পিবিএ ডেস্ক:
দুই হাজার এক সালের কথা। তখনকার প্রযুক্তিবিশ্ব যে কতটা ভিন্ন ছিল তা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। তখন বিশ্বে ইন্টারনেট প্রবাহ ছিল মাত্র ৫ শতাংশ, যা আজকে ৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে; এবং সংযোগ স্পীডও ছিল হতাশাজনকভাবে কম। মোবাইল ফোন ছিল মোটামুটিভাবে কমন, কিন্তু তার কর্মক্ষমতা ছিল ভয়েস অথবা টেক্টের তুলনায় খুব সামান্যই। গুগল ছিল তখনও প্রারম্ভিক পর্যায়ে।
এমনকি আপনি যদি তখন অনলাইন পেতেনও, তারপরও সে সময় ই-মেইল এবং কিছু খুব মৌলিক তথ্যসেবা ছাড়া বেশি কিছু করারও ছিল না। ইউটিউব তো ছিল আরও প্রায় পাঁচ বছর পরের কথা এবং ই-কমার্স যে কোন সম্ভাবনাময় বিজনেস মডেল হতে পারে কিংবা আমাজনের মত জায়ান ই-কমার্স কোম্পানি টিকে যেতে পারে সে সম্পর্কে মানুষ তখনও নিশ্চিত ছিল না। আর অবশ্যই স্যোসাল মিডিয়ার ব্যাপারটি তখনও কারো মনের পর্দায় উঁকি দেয়নি।
এমনি এক অবস্থা থেকে গত পনর বছরে বিশ্বে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে উন্নতি হয়েছে তা যদি অবিশ্বাস্য হয়, তাহলে আগামী পনর বছরে কী হতে পারে তা একবার ভাবুন। আগামী ১৫ বছরে যে পরিবর্তনটা হবে, সেটা হবে অনেক বেশি মৌলিক এবং ব্যাপক। সম্ভবত সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা আসবে আমরা প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহার করি সেই ক্ষেত্রে। যদিও গত ১৫ বছরের অগ্রগতিটা প্রধানত ভার্চুয়াল জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু ২০৩১ সালের মধ্যে আমরা ফিজিক্যাল রূপান্তর দেখতে যাচ্ছি।
১.নতুন কম্পিউটিং আর্কিটেক্চার:
১৯৬৫ সালে গর্ডন মূর যখন প্রতি ১৮ মাস অন্তর কম্পিটার চিপসের ট্রানজিস্টর দ্বিগুণ করা বিষয়ে তার বিখ্যাত ভবিষ্যতবাণী করছিলেন; তখনই প্রযুক্তির উন্নয়ন একটি সুশৃংখল গতিপথ পেয়ে গিয়েছিল; যার কারণে প্রকৌশলিরা অত্যন্ত উচ্চ মাত্রার নিশ্চয়তা সহকারে বলে দিতে পারতেন যে, আসন্ন বছরগুলো কী কী সম্ভাবনা নিয়ে আসছে।
এখন তো মুরের সূত্রের সময়ও শেষ হয়ে আসছে। সম্ভবত ২০২০ সালের পর মুরের সূত্র দিয়ে কম্পিউটার চিপসের উন্নয়ন আর সম্ভব হবে না। বিজ্ঞানীরা এখন থ্রিডি স্টেকিং এবং এফপিজিএ চিপস্-র মত নতুন ডিজাইন দিয়ে পুরাতন প্রযুক্তিগুলো থেকে কিভাবে সর্বোচ্চ ফায়দা বের করে আনা যায়। কিন্তু এসবই আমাদেরকে বর্তমান অবকাঠামোর মধ্যেই ধরে রাখবে। আমাদের প্রয়োজন মৌলিকভাবে নতুন কম্পিউটিং আর্কিটেকচার নির্মাণ।
এ ধরনের দুটি আর্কিটেকচার ডেভেলপমেন্টের কাজ এগিয়ে চলছে। প্রথমটি হল কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। এতে সুপার পজিশনিং এবং ইনটাংগ্লিমেন্টের মত কোয়ান্টাম ইফেক্ট ব্যবহার করে বর্তমানের চেয়ে মিলিয়ন গুণ বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার তৈরি হবে। দ্বিতীয়টি হল নিউরোমরফিক চিপস। এটি হবে মানুষের ব্রেইনের নকশার অনুরূপ, যা হবে বর্তমান কম্পিউটার প্রযুক্তির চেয়ে বিলিয়ন গুণ বেশি কর্মক্ষম।
২. জিনোমিক্স:
১৯২০ সালে যখন সর্বপ্রথম মানব জিনমের রহস্যভেদ বা সংকেতমুক্ত হয় তখন এরজন্য ব্যয় হয়েছিল তিন শ কোটি মার্কিন ডলার, কিন্তু ২০৩১ সালের মধ্যে আমরা মাত্র একশো ডলারেরও কম খরচে ফুল হিউম্যান জিনমের সিকোয়েন্সিং করাতে পারব বলে আশা করতে পারি। তাৎপর্যপূর্ণ সেই ব্যয়-হ্রাসের ফলে সম্ভাবনার নতুন নতুন জগৎ সৃষ্টি হবে।
আমরা ইতোমধ্যে মেডিসিনের ক্ষেত্রে জিনোমের বিরাট প্রভাব দেখেছি। বিশেষ করে ক্যান্সার চিকিৎসায়, যেখানে আমরা টিউমার চিকিৎসা শুরু করেছি; এক্ষেত্রে টিউমারটি ব্রেস্ট বা প্রস্টেট- কোন অঙ্গে পাওয়া গেছে তার চেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠছে এর জেনেটিক মেক-আপের বিষয়টি, যার উপর ভিত্তি করেই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসব টেকনিক সমূহ ছাড়াও আরো নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি গুরুত্ব পাবে, যার ফলে ক্যান্সার চিকিৎসা খুবই সহজ হয়ে উঠবে। এসব নতুন টেকনিক সমূহের মধ্যে আরেকটি হল ইমিউনোথেরাপি, যা মানব শরীরকে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
এ সম্পর্কিত একটি প্রযুক্তিকে বলা হয় ঈজওঝচজ, যা দিয়ে যথার্থভাবে জেনস নিয়ন্ত্রণ এবং কৃত্রিম অঙ্গ সংস্থানের ইঞ্জিনিয়ারিং করা যায়, যা একটি সেলুলার ফ্যাক্টরির মত কাজ করবে। ব্যাক্টরিয়া এবং এলগেই’র (ধষমধব) মত মাইক্রো-অর্গানিজমে সঠিক জেনস স্থাপন করে আমরা বিভিন্ন রকম প্রোডাক্ট তৈরি করতে পারব যা এখন পেট্রোলিয়াম, প্লাস্টিক তৈরি করা হয়।
৩.ন্যানো টেকনোলজি:
১৯৫৯ সালে পদার্থবিদ রিচার্ড ফিনম্যান যখন ন্যানোটেকনোলজি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ধারণা ব্যক্ত করেন; যখন তা ছিল এটমিক পর্যায়ে, তখন একে বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনী বলেই মনে করা হত। কিন্তু আজ এটি একটি বাস্তবতা। বর্তমানে এই প্রযুক্তিতে গ্রাফেন এবং কোয়ান্টাম ডটস (মৎধঢ়যবহব ধহফ য়ঁধহঃঁস ফড়ঃং) এর মত নতুন এটমিক মাত্রা যোগ হয়েছে যা সম্পূর্ণ নতুন সম্ভাবনার অফুরন্ত দ্বার খুলে দিয়েছে।
ভবিষ্যতে ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহার হবে অত্যন্ত ব্যাপক। তার মধ্যে একটি হবে অত্যন্ত উত্তেজনাকর ক্ষেত্র; তা হল আণবিক পর্যায়ের পদার্থ সমূহ দিয়ে প্রোগ্রাম তৈরি করা যাবে এবং যদিও এক্ষেত্রে অগ্রগতি এখনও একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, কিন্তু ২০৩১ সালের মধে আমরা নতুন নতুন ফিজিক্যাল প্রোডাক্ট সমূহ ঠিক সেই ভাবে ডাউনলোড করতে সক্ষম হব, যেভাবে বর্তমানে আমরা সফ্টওয়ার ডাউনলোড করে থাকি!
ন্যানো টেকনোলজির আরেকটি প্রয়োগ হবে ন্যানোস্কেল মেডিসিনে, যার আভাস ফিনম্যান তার অরিজিনাল টকে দিয়েছিলেন। মানুষের চুলের চেয়েও সরু বা সূক্ষ যন্ত্র দিয়ে চিকিৎসকরা খুব সহজেই সুনির্দিষ্ট সেলকে টার্গেট করে চিকিৎসা করতে পারবেন। এর ফলে চিকিৎসা প্রক্রিয়া হবে অনেক বেশি কার্যকর এবং কম ক্ষতিকর এবং কম কষ্টদায়ক।
২০৩১ সালের মধ্যে ন্যানো রোবটেরও প্রত্যাশা করতে পারি যা আমাদের ব্লাডস্ট্রিমে পুশ করে ক্যান্সার সেল, জেনস খুঁজে বের করবে এবং এমনকি প্রয়োজন হলে নির্দিষ্ট কোন সেলকে মেরামত করতে পারবে।
৪. এনার্জি সংরক্ষণ:
গত চল্লিশ বছরে জ্বালানি সংরক্ষণে অগ্রগতিকে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষা করা হয়েছে। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির প্রথম উন্নয়ন হয় ১৯৭০ সালে। এরপর থেকে বেড়েছে এর ঘনত্ব এবং মূল্য। একটি ল্যাপটপের ওজন এবং ভলিউমের ৯০% দখল করে নেয় এর ব্যাটারী। বর্তমানে আমরা যে মোবাইল বিপ্লবটা পেয়েছি, এটি সম্ভব হ’ত না যদি না এর আকৃতি ছোট এবং দামে সস্তা না হ’ত। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তাই বায়ু ও সৌর শক্তির মত নবায়নযোগ্য উৎস সমূহের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে আরো সুসংহত ব্যাটারির উন্নয়ন প্রয়োজন।
যদিও মূরের সূত্রের মত লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিও তাদের তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধ দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে এবং গবেষকরা এখন বিকল্প প্রযুক্তি খুঁজে বের করার জন্য কঠোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ লক্ষে জয়েন্ট সেন্টার ফর এনার্জি স্টোরেজ রিসার্চ নামের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নতুন প্রজন্মের ব্যাটারী প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে, যে ব্যাটারীর শক্তি বাড়বে পাঁচ গুণ আবার দামও কমবে ৫ গুণ।
৫. রোবোটিকস:
২০৩০ সালের মধ্যে রোবোটিক প্রযুক্তি দ্রুত উন্নতি লাভ করবে। বিগত বছর গুলোতে রোবটের ব্যবহার বেশি হয়েছে ভারি শিল্পে, যেখানে নিরাপত্তার কারণে তাদেরকে মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হ’তো। বর্তমানে কিন্তু রোবটেরা ফ্যাক্টরিতে এবং বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষের পাশে থেকেই কাজ করা শুরু করেছে।
২০৩১ সালের মধ্যে রোবটেরা মানুষের দৈনন্দিন জীবনেও বিরাট ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশা করছি। হাল্কা কিন্তু শক্তিশালী মেটারিয়াল দিয়ে ন্যানো টেকনোলজি নিউরোমরফিক চিপস’র সাহায্যে এমন সব রোবট তৈরি হবে যেগুলো খুব স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের সাথে ইন্টারেক্ট করতে পারবে, মানুষের সাথে প্রায় মানুষের মতো করেই একসাথে কাজ করতে সক্ষম হবে।
বিগত ১৫ বছরে প্রযুক্তির অগ্রগতি মূলত ডিজিটাল উন্নয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আগামী ১৫ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎসাহব্যাঞ্জক অগ্রগতি সাধিত হবে এবং সেটা হবে বিভিন্ন সেক্টরের সমন্বিত অগ্রগতির মাধ্যমে।
ব্যাখ্যাযোগ্যভাবে শক্তিশালী কম্পিউটিং আর্কিটেক্চারিং-ই এই অগ্রগতিকে সম্ভব করে তুলবে এবং এই অগ্রগতি আমাদেরকে জেনমিক ও আণবিক স্তরে কাজ করতে এবং বুদ্ধিমান মেশিন তৈরি করতে সাহায্য করবে।
এনার্জি বা জ্বালানির নতুন নতুন উৎস আবিষ্কার এবং অধিক দক্ষতার সাথে সেগুলোকে সংরক্ষণ করার সক্ষমতা এসব প্রযুক্তি সমূহকে বাস্তবানুগ, নিরাপদ এবং মূল্য সাশ্রয়ি করতে সাহায্য করবে।
পিবিএ/মু.আ.হু