে মৌলিক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ঈমান এবং সৎ কর্ম। আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা):
“মু’মিন হয়ে পুরুষ ও নারীর যে কেউ সৎ কর্ম করবে, তাকে আমি নিশ্চয়ই আনন্দময় জীবন দান করবো এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করবো।” [সূরা নাহল; ১৬:৯৭]
আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন আমাদেরকে জানিয়ে দিলেন যে, যদি কেউ (হউক সে পুরুষ অথবা নারী) ঈমান আনার সাথে সাথে সৎ কর্ম করে তাহলে তিনি তাকে ইহকাল এবং পরকাল উভয় জগতেই আনন্দময় জীবন আর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করবেন। উভয় জগতেই আনন্দময় জীবন আর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দানের উদ্দেশ্যটি খুবই স্পষ্ট এখানে। আর তা হল আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন এর প্রতি আন্তরিক, অকপট, অকৃত্রিম বিশ্বাস। এমন বিশ্বাস যা বিশ্বাস স্থাপনকারীকে সৎ কর্মশীল হতে উদ্বুদ্ধ করে, তাকে ইহকালে সরল সঠিক পথ দেখায় আর জান্নাতের পথে পরিচালিত করে। তিনি সকল কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে তাঁর স্রষ্টা প্রদত্ত বিধান ও দিকনির্দেশনা মেনে চলেন। জীবনে বিপদ-আপদ, সুখ-দুঃখ যা-ই আসুক না কেন, স্রষ্টা প্রদত্ত দিকনির্দেশনার অনুসরণ থেকে তিনি কখনই বিরত হন না। জীবনে যা-ই ঘটুক, সবকিছুকেই সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নিয়ে আল্লাহ্কে ধন্যবাদ দেন তিনি। আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন কর্তৃক নির্ধারিত সিদ্ধান্তের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন তাঁর মাধ্যে এমন এক চেতনার উন্মেষ ঘটায় যা তাকে আরো সৎকর্মশীল করে তোলে। তাঁর কৃতজ্ঞতা বোধ প্রতিদান প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। তিনি যতদূর সম্ভব চেষ্টা করেন বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট থেকে বেচে থাকার। তবে বিপদ যদি চলেই আসে, তিনি সহিষ্ণু হন। বিপদে ধৈর্য ধারন করে পরিস্থিতি সামাল দেন তিনি। বিপদ আসে তাঁর কাছে আশীর্বাদ হয়ে। তাকে বিপদে ধৈর্যশীল হতে শেখায়। এভাবেই ধৈর্যশীলতা ছোটখাটো বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্টের আড়ালে একজন মু’মিনের জীবনে কল্যাণ বয়ে আনে। ফলে আল্লাহ্র অনুগ্রহ আর তাঁর পক্ষ থেকে প্রতিদান পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সহীহ্ মুসলিমে প্রিয় নবীর (সা) একটি হাদীসে এমনটি বলা হয়েছে—
“মু’মিনের অবস্থা কতইনা চমৎকার! তার সব অবস্থাতেই কল্যাণ থাকে। এটি শুধু মু’মিনেরই বৈশিষ্ট্য যে, যখন সে আনন্দে থাকে, তখন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে এবং যখন সে কষ্টে থাকে, তখন সবর করে। আর এ উভয় অবস্থাই তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। [সহীহ্ মুসলিম; হাদীস নং-২৯৯৯]
প্রিয় নবী (সা) বলেছেন, একজন মু’মিনের জীবনে ভালমন্দ যাই ঘটুক না কেন, সর্বাবস্থায় সে তাঁর প্রতিটি কর্মের জন্য প্রতিদান পেয়ে থাকে যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
{২} দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ইত্যাদি থেকে মুক্তির আরেকটি উপায় হল মানুষের প্রতি সদয় আচরণ করা। ব্যক্তি জীবনে অনৈতিক হয়েও কেউ মানুষের সাথে সদয় আচরণ করতে পারে। একজন ধর্মহীন নাস্তিক হয়েও মানুষের সাথে কথা ও কর্মে সদয় এবং ন্যায় নিষ্ঠ হতে পারে। কিন্তু একজন ঈমানদারের বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। তিনি অন্যের প্রতি সদয় আচরণ করেন আল্লাহ্র রাব্বুল ‘আলামীনের পক্ষ থেকে প্রতিদান পাওয়ার আশায়। আল্লাহ্র প্রতি তাঁর আন্তরিক বিশ্বাস তাকে মানুষের প্রতি সদয় হওয়ার শিক্ষা দেয়। আল্লাহ্র প্রতি তাঁর অকপট বিশ্বাস, আর প্রতিদান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাকে আরো বেশি সৎকর্মশীল করে তোলে। ফলে আল্লাহ্ তাঁর চলার পথকে সহজ করে দেন। আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা):
“তাদের অধিকাংশ গুপ্ত পরামর্শে কোন মঙ্গল নিহিত থাকে না, হ্যাঁ, তবে যে ব্যক্তি এরূপ যে দান অথবা কোন সৎ কাজ কিংবা লোকের মধ্যে পরস্পর সন্ধি করে দেবার উৎসাহ প্রদান করে এবং যে আল্লাহ্র প্রসন্নতা সন্ধানের জন্যে ঐরূপ করে, আমি তাকে মহান বিনিময় প্রদান করবো।” [সূরা আন-নিসা; ৪:১১৪]
উক্ত আয়াতে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন যে মহান বিনিময়ের কথা বলেছেন তারই একটা অংশ হল দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ইত্যাদি থেকে মুক্তি।
{৩} দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ইত্যাদির আরেকটি কারন হল স্নায়বিক উত্তেজনা এবং বিভিন্ন বিশৃঙ্খল ভাবনা যা সবসময় মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এর থেকে মুক্তির উপায় হল নিজেকে সবসময় ভাল কাজে ব্যস্ত রাখা বা কল্যাণকর জ্ঞান অর্জনে আত্মনিয়োগ করা। এতে করে মনের ভেতর কুচিন্তা আর ঠাঁই পাবেনা। ফলে ভাবনার জগতেও পরিবর্তন আসবে। দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা সৃষ্টিকারী ভাবনাগুলো মন থেকে বিদায় নেবে। মনে সুখ ফিরে আসবে। মনোবল দৃঢ় হবে। নিজেকে এমন কাজেই ব্যস্ত রাখা উচিৎ যে কাজ নিজের কাছে উপভোগ্য মনে হয়, যে কাজ করে আনন্দ পাওয়া যায়। তাহলেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আশা করা যায়। তবে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনই সবচেয়ে ভাল জানেন।
{৪} উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি থেকে রেহাই পাওয়ার আরো একটি পথ আছে। আর তা হল অতীতে কি হয়েছে বা কি হয়নি, ভবিষ্যতে কি হবে, এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে শুধু বর্তমান মুহূর্তগুলোকে কি করে অর্থপূর্ণ এবং সার্থক করে তোলা যায় তার প্রতি অধিক মনোযোগ দেয়া। আর এ কারণেই প্রিয় নবী (সা) আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের কাছে দোয়া করতেন যেন “অতীতে কি হয়েছে বা ভবিষ্যতে কি হবে” এধরনের ভাবনা বা দুশ্চিন্তা তাঁর মধ্যে সৃষ্টি না হয়। কারন অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ, দুইয়ের কোনটিই মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন বিষয় নয়। তাই এই মুহূর্তে কি করছি, ঠিক করছি না ভুল করছি, এটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এভাবে যদি বর্তমানকে নিয়ে ভাবা যায় তাহলে বর্তমানসহ ভবিষ্যতও সুন্দর হয়ে উঠবে। মনে দুশ্চিন্তাও আর ঠাঁই পাবেনা। প্রিয় নবী (সা) যখনই নিজে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের কাছে কোন বিষয়ে দোয়া করতেন কিংবা তাঁর সাহাবীদের (রা) কোন দোয়া শিক্ষা দিতেন তখন আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের অনুগ্রহ লাভের আশা করার পাশাপাশি তা অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার জোর তাগিদ দিতেন। দোয়া করার পাশাপাশি অবশ্যই সাফল্য অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। প্রত্যেকের উচিৎ এমন কিছু অর্জনের চেষ্টা করা যা ইহকাল এবং পরকাল, উভয় জগতের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে। আর এজন্য চেষ্টা করার পাশাপাশি আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের কাছে সাহায্য চেয়ে দোয়া করতে হবে। প্রিয় নবী (সা) বলেছেন—
“যা কল্যাণকর তাই অর্জনের চেষ্টা কর, এজন্য আল্লাহ্র কাছে সাহায্য চাও এবং নিরাশ হইয়োনা। যদি খারাপ কিছু ঘটে তাহলে এমনটি বোলোনা যে, যদি এমন এমন করতাম তো এমন এমন হতো। বরং তুমি বল যে, আল্লাহ্ যা নির্ধারণ করেছেন ও চেয়েছেন তাই করেছেন, কারণ যদি কথাটি শায়তানের কর্ম খুলে দেয়” [সহীহ্ মুসলিম]
প্রিয় নবী (সা) দেখিয়েছেন যে ভাল কিছু অর্জন করতে হলে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের সাহায্য এবং প্রচেষ্টা দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সাহায্য ছাড়া শুধু প্রচেষ্টা দিয়ে কোন কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়। আবার ব্যর্থতার ক্ষেত্রে নিরাশারও কোন অবকাশ নেই। অতীতে যা হওয়ার হয়ে গেছে এবং ভবিষ্যতে যা হবে তাও আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের অলঙ্ঘনীয় ইচ্ছা অনুযায়ী হবে। প্রিয় নবী (সা) যে কোন বিষয় সংঘটনের ক্ষেত্রে দুটি অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন—
(ক) প্রথম অবস্থাটি এরকম যে, হয়ত কেউ একটা কিছু অর্জনের জন্য চেষ্টা করছে অথবা কোন কিছু থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে হয়ত সে সফলও হচ্ছে। এক্ষেত্রে বুঝতে হবে যে প্রাপ্ত সাফল্য আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের সাহায্য ছাড়া সম্ভব হয়নি। এই ধরনের সম্ভাব্য সাফল্যের জন্য আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের কাছে অবশ্যই সাহায্য চাইতে হবে।
(খ) আবার কিছু বিষয় আছে যেগুলোর ক্ষেত্রে হাজার চেষ্টা চালিয়েও সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। সে সব ক্ষেত্রে মনের শান্তি বিনষ্ট না করে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে।
উক্ত বিষয়টিকে মনে রেখে জীবন যাপন করলে জীবনে কখনও অতৃপ্তি বা অপ্রাপ্তিবোধ আর পীড়া দেবে না। দুশ্চিন্তা কিংবা মানসিক অতৃপ্তিও আর থাকবে না।
{৫} মানসিক পরিতৃপ্তি এবং হৃদয়ের প্রশান্তি লাভের অন্যতম উপায় হল আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনকে স্মরণ করা। মহান প্রতিপালক আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন কে স্মরণের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি এবং আন্তরিক পরিতৃপ্তি অর্জিত হয়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন—
“নিশ্চয় আল্লাহ্র যিক্র-এ অন্তর প্রশান্ত হয়” [সূরা আল রা’দ; ১৩:২৮]
আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন এর স্মরণ (যিক্র করা) আমদের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে। তাঁকে স্মরণ করার মাধ্যমেও আমরা প্রতিদানের আশা করি যা আমাদেরকে আরো বেশী প্রতিদান লাভের বাসনাকে বাড়িয়ে দেয়।
{৬} উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি থেকে রেহাই পাওয়া এবং সুখি হওয়ার আরেকটি উপায় হলো দুশ্চিন্তার কারণগুলোকে দূর করার চেষ্টা করা এবং যা কিছু সুখ বয়ে আনে তা অর্জনের চেষ্টা করা। এক্ষেত্রে অতীতের পীড়াদায়ক ঘটনাগুলোকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখতে হবে অতীতকে ভেবে দুঃখ পাওয়া সময়ের অপচয় ছাড়া কিছুই নয়। তাই এসব বিষয়ে ভাবনা চিন্তা বাদ দেওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে কি হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে। ভবিষ্যৎ ভেবে উদ্বিগ্ন হওয়া একেবারেই অমূলক। কারন ভবিষ্যৎ হল অজ্ঞাত একটি বিষয়। ভবিষ্যতে ভাল হবে, না মন্দ হবে তা কেউই আগাম বলতে পারেনা। বিষয়টি সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞানী আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের হাতেই ন্যাস্ত। আমরা তাঁর বান্দা হিসেবে যা করতে পারি তা হল ভাল কিছুর জন্য চেষ্টা করা আর মন্দকে দূরে সরিয়ে রাখা। অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে যদি নিজ প্রতিপালকের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস এবং আস্থা রেখে অবস্থার উন্নয়নে চেষ্টা করা হয় তাহলে মনে প্রশান্তি বিরাজ করবে এবং উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি থেকেও পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার অন্যতম কার্যকর উপায় হল প্রিয় নবী (সা) এর নিম্নোক্ত দোয়াটি পাঠ করা। রাসূল (সা) ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা থেকে নিম্নোক্ত দোয়াটির মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’আলার কাছে সাহায্য চাইতেন—
“আল্লাহুম্মা আস্লিহ্লী দ্বীনী আল্লাযী হুয়া ‘ইস্মাতু আমরি, ওয়া আস্লিহ্লী দুন্ইয়া-ইয়া আল্লাতী ফীহা মা’আশি, ওয়া আস্লিহ্লী আ-খিরাতি আল্লাতী ইলাইহা মা’আদি, ওয়াজ’আল আল হায়াতা জিয়াদাতাল্লি ফী কুল্লি খাইর, ওয়াল মাউতা রাহাতাল্লি মিন কুল্লী শার্রি।”
অর্থঃ হে আল্লাহ্! তুমি আমার দ্বীনকে সংশোধন করে দাও যা আমার জীবনের ভিত্তি এবং আমার পার্থিব কাজকর্মকেও সংশোধন করে দাও যার মধ্যে রয়েছে আমার জীবিকা এবং আমাকে দাও সর্বোত্তম সমৃদ্ধি আখিরাতে যেখানে আমার প্রত্যাবর্তন। আমার জীবনকে পুণ্য অর্জনের মাধ্যম বানিয়ে দাও এবং আমার মৃত্যুকে কর সমস্ত মন্দ থেকে বেঁচে যাওয়ার অবকাশ। [সহীহ্ মুসলিম; হাদিস নং-২৭২০]
তিনি (সা) আরও বলতেন—
“আল্লাহুম্মা রাহ্মাতাকা আরজু ফালা তাকিলনি ইলা নাফসি তারফাতা ‘আইনিন ওয়া আসলিহ্লি শা’নি কুল্লাহু, লা ইলাহা ইল্লা আনতা।”
অর্থঃ হে আল্লাহ্! আমি তোমার করুণা কামনা করি। তাই এক মুহূর্তের জন্যেও তুমি আমাকে আমার নিজের উপর ছেড়ে দিওনা। এবং তুমি আমার সকল কাজকর্মকে সংশোধন করে দাও। তুমি ছাড়া সত্য এবং ইবাদাতের যোগ্য কোন ইলাহ্ নেই। [আবু দাউদ; হাদিস নং- ৫০৯০, ইসনাদ সহীহ্; আল আলবানী তাঁর সহীহ্ আল কালিম আল তইয়্যেব (পৃষ্ঠা- ৪৯) গ্রন্থে হাদিসটিকে হাসান বলে উল্লেখ করেছেন]
ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ অর্জনের জন্য যদি কোন ব্যক্তি উক্ত দোয়াগুলো খালেস নিয়্যতে ও আন্তরিকতার সাথে পাঠ করে এবং সাথে সাথে কল্যাণ অর্জনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন তাকে সফলতা দান করবেন, তার চাওয়া পাওয়া এবং আশা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করে দেবেন, তার দুশ্চিন্তাকে হৃদয়ের প্রশান্তি দিয়ে বদলে দেবেন।
{৭} বিপদে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হলে তা থেকে উত্তরণে উপায় হল পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হলে কি হত, তা একবার কল্পনা করা এবং বর্তমান পরিস্থিতিকে মেনে নেয়ার চেষ্টা করা। এরপর যতদূর সম্ভব দুশ্চিন্তা দূর করার চেষ্টা করা। প্রথমত, বিপদকে মেনে নিয়ে দুশ্চিন্তা দূর করার চেষ্টা করলে দুশ্চিন্তা অনেকখানি কমে যাবে। এরপর বেশি দুশ্চিন্তা না করে কিভাবে পরিস্থিতি সামালে নিয়ে ভাল কিছু করা যায় তার চেষ্টা করতে হবে। যদি কেউ ভয়, ক্ষুধা কিংবা দারিদ্রের মুখোমুখি হয় তাহলে সে ক্ষেত্রেও তা মেনে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে এই ভেবে যে, পরিস্থিতি এর চেয়েও ভয়াবহ হতে পারত। এভাবে মেনে নেয়ার ফলে দুশ্চিন্তা অনেকখানি কমে যাবে। ভাল কিছু অর্জনের চেষ্টা করতে থাকলে মনের উদ্বেগ দূর হওয়ার পাশাপাশি বিপদে ধৈর্য ধারনের ক্ষমতা বাড়বে এবং আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা আরো দৃঢ় হয়ে উঠবে। মনের প্রশান্তি এবং সুখ লাভের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা ইহকাল এবং পরকালে প্রতিদান প্রাপ্তির আশাকে বাঁচিয়ে রাখে। বহু মানুষ উক্ত বিষয়গুলো অনুসরণের মাধ্যমে সফলতা লাভ করেছে।
{৮} মনের অবিচলতা, মানসিক দৃঢ়তা এবং খারাপ চিন্তার দ্বারা বিচলিত না হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ। কঠিন কোন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা, জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা ইত্যাদি বিভিন্ন অমূলক চিন্তা মাথায় আসতে পারে। কিন্তু ওসব চিন্তার কাছে হার মানলে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় জীবন ভরে যাবে যা মানসিক ও শারীরিক উভয় স্বাস্থ্যকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করবে। মানসিক বিপর্যয় ঘটবে। এমন অনেক লোকই দেখা যায় যারা এধরনের সমস্যায় আক্রান্ত। কিন্তু যখন একজন মানুষ আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের উপর নির্ভর করে, তাঁর উপর বিশ্বাস রাখে, অমূলক ভাবানায় পড়ে বিচলিত না হয়, আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের উপরই আস্থা রাখে এবং তাঁর অনুগ্রহ লাভের আশায় আশান্বিত থাকে তখন তার মনে কোন দুঃশিন্তা বা উদ্বেগ থাকেনা। ফলে সে শারীরিক এবং মানসিক উভয় প্রকার অসুস্থতা থেকে রক্ষা পাই। ফলে হৃদয় খুঁজে পাই এক অকৃত্রিম সুখ আর ভাল লাগা। বেশিরভাগ হাসপাতালগুলোই আজ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মানসিক রোগীদের দ্বারা ভরে আছে। কত সহজেই দুশ্চিন্তা অনেক শক্ত মনের মানুষদেরকেও কাবু করে ফেলে। দুর্বল মনের যারা তাদের কথা তো আলাদাই। কত সহজেই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর দুশ্চিন্তা মানুষকে পাগল বানিয়ে ছাড়ে!!
লক্ষ্যনীয় যে, আপনার জীবনের গতিপথ আপনার চিন্তাভাবনাকে অনুসরণ করেই এগিয়ে যাই। যদি এমন কিছু নিয়ে ভাবেন যা আপনার ইহকালীন এবং পরকালীন উভয় জগতেই আপনার জন্য কল্যাণকর, তাহলে আপনার জীবন সুখী সুন্দর হবে। তা না হলে ফলাফল হবে উল্টো। যে ব্যক্তি উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি থেকে নিরাপদে আছেন তিনি আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের দয়ায় সুরক্ষা লাভ করেছেন এবং আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন অনুগ্রহ করে তার হৃদয়কে শক্তিশালী করেছেন যাতে দুশ্চিন্তা তার হৃদয়কে গ্রাস করতে না পারে। আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা):
“যে ব্যক্তি আল্লাহ্র উপর নির্ভর করে তার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট” [সূরা আল তালাক; ৫৬:৩]
অর্থাৎ, সেইব্যক্তির পার্থিব এবং আধ্যাত্মিক সকল বিষয়ে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন যথেষ্ট। যে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের প্রতি পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস স্থাপন করবে তার মনোবল বেড়ে যাবে। ফলে অমূলক ভাবনা চিন্তা তাকে বিচলিত করতে পারবেনা। মনে বিভিন্ন দুশ্চিন্তা আসাটা মানুষের প্রকৃতিগত একটি ব্যাপার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। তবে যারা আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের উপর নির্ভর করবে তিনি তাদের জন্য যথেষ্ট হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাই বিশ্বাসী ব্যক্তি সবসময় আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের উপর আস্থা রাখেন, তাঁর পক্ষ থেকে প্রতিদান পাওয়ার আশা করেন। ফলে হৃদয় প্রশান্ত হয়; উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি দূরীভূত হয়; কঠিন সহজ হয়ে যায়; নিরানন্দ হয়ে ওঠে আনন্দময়; অশান্তি পরিণত হয় প্রশান্তিতে। আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন যেন আমাদেরকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখেন; তিনি যেন আমাদেরকে অন্তরের দৃঢ়তা এবং মনের অবিচলতা দান করেন; আমরা যেন পরিপূর্ণভাবে তাকে বিশ্বাস করতে পারি; কারন, আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাদের জন্যই উত্তম বিনিময় এবং দুশ্চিন্তাহীন জীবনের ঘোষণা দিয়েছেন যারা তাঁকে পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করবে এবং তাঁর উপরই ভরসা করবে।
যদি খারাপ কিছু ঘটেই যাই কিংবা তেমন কিছু ঘটবার প্রবল আশ্ংকা দেখা দেয়, তাহলে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের যে অসংখ্য নেয়ামাত আপনি ভোগ করছেন সেগুলোর কথা একবার ভাবুন। তাঁর অসংখ্য নেয়ামতের কথা ভাবলে বর্তমানের বিপদকে আর বিপদই মনে হবেনা।
দেখুন শাইখ আব্দুর রাহমান ইবনু সা’দী এর আল ওয়াসা’ইল মুফীদালিল হায়াত আসসাই’দাহ্।
ইব্নু আল কাইয়্যুম (র.) দুশ্চিন্তা এবং মানসিক অশান্তি দূর করার জন্য সংক্ষেপে ১৫টি উপায় তুলে ধরেছেন। উপায়গুলো হলো—
[১] তাওহীদ আর-রবূবিয়্যাহ্ অর্থাৎ, কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও প্রতিপালেনের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এক ও একক সত্ত্বা—বলে বিশ্বাস করা।
[২] তাওহীদ আল-উলূহিয়্যাহ অর্থাৎ, যাবতীয় ‘ইবাদাহ্ ও আনুগত্য পাওয়ার যোগ্য একমাত্র আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন—বলে বিশ্বাস করা।
[৩] তাওহীদ আল-আসমা ওয়াস-সিফাত অর্থাৎ, আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন তাঁর নামসমূহ এবং তাঁর গুণাবলীতে একক ও অদ্বিতীয়—বলে বিশ্বাস করা।
[৪] এই বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীণ তাঁর কোন বান্দার প্রতি কখনই জুলুম করেন না। তিনি বিনা কারনে কখনই কাউকে শাস্তি দেন না।
[৫] এটা স্বীকার করে নেয়া যে, দোষী আপনিই, আপনিই ভুল করেছেন, অপরাধ আপনারই।
[৬] আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের গুণবাচক নামসমূহের মাধ্যমে তাঁর কাছে চাওয়া। তাঁর গুণবাচক নামসমূহের মধ্যে থেকে দুইটি নাম হল “আল-হাই (চিরঞ্জীব)” এবং “আল ক্বইয়্যূম (চিরস্থায়ী)”। এই নাম দুটি তাঁর অন্যান্য গুণবাচক নামসমূহের গুণগুলোকে ধারন করে আছে।
[৭] কেবলমাত্র আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের কাছেই সাহায্য চাওয়া।
[৮] তার সাহায্য লাভের ব্যপারে সুনিশ্চিতভাবে আশা করা।
[৯] পরিপূর্ণভাবে তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং একথা মেনে নিয়ে সবকিছুকেই তাঁর প্রতি সমর্পণ করা যে, আমাদের জীবন মৃত্যু তাঁরই হাতে, তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই হয়, তাঁর প্রতিটি ইচ্ছাই অনিবার্যভাবে পূরণীয় এবং কোন কিছুই তাঁর ইচ্ছা ছাড়া সংঘটিত হয়না।
[১০] কোরাআনের আলোই উদ্ভাসিত হওয়া। বিপদের সময় কোরআন থেকে সান্তনা খোঁজা। অন্তরের রোগব্যাধি দূর করতে কোরআনকেই নিরাময় (শিফা) হিসেবে গ্রহন করা। যাতে করে কোরআন মনের দুঃখ-কষ্ট, আবেগ-উৎকণ্ঠা দূর করে প্রশান্তি বয়ে আনে।
[১১] ক্ষমা প্রার্থনা করা।
[১২] কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া।
[১৩] আল্লাহ্র দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার জন্য সকল প্রকার সংগ্রাম ও প্রচেষ্টা চালানো। প্রয়োজনে জীবন দিতে প্রস্তুত থাকা।
[১৪] সালাত প্রতিষ্ঠা করা।
[১৫] এই ঘোষণা দেয়া যে, আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন ছাড়া অন্য কারোর কোন শক্তি বা ক্ষমতা নেই। এবং সমস্ত বিষয়কেই তাঁর হাতেই ন্যাস্ত করা।
আমরা আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে সবরকম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, বালা-মুসিবত থেকে হেফাজাত করেন। তিনি সর্বশ্রোতা, তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী। তিনি সর্বদা আমাদের ডাকে সাড়া দেন। তিনি সর্বজ্ঞানী।
লেখক : শাইখ মুহাম্মাদ সালিহ্ আল-মুনাজ্জিদ ।
পিবিএ/এফএস