জুমার দিনের মর্যাদা ও করণীয়

juma-mobarok-PBA

পিবিএ ডেস্ক: আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকুলের মাঝে যা ইচ্ছা তাই মনোনীত করেন। সৃষ্টি ও নির্বাচনে তাঁর রয়েছে পূর্ণ প্রজ্ঞা। তাই সব প্রশংসা তাঁরই। আল্লাহর মনোনীত ও নির্বাচিত বিষয়কে মর্যাদা প্রদান করার অর্থই হলো আল্লাহকে সম্মান প্রদর্শন করা। বান্দার জীবনের পুরো সময় তার রবের দিকেই যুক্ত। ক্ষুদ্র এ সময়ে বান্দা আখেরাতের পাথেয় সঞ্চয় করে। সংক্ষিপ্ত এ জীবনে বান্দা যেসব কল্যাণের মাধ্যমে তাঁর আমলনামাকে ভারী করে, সেটি হলো অতিরিক্ত সময়ে কৃত আল্লাহর ইবাদত। আল্লাহ এমন একটি দিন বাছাই করেছেন, যাকে কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। একমাত্র এ দিনের নামে একটি সূরার নামকরণও করেছেন। পুরো সপ্তাহে যে দিবসের মতো আর কোনো দিবস নেই। সম্মান ও মর্যাদায় পূর্ণ একটি দিন এটি। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে উত্তম দিনটির ওপর সূর্য উদিত হয়, সেটি জুমার দিন।’ (মুসলিম)।

আল্লাহ এ নামে শপথ করে বলেন, ‘এবং (শপথ) সেই দিবসের, যে উপস্থিত হয় ও যাতে উপস্থিত হয়।’ (সূরা বুরুজ : ৩)। আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘শাহিদ অর্থ জুমার দিন আর মাশহুদ অর্থ আরাফার দিন।’ এ জুমার দিনে মহাজগৎ-সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি রয়েছে। এ দিনে আল্লাহ আসমান-জমিন সৃষ্টির পূর্ণতা বিধান করেছেন। আল্লাহর এরশাদ, ‘তোমাদের রব তিনি, যিনি আসমান ও জমিনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আরাফ : ৫৪)। ইবনে কাসির (রহ.) (এ আয়াতের তাফসিরে) বলেন, ‘এই দিনে অর্থাৎ জুমার দিনে সব সৃষ্টি একত্রিত হয়েছে।’

এ দিনে আদম (আ.) ও তার সন্তান-সন্ততিদের জন্য মর্যাদার কথা উল্লেখ রয়েছে। এ দিনের রয়েছে স্মরণীয় ঘটনাবলি। রাসুল (সা.) বলেন, ‘এ দিন আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ দিনেই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং জান্নাত থেকে তাকে বের করা হয়েছে।’ (মুসলিম)।

এর আরেকটি ফজিলত, এ দিনে আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন। ইহুদি এক ব্যক্তি ওমর (রা.) কে বলল, হে আমিরুল মোমিনিন! আপনাদের কিতাবে একটি আয়াত আছে, যা পাঠ করেন। যদি তা আমাদের ইহুদি সম্প্রদায়ের ওপর অবতীর্ণ হতো; তাহলে তাকে আমরা ঈদের দিন হিসেবে গণ্য করতাম। তিনি বললেন, সেটি কোন আয়াত? সে বলল, (আল্লাহর এরশাদ) ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।’ (সূরা মায়িদা : ৩)। ওমর (রা.) বললেন, ‘এটি নাজিল হওয়া দিনের কথা আমি জানি। যে স্থানে এটি অবতীর্ণ হয়েছে, সেটিও আমি জানি। এটি জুমার দিন রাসুল (সা.) এর ওপর আরাফার ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

দিনটি শুধু এ উম্মতকে বিশেষভাবে দেওয়া হয়েছে। এর জন্য আমাদের পথপ্রদর্শন করেছেন এবং অন্যদের ভ্রান্ত করেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমরা সর্বশেষ উম্মত এবং কেয়ামতে আমরা অগ্রগামী দল। তবে তাদেরকে আমাদের আগে কিতাব দেওয়া হয়েছে। অতঃপর এটি (জুমার দিন) এমন একটি দিন, যা তাদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল; কিন্তু তারা এতে মতানৈক্যে লিপ্ত হলো। তারপর আল্লাহ আমাদের হেদায়েত দান করলেন। এ দিনের ক্ষেত্রে মানুষজন আমাদের অধীনে। ইহুদিরা আগামীকাল (শনিবার) আর খ্রিষ্টানরা তার পরদিন (রোববার)।’ (বোখারি)।

জুমার দিনে মর্যাদা বৃদ্ধি ও গোনাহ মাফ হওয়ার ঘোষণা রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং এক জুমা থেকে অন্য জুমা মাঝের সব গোনাহকে মাফ করে দেয়; যতক্ষণ পর্যন্ত সে কবিরা গোনাহে লিপ্ত না হয়।’ (মুসলিম)।
আল্লাহ তাঁর কল্যাণের দরজা খুলে বান্দার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। সে দরজা থেকে বান্দার দোয়া কখনও ফেরত দেওয়া হয় না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই জুমার দিন এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে, সে সময়টিতে একজন মুসলমান যে কল্যাণের দোয়া করবে, অবশ্যই আল্লাহ তাকে তা দান করবেন।’ (মুসলিম)। আর এটি আসরের একেবারে শেষ সময়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা আসরের পরে একবারে শেষ সময়ে দোয়া কর।’ (আবু দাউদ)। ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন, ‘অধিকাংশ হাদিস জুমার দিন আসরের পরে দোয়া কবুলের আকাক্সক্ষার প্রমাণ বহন করে। আর কেয়ামত দিবস এক ভয়াবহ দিবস। মহান এক দিনেই এটি ঘটবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামত জুমার দিন সংঘটিত হবে।’ (মুসলিম)।

এ দিনে বনি আদম ছাড়া সব সৃষ্টি আতঙ্কে থাকে, না জানি কেয়ামত সংঘটিত হয়ে যায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘পৃথিবীতে জুমার দিন বনি আদম ছাড়া সব প্রাণী কেয়ামত হয়ে যাওয়ার ভয়ে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত (শিঙ্গায় ফুঁৎকারের জন্য) কান পেতে থাকে।’ (নাসাঈ)।

এ দিনের ফজিলত মোমিনের জন্য জান্নাত পর্যন্ত বিস্তৃত। জান্নাতে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় নেয়ামত হলো, আল্লাহর দর্শন লাভ। প্রত্যেক জুমায় আল্লাহ তাদের সম্মুখে আসবেন। আর এটিই হলো জান্নাতে বাড়তি নেয়ামত। আল্লাহর এরশাদ, ‘তারা তথায় যা চাইবে; তাই পাবে এবং আমার কাছে আছে আরও অধিক।’ (সূরা ক্বাফ : ৩৫)। আনাস (রা.) বলেন, ‘তাদের তথা জান্নাতবাসীদের জন্য আল্লাহ প্রত্যেক জুমার দিনে প্রকাশমান হবেন।’ এ দিনে ইবাদতের জন্য দুনিয়ায় একত্রিত হওয়ার বদৌলতে আল্লাহ পরকালে এতদপেক্ষা উত্তম সম্মিলনের আয়োজন করবেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই জান্নাতে একটি বাজার আছে। দুনিয়ার মতো জান্নাতবাসীরা সেখানে একত্রিত হবে। তারপর (সেখানে হঠাৎ) উত্তরের বাতাস প্রবাহিত হবে। তাদের চেহারা ও কাপড়ে সে বাতাস ছড়িয়ে পড়বে এবং তাদের রূপ-সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। তারা তাদের এ বাড়তি রূপ-সৌন্দর্য নিয়ে নিজেদের পরিবারের কাছে ফিরে যাবে। তাদের পরিবারের লোকরা তাদের দেখে বলবে, আল্লাহর শপথ! তোমাদের রূপ-সৌন্দর্য বেড়ে গেছে। তারপর তারাও বলবে, আল্লাহর শপথ! তোমাদেরও রূপে সৌন্দর্য বেড়ে গেছে।’ (মুসলিম)।
জান্নাতে আল্লাহর নৈকট্যতম স্থান লাভ মূলত জুমা আদায়ে দ্রুত অগ্রসর হওয়া পরিমাণ অনুযায়ী হবে। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘তোমরা জুমার দিকে দ্রুত অগ্রসর হও। কেননা জুমার দিন কর্র্পূরের টিলার ওপর আল্লাহ জান্নাতবাসীর সামনে আসবেন। অতঃপর দুনিয়ায় জুমার জন্য অগ্রবর্তী হওয়া পরিমাণ তারা আল্লাহর কাছে হবে।’

জুমা একটি মর্যাদাপূর্ণ দিন। এটি এমন কিছু ইবাদত দ্বারা বৈশিষ্ট্যম-িত, যেসব বৈশিষ্ট্য অন্য কোনো দিনে নেই। ফজরের শুরু হতেই এসবের আলোচনা শুরু হয়। রাসুল (সা.) ফজরের নামাজে সূরা আলিফ লাম সিজদা ও সূরা দাহর তেলাওয়াত করতেন।’ (বোখারি ও মুসলিম)। ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) জুমার দিন ফজরের নামাজে এ দুই সূরা তেলাওয়াত করতেন। কেননা এ জুমার দিনে যা হয়েছে এবং যা হবে; ওই দুই সূরা সবকিছুকে একত্রিত করেছে।’

এটি সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা অবলম্বনের দিন। সূর্য উদিত হওয়ার পর থেকে মেসওয়াক, গোসল ও সুগন্ধি ব্যবহারের সময় শুরু হয়। অন্য দিনের তুলনায় এ দিনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘জুমার দিনে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্কের ওপর গোসল আবশ্যক এবং মেসওয়াক ও যথাসম্ভব সুগন্ধি ব্যবহার করা।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

জুমার নামাজে বর্তমান ও শেষ পরিণতি সম্পর্কিত সূরা আলা ও গাশিয়াহ অথবা সূরা জুমুআ ও মোনাফিকুন উচ্চ স্বরে তেলাওয়াত হয়। নামাজ শেষে মানুষ তাদের নিজ কর্মে ও আনন্দে ফিরে যায়। তাই রাসুল (সা.) জুমার পর মসজিদে
দুই সালামে চার রাকাত সুন্নতের বিধান রেখেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যদি তোমাদের কেউ জুমার নামাজ আদায় করে, তাহলে সে যেন জুমার পর চার রাকাত সুন্নত পড়ে নেয়।’ (মুসলিম)। আর যে ব্যক্তি তার ঘরে নফল আদায় করে, তো সে যেন দুই রাকাত আদায় করে।

ইবাদত ও নৈকট্যের এ দিনটি শুধু জুমার নামাজ দ্বারা শেষ হয়ে যায় না। বরং মুসলমানের জন্য মুস্তাহাব হলো, দিনের বাকি সময় সে আল্লাহর জিকির ও নৈকট্যশীল আমলে কাটাবে। আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘অতঃপর নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা জুমুআ : ১০)।

জুমার দিনের ইবাদতের প্রভাব তৎপরবর্তী দশ দিন ধরে প্রকাশ পায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘জুমার দিন কোনো ব্যক্তি যদি গোসল করে, তারপর সে যথাসম্ভব পবিত্রতা অবলম্বন করে। ভালো করে তেল মাখে কিংবা তার ঘরে থাকা সুগন্ধি মাখে। অতঃপর সে ঘর থেকে বের হয় এবং দুজনের মাঝে ফাটল সৃষ্টি করে না। তারপর তার ওপর ফরজকৃত বিধানকে আদায় করে। এরপর যখন ইমাম কথা বলা শুরু করে, তখন সে চুপ হয়ে যায়। তো আল্লাহ এই জুমা থেকে পরবর্তী জুমার সব গোনাহ মাফ করে দেবেন।’ (বোখারি)। ইমাম মুসলিম (রহ.) সহিহ মুসলিমে বর্ধিত অংশ বর্ণনা করেন, ‘অতিরিক্ত আরও তিন দিনের (গোনাহসহ)।’ এই দিনের কল্যাণের ব্যাপারে যে শিথিলতা অবলম্বন করবে; তো সে অন্যান্য আরও বহু কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকবে। যে ব্যক্তি অবহেলাবশত জুমা ছেড়ে দেবে, আল্লাহ তার অন্তকরণে মোহর লাগিয়ে দেবেন। আর সে গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘লোকেরা যেন জুমা ছেড়ে দেওয়া থেকে অবশ্যই বিরত থাকে। নতুবা তাদের অন্তরে আল্লাহ মোহর মেরে দেবেন আর অবশ্যই এতে তারা গাফেলদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (মুসলিম)।

অন্য সব দিনের মধ্যে জুমার আরও বেশকিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি এ উম্মতের জন্য আল্লাহর অশেষ দান। এটি পরস্পর নেক আমলে প্রতিযোগিতার উন্মুক্ত এক ময়দান। তাই একজন মুসলমানের জন্য দিনটিকে মর্যাদা প্রদান ও একে সৌভাগ্যের দিন হিসেবে গ্রহণ করা, ইবাদতের জন্য পুরোপুরি অবসর করা এবং নিজের অন্তরকে সবধরনের ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে নিরাপদ রাখা উচিত।

লেখক: শায়খ ড. আবদুল মুহসিন বিন মুহাম্মদ বিন কাসিম

পিবিএ/এফএস

আরও পড়ুন...