পাচারে দেশের অর্থনীতি ‘ফোকলা’ হয়ে গেছে: মির্জা ফখরুল

বর্তমান সরকার শুধু রাজনীতি নয়, দেশের অর্থনীতিও পুরোপুরি ধ্বংস করেছে, এই মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, সরকারের ব্যাংকিং খাতে চরম অব্যবস্থাপনা, লাগামহীন দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে দেশের অর্থনীতি ‘ফোকলা’ হয়ে গেছে।

বিএনপির মহাসচিব আজ এক সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন, ‘বিভিন্ন পত্রিকা ও অন্যান্য নির্ভরযোগ্য সূত্র মারফত আমাদের জানামতে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের গতকাল (১২ অক্টোবর) পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে, একেবারে লুট।’

শুক্রবার বেলা ১১টায় গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের টানা শাসনে ‘ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়াসহ আর্থিক খাতে চরম অব্যবস্থাপনার’ অভিযোগে এ সংবাদ সম্মেলন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই অবৈধ সরকার শুধু রাজনীতি নয়, অর্থনীতিও পুরোপুরি ধ্বংস করেছে এবং তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে; প্রতারণা করছে জনগণের সঙ্গে। শুধু জনগণ নয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গেও তারা (সরকার) প্রতারণা করছে। এমন একটা ন্যারেটিভ খাড়া করেছে যে বাংলাদেশ রোল মডেল হয়ে গেছে থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিগুলোর ডেভেলপমেন্টের জন্য।’

এমন বক্তব্যের পেছনে যুক্তি দিতে গিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এটা আমার কথা নয়, অর্থনীতিবিষয়ক যেসব সংস্থাগুলো আছে; যারা রিসার্চ করে, পড়াশোনা করে তারা বলছে—এটা পুরোপুরিভাবে হলফ, ফাঁপা একটা বিষয়। জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে।’

দেশে কোনো বিনিয়োগ নেই বলে অভিযোগ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘এখানে এই লোকগুলোর (ক্ষমতাসীনদের) কোনো নতুন বিনিয়োগ নেই, কোনো নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। যার ফলে দারিদ্র্য দারিদ্র্যই থেকে যাচ্ছে এবং মানুষের আয়ের বৈষম্যটা দিনে দিনে বাড়ছে। যার ফলে সিপিডি বলেছে, এখানে দুইটা সোসাইটি (শ্রেণি) তৈরি হয়ে গেছে…একটা হচ্ছে খুবই বড়লোক শ্রেণি যারা বিদেশে যায়, পোশাক-আশাক… দামি গাড়ি বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ—এগুলোতে চড়ছে। অন্যদিকে এই গুলশানেই দেখবেন সিগন্যালগুলোতে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে অসংখ্য মানুষ। তারা তাদের প্রতিদিনের খাবার সংগ্রহ করতে পারে না। এটাই বাস্তবতা।’

মির্জা ফখরুল বলেন, আর্থিক খাতসহ দেশে আইনের শাসন ও সার্বিক শৃঙ্খলার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে জবাবদিহিতা। যেহেতু বর্তমান ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহি নেই; তাদের হাতে এ দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, বিচারব্যবস্থা কিছুই নিরাপদ নয়।

মির্জা ফখরুল বলেন, ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণেই দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। মূলত সরকারের পলিসি (নীতি) বা রাজনৈতিক দুর্বলতা এবং ব্যক্তিস্বার্থ বা সর্বগ্রাসী লুটপাট অর্থনীতির জীবনীশক্তি ক্রমেই ধ্বংস করে দিচ্ছে।

ব্যাংক খাতে ঋণ কেলেঙ্কারির উদাহরণ তুলে ধরে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটেছে ইসলামী ব্যাংকে। একটি শিল্প গ্রুপ নামে-বেনামে অস্তিত্বহীন ভুয়া কোম্পানির নামে কেবল ইসলামী ব্যাংক থেকেই ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। অথচ গ্রুপটি সর্বোচ্চ ২১৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার যোগ্য। গ্রুপটি ন্যূনতম এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে।’

বিএনপির এই নেতা বলেন, বাংলাদেশের একজন অর্থনীতিবিদ মন্তব্য করেছেন যে যোগাযোগ ও ক্ষমতা থাকলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা লুটপাট এখন সবচেয়ে সহজ। দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে যাঁরা বিদেশে বিপুল বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়েছেন, একজন অর্থনীতিবিদ তাঁদেরকে জাতীয় দুশমন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁরা ব্যাংকিং সিস্টেমের অপব্যবহার করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছেন। তাঁরা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছেন। তাঁরা রাজনীতিবিদ পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, গত বছরের জুলাইয়ে দেশের ব্যাংকগুলোয় পণ্য আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছিল ৬ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন বা ৬৩৫ কোটি ডলারের। কিন্তু চলতি বছরের জুলাইয়ে ব্যাংকগুলো মাত্র ৪৩৭ কোটি ডলারের নতুন এলসি খুলতে পেরেছে। এ হিসাবে অর্থবছরের প্রথম মাসে ব্যাংকগুলোয় আমদানি এলসি খোলা কমেছে ৩১ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ দেশের অর্থনীতি এখন নজিরবিহীন মন্থরগতিতে চলছে।

সরকার ও তাদের অবৈধ সুবিধাভোগীরা দেশকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে বলে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল অর্থসম্পদ বিদেশে পাচার করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যমতে, আমদানি ও রপ্তানি পণ্যমূল্যের মিসইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কর ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এভাবে প্রতিবছর গড়ে ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছে বাংলাদেশ। এভাবে ৯ বছরেই দেশ থেকে ৭৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে।’

বিএনপি মহাসচিব উল্লেখ করেন, জিএফআই ২০১৫ সালে বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর সরকারের সিআইডির বরাতে দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়, শুধু হুন্ডির প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে গড়ে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘হুন্ডির সঙ্গে ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যায়, প্রতিবছর বর্তমানে কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হচ্ছে। এই অর্থ পাচারের বিপুল স্রোত বন্ধ করতে পারলে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি কমপক্ষে ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেত।’

রপ্তানির আড়ালে সম্প্রতি ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার এবং ইডিএফের আড়ালে ৭০০ কোটি ডলারের দুর্নীতির অভিযোগ, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, তার তথ্যাদি তুলে ধরেন বিএনপির মহাসচিব।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিগ থ্রি’ হিসেবে পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী তিনটি রেটিং এজেন্সি বাংলাদেশের ঋণমান যেভাবে হ্রাস করেছে, নেতিবাচক সংকেত দিয়েছে, তাতে অর্থনীতি উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে এসেছে। গত মে মাসে বৈশ্বিক রেটিং এজেন্সি মুডিস বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং বিএ ৩ থেকে নামিয়ে বি ১-এ পুনর্নির্ধারণ করেছে। যেখানে প্রতিটি দেশ ক্রমান্বয়ে ভালো রেটিং পাওয়ার চেষ্টা করে থাকে, সেখানে গত এক যুগ পর এই মান কমানো দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত।

ব্যাংকে নজিরবিহীন তারল্য-সংকটের চিত্র তুলে ধরে বিএনপির মহাসচিব বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে তারল্য-সংকটে পড়ে দেশের অনেক ব্যাংক ধার করে চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য কমে ৩ হাজার ৯০৯ কোটি টাকায় নেমেছে। এক বছর আগেও যা ২ লাখ ৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা ছিল।

তারল্য-সংকটের কারণে ‘মূলধন ঘাটতি’ ও ‘আমানতকারীরা ঝুঁকি’র মধ্যে আছে বলেও মন্তব্য করেন ফখরুল।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান রবকতউল্লা বুলু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির ও নির্বাহী কমিটির সদস্য নাজিম উদ্দিন আলম উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়ুন...