‘স্বামীকে ডাকাডাকি করছি কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নাই’ : নেপালে বিমান বিধ্বস্তের লোমহর্ষক বর্ণনা হাসির

মাসুদ রানা, পিবিএ, টাঙ্গাইল : রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ইমরানা কবির হাসী তার স্বামী সফটওয়্যার প্রকৌশলী রকিবুল হাসান গতবছর ১২ মার্চ ঢাকা থেকে নেপাল সাত দিনের ট্যুরে যাওয়ার সময় বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস বাংলার একটি বিমান নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের রানওয়েতে বিধ্বস্ত হয়ে তার স্বামী সফটওয়্যার প্রকৌশলী রকিবুল হাসান নিহত হয়। ওই ঘটনায় ৩২জন বাংলাদেশী, ৩৩জন নেপালী, একজন চীন এবং একজন মালয়েশিয়ার নাগরিক নিহত হয়।

ওই বিমান দূর্ঘটনায় মৃত্যুপুরী থেকে ফিরে আসেন ইমরানা কবির হাসী। প্রায় ১১ মাস চিকিৎসা শেষে টাঙ্গাইলে বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি। নেপালে ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনায় পাল্টে দিয়েছে তার জীবনের সব কিছুই। জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার স্বামীকে হারিয়ে এখন শুধুই দুঃস্বপ্ন আর কান্না ছাড়া কিছুই নেই তার কাছে।

 

পিবিএ’র টাঙ্গাইল প্রতিনিধির কাছে ওই দিনের বিমান দূর্ঘটনার অভিজ্ঞতা বর্ননা করে ইমরানা কবির হাসী বলেন, স্বামীকে নিয়ে গত ১২ মার্চ ঢাকা থেকে নেপাল সাত দিনের ট্যুরে যাচ্ছিলাম। আনন্দ আর হাসিখুশিতে ছিলো আমাদের বিমান যাত্রাপথ। বিমানের জানালা দিয়ে পাহাড় দেখে মনে করলাম আমরা নেপাল পৌছে গেছি। জানালা দিয়ে কিছু ছবি তোলার চেষ্ঠা করছিলাম আমরা। ওই সময় মনে হলো বিমানটি অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। এর পরেই হঠাৎ করে অসহনীয় একটা ঝাকি অনুভব করলাম। যতটুকু বুঝতে পারলাম বিমানটি সঠিক ভাবে অবতরণ করতে পারেনি। বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে।

বিমান
ইমরানা কবির হাসি

তখন আসলে কি হচ্ছে বা কি হলো তাও কিছু মনে নেই। যখন আমি তাকালাম তখন দেখলাম আমার স্বামী বিমানের সীটসহ পড়ে গেছে। ওর উপর সীট। ও কোনো কথা বলছে না। নড়া চড়াও করছে না। আমার সীটটিও পিছন দিকে হেলে গেছে। তখনো তেমন কিছু বুঝতে পারি নাই। ওঠার চেষ্ঠা করলে আমার ডান পাশে পচন্ড ব্যাথা অনুভব করছিলাম। আমার ডান হাত নাড়াতে পারছিলাম না। তখন ভাবলাম হয়তো আমার হাত ভেঙে গেছে। স্বামীকে ডাকাডাকি করছিলাম। কিন্তু তার কোন সাড়া শব্দ আমি পাচ্ছিলাম না। আর তখন পর্যন্ত আগুন আমাদের পর্যন্ত আসে নাই। ভালো ভাবে দেখলাম বিমানটি ভাগ হয়ে গেছে। সেখান দিয়ে কয়েকজন বের হয়ে যাচেছ। আমি আমার সীট বেল্টটি অনেক খুলার চেষ্ঠা করলাম কিন্তু কোনো ভাবেই খুলতে পারলাম না।

ইমরানা কবির হাসী বলেন, আর ওই সময় যেটা হচ্ছিল যে কেউ কারো কোন সহযোগীতা করতে পারছিলো না। আমার মনে হলো বিমান বিধ্বস্ত হলে তো আর কেউ বাঁচে না। আমি হয়তো মারা যাচ্ছি। কালেমা পড়ে মারা যাই। তাই আমি কালেমা পড়ছিলাম। তখন আমার সামনে একজন মহিলা ছিলেন। তিনিও কালেমা পড়ছিলেন। আমার সামনের মহিলার উদ্দেশ্যে বলছি, আমি তো মারা যাচ্ছি, আমি জানি না সে বাঁচবে কিনা। তাকে বললাম আমি আমার বাবা-মাকে অনেক ভালোবাসি।

বিমান
ইমরানা কবির হাসি

তিনি বলেন, তখন বুঝতে পারছিলাম আমি মারা যাবো। কারন আমার পিছন থেকে আগুন আমার দিকে আসছে। বিমানে তখন ভয়াবহ আগুন ছিলো। আমি দেখছি বিমানের উপরের দিকে অস্বাভাবিক আগুন, নিচের দিকে কোন আগুন নেই। আমি তখন দেখছি বিমানে যারা ছিলো তারা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। আগুনের চুলায় যখন কোন কিছু দেওয়া হয় ঠিক যেভাবে জ্বলে ঠিক তেমন আমার দুই হাত আগুনে জ্বলছিলো। পিঠের সাইট, মাথার চুল সব পুড়ছিলো আমি তা ভালো করেই বুঝতে পারছিলাম কিন্তু কিছু করার মত কোন ক্ষমতা ছিলো না। সামনেই আমার স্বামীকে অনেক ডাকাডাকি করছি কিন্তু সেও কোন কথা বলছে না। আমার সামনে যারা আছে তারা আগুনে পুড়ছে আমিও আগুনে পুড়ছি কিন্তু কোন কিছুই করতে পারছি না। আমি নিরুপায়। আগুন এতোটাই ভয়াবহ ছিলো যে বলে বুঝাতে পারবো না। ওই বিমানের যারা যাত্রী ছিলো ঠিক তারাই বলতে পারবে আগুনের ভয়াবহতা কি ছিলো।

তিনি বলেন, সে সময় আমার দুই হাত, মাথা ও শরীরে পিছনের অংশ পুড়ে গেছে। শুধু অড়না দিয়ে মুখ ডেকে ছিলাম। সেখানে আগুনের সাথে প্রচন্ড ধোয়াও ছিলো। নিশ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। কতক্ষন এভাবে আগুনে পুড়ছিলাম জানি না। শুধু কালেমা পড়ছিলাম। অনেকক্ষন পর পানি জাতীয় কিছু আমার শরীলে এসে পড়লো। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। আগুন তখনো নিভে নাই। আবারো শরীলে আগুন লেগে গেলো। এরপর সাবানের ফেনার মত আবার কিছু পড়লো। তখন আগুন নিভে গেলো।

আগুন নেভানোর পর যখন দেখলাম কয়েকজন এগিয়ে আসছে আমার দিকে। সেনাবাহিনী কিংবা ফায়ার সার্ভিসের লোক হবে। আমার সামনের ওই মহিলা শুধু বলছিলাম সেভ মি, সেভ মি। তখন উদ্ধারকারীরা আমাদের কাছে আসে এবং সামনের মহিলাকে আগে উদ্ধার করে এবং পরে আমার কাছে আসে। স্বামীকে উদ্ধার করেন। ওকে উঠান। আমার অবস্থা তখন খুবই খারাপ ছিলো। আমি ভালো করে তাকাতেও পারছিলাম না। পরে বুঝতে পারলাম আমাকে এম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে। আমার পানি পিপাসা পেয়েছে আমাকে কেউ একটু পানি দেন। আমি পানি খেয়ে মারা যেতে চাই।

এতটুকুই মনে আছে আমি হাসপাতালের টলিতে। একটি রুমে নেওয়া হলো আর পর্দা টেনে দেওয়া হলো। এরপর কিছু জানি না। এরপর আর কিছুই বলতে পারবো না। এ ঘটনার ৯দিন পর জ্ঞান ফিরে। এর মধ্যে নেপালে ৬দিন আর সিংঙ্গাপুরে ৩দিন কিভাবে কেটেছে আমি বলতে পারবো না।

তিনি আরো বলেন, সেই সব কথা পরে বাবার কাছ থেকে শুনতে পারি। জ্ঞান ফেরার পর ডাক্তার নাম জিজ্ঞাসা করেন। তাকে আমার নাম বলি। ৯ দিনের কথা ছাড়া সব কথা মনে আছে। এরপর একের পর এক অপারেশন, ড্রেসিংতো আছেই। একদিন পর পর দুই-তিন ঘন্টা ড্রেসিং ছিলো খুবই ভয়াবহ। পরে আমার স্বামীর কথা জানতে চাইলে বাবা বলেন নেপালে আছে। আমি আমার স্বামীর কাছে যেতে চাইলে আমাকে কেউ নিয়ে যায়নি। পরে অবশ্য বাবা আমাকে বলতে বাধ্য হয়েছে আমার স্বামী বেঁচে নেই।

ইমরানা কবির হাসী বলেন, সবচেয়ে বড় দু:স্বপ্ন ছিলো আইসিইউতে চিকিৎসা নেওয়া অবস্থায়ও আমার চোখে আগুন ভাসতো। মনে হতো আগুন লেগে গেছে। আমি অনেক ভয় পেতাম। আমি ডাক্তার ও সিস্টারদের বললাম। পরে আড়াই মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর দেশে ফিরি এবং ঢাকা সিটি হসপিটালে ৮মাস ৮দিন চিকিৎসা নিয়ে ১১ মাস পর বাবার কাছে ফিরে আসি। তবে এখনো আমার অনেক চিকিৎসা বাকী।

পুরোপুরি সুস্থ্য হতে আরো অনেক সময় লাগবে। শারিরীক ট্রিটমেন্ট সবাই করতে পারে, কিন্তু মানসিক ট্রিটমেন্ট কেউ করতে পারে না। আমি চাই পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পূণরায় দায়িত্ব পালন করতে। আর সেখানে সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের সাথে থেকে শারিরীক ও মানসিক দুদিক থেকে সুস্থ্য থাকতে।

হাসির বাবা হুমায়ন কবির বলেন, এত বড় দুর্ঘটনার পর আল্লাহর রহমতে আমার মেয়ে ফিরে আসবে, আমি কখনও কল্পনাও করি নাই। ইউএস বাংলা হাসির চিকিৎসার দায়বার নেওয়ায় আমি তার চিকিৎসা করে সুস্থ করতে পেরেছি। এমন দুর্ঘটনা পৃথিবীতে আর যে না হয় সেই কামনা করছি। নেপাল ও সিঙ্গাপুরে হাসির কাছে বসে বসে কান্না করেছি ও দোয়া প্রার্থনা করেছি এমন বিপদ যেন আর কারো না হয়। হাসির এক জায়গার চামড়া কেটে আরেক জায়গায় লাগানো হয়েছে। সে ব্যাথায় অনেক কান্না করেছে। এতো কষ্টের পরও হাসি বেচে থাকায় আল্লাহ তালার কাছে শুকরিয়া কামনা করি।

উল্লেখ্য, টাঙ্গাইলের পৌর এলাকার ২নং ওয়ার্ডের এনায়েতপুর দক্ষিন পাড়ায় সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা হুমায়ূন কবিরের মেয়ে ইমরানা কবির হাসি। তিনি রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

আরও পড়ুন...