বয়ঃসন্ধিকালের স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং সমাধান

পিবিএ হেল্থ ডেস্ক: বয়ঃসন্ধিকালে আবেগ ও ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতা বেশি থাকে।এ কারণে এ সময়ে বিশেষ ধরনের কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়।

এখানে কৈশোরকালের প্রধান স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হল:

অকাল গর্ভধারণ এবং শিশুজন্ম
১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের জন্য বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান কারণ অকালগর্ভাবস্থা এবং শিশুজন্মের জটিলতা। বিশ্বব্যাপী প্রায় ১১% শিশুর জন্ম দেয় ১৫-১৯ বছর বয়সী মেয়েরা এবং এই জন্মের অধিকাংশই হয় নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশ থেকে। অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে, তাই বাল্য বিবাহ ও অকাল গর্ভধারণ থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। আর যেসব বালিকারা গর্ভবতী হয়ে পড়ে, তাদের গর্ভকালীন বিশেষ যতেœর প্রয়োজন।

যৌনরোগ/এইচ আই ভি
উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি হচ্ছে যৌনরোগে আক্রান্ত হওয়া। সঙ্গদোষ, খারাপ পরিবেশ, অশ্লীল বা পর্ণোছবি, পারিবারিক শৃংখলার শিথিলতা, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব, নৈতিক অধঃপতন, ছেলে-মেয়ের অবাধ মেলামেশা ও অবৈধ যৌণাচার বা জেনা-ব্যাভিচার, ধর্ষণ, সমকামিতায় লিপ্ত হলে নানা ধরনের যৌনরোগ এমনকি মরনব্যাধী এইচ আই ভি বা এইডস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এই বয়সে এই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি হওয়ার কারণ হল, এই সময়ে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যে কোন বিষয়ে কৌতুহল এবং আবেগ-উদ্দাম-অস্থিরতা বেশি থাকার কারণে তাদের আত্মসংযম বা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ও হিতাহিত জ্ঞান কম থাকে। তাই এই সময়টা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব মতে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর ২ মিলিয়নেরও বেশি কিশোর কিশোরী এইচআইভি ভাইরাস বহন করে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, ২০০৬ সালের পর থেকে এইচআইভি সংক্রামিত মৃত্যুর মোট সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে আসলেও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এইচআইভি মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

অন্যান্য সংক্রামক রোগ
শৈশব টিকা ব্যবস্থার উন্নতির কল্যাণে কিশোর মৃত্যু এবং হামের কারণে সৃষ্ট অক্ষমতা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে। তবে ডায়রিয়া এবংlower respiratory tract infections-(LRTI) বা নিওমোনিয়াকে এখনো ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের জন্য অন্যতম শীর্ষ ঝুঁকি হিসেবে গণ্য করা হয়।
বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার মতে এই বয়সের ছেলে-মেয়েদের মৃত্যুর জন্য এই দুটো রোগ শীর্ষ ৫ কারণের মধ্যে অন্যতম। এই দুটো রোগের সাথে সবহরহমরঃরং বা মস্তিষ্ক ঝিল্লীর প্রদাহ যোগ হলে শীর্ষ ৩ কারণ বলে গণ্য করা হয়। আফ্রিকার নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এসব রোগের প্রকোপ বেশি।

মানসিক-সাস্থ্য সমস্যা
বিষণ্নতা হল কৈশোর কালের অসুস্থতা ও নানাবিধ অক্ষমতার (disability) তৃতীয় প্রধান কারণ। আর আত্মহত্যা হল ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ।
সহিংসতা, দারিদ্র্য, অপমান এবং অবমূল্যায়ন অনুভূতি বা হীনমন্যতা কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে প্রকট করে তুলতে পারে।
শিশু এবং কিশোর বয়সে জীবন দক্ষতা (life skills) গড়ে তোলা এবং স্কুল ও অন্যান্য সামাজিক পরিবেশ গুলোতে তাদেরকে মানসিক সাপোর্টে দিয়ে তাদের মানসিক সাস্থ্যের উন্নতি করা যায়।

জীবন দক্ষতা হল যে কোন পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার এবং ইতিবাচক আচরণেরক্ষমতা বা দক্ষতা, যা মানুষকে তার দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জগুলির সাথে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম করে তোলে।অন্য কথায়, মনোসামাজিক পারদর্শিতা বা সক্ষমতা।

এগুলো হল শিক্ষা বা সরাসরি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত মানবিক দক্ষতাগুলির একটি সমষ্টি যা মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনের সম্মুখীন হওয়া বিভিন্ন সাধারণ সমস্যা ও প্রশ্নের মোকাবেলায় ব্যবহার করে থাকে।

কিশোর-কিশোরীদের এবং তাদের পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করার উপযোগী কর্মসূচিগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। যদি সমস্যার সৃষ্টি হয়, তাহলে তাদের উপযুক্ত ও যতœশীল স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা সনাক্ত করা এবং পরিচালনা করা উচিত।

মদ ও মাদকাসক্তি

কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ক্ষতিকারক পানীয়ের ব্যবহার বেশিরভাগ দেশে একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়। এটি আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে হ্রাস করে এবং ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ বৃদ্ধি করে, যেমন অনিরাপদ যৌনতা এবং বিপজ্জনক ড্রাইভিং।
এটি তাদের আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া বা ইনজুরির একটি প্রধান কারণ, এছাড়া সহিংসতা (বিশেষ করে কোন পার্টনার দ্বারা) এবং অকাল মৃত্যু। এগুলো (মাদকাসক্তি, যৌনরোগ এবং ইনজুরি) টিনএজ ছেলেমেয়েদের পরবর্তী জীবনে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে এবং জীবন-প্রত্যাশার উপর নেতিবাচক প্রভাবিত ফেলতে পারে। একইভাবে ১৫-১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ড্রাগের ব্যবহারও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক সমস্যা।

ইনজ্যুরি

দুর্ঘটনাজনিত ইনজুরি টিনএজ ছেলেদের মৃত্যু এবং অক্ষমতার একটি প্রধান কারণ। ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনার ফলে ১ লক্ষ ১৫ হাজারেরও বেশি তরুণের মৃত্যু হয়।আগেই বলা হয়েছে, তরুণদের মধ্যে বয়সজনিত চিত্তচাঞ্চল্য ছাড়াও মাদকের প্রভাবে বেপরোয়া ড্রাইভিং ও সহিংসতা বা মৃত্যুঝুঁকির প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সমাজকে মাদকমুক্ত করা একান্ত অপরিহার্য। তানাহলে ইনজুরিজনিত অকালমৃত্যু ও পঙ্গুত্বের হাত থেকে তরুণ সমাজকে মুক্ত করার আর কোন আশা নাই।

অপুষ্টি ও স্থূলতা

উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েদের আরেকটি সাধারণ স্বাস্থ্য ঝুঁকি হল অপুষ্টি এবং স্থূলতা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেক ছেলে ও মেয়ে বয়ঃসন্ধিকালে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের অভাবে অপুষ্টিতে ভোগে এবং সহজেই রোগ-শোকের শিকার হয়ে অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
অন্যদিকে, অল্প, মধ্য ও উচ্চ-আয়ের দেশে বেড়ে ওঠা কিশোর-কিশোরীরা অতিভোজনের কারণে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতার শিকার হয়ে অকালে প্রাণ হারায়। আসলে অপুষ্টি আর অতিরিক্ত পুষ্টি উভয়ই স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে।

ব্যায়াম এবং পুষ্টির অভাব

আয়রন ঘাটতি জনিত অ্যানিমিয়া কয়েক বছর ধরে কিশোর কিশোরীদের মৃত্যু এবং অক্ষমতার শীর্ষ কারণ হিসেবে বিরাজ করেছে এবং ২০১৫ সালেও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি।

এক্ষেত্রে আয়রন এবং ফোলিক অ্যাসিডের সম্পূরক ব্যবহার একটি সমাধান হতে পারে যা বয়ঃসন্ধি অথবা যৌবনকালে পিতা-মাতা হওয়ার আগে তাদের স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সাহায্য করবে।

আয়রন সহ মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট হৃাসের জন্য দায়ী হল ক্রিমিরোগ, যেমন অন্ত্রের মধ্যে থাকা হুকওয়র্ম, নিয়মিত এগুলোকে নির্মূল করতে হবে।

স্বাস্থ্যকর খাবার এবং ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তোলা হলো তরুণ বয়সের স্বাস্থ্যের উন্নয়নের মূল ভিত্তি। উচ্চ স্যাচুরেটেড চর্বিযুক্ত খাবার, ট্রান্স-ফ্যাটি অ্যাসিড, ফ্রি সুগার, বা লবণ খাওয়া হ্রাস করা এবং সুস্থ খাবার ও কায়িক পরিশ্রমের কার্যকলাপে অংশগ্রহণের সুযোগ গ্রহণ করা সকলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে বিশেষ করে শিশু ও টিনএজ ছেলে-মেয়েদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

অথচ, প্রাপ্ত জরিপের তথ্য সমূহও নির্দেশ করে যে, প্রতি ৪ জন টিনএজ ছেলে-মেয়ের মধ্যে ১ জনেরও কম শারীরিক কার্যকলাপের জন্য প্রস্তাবিত নির্দেশনা পূরণ করে; তা হলো: প্রতিদিন ৬০ মিনিট মাঝারি থেকে জোরালো কায়িক পরিশ্রম করা।

তামাক ব্যবহার

সমাজের অধিকাংশ লোক যখন তামাকের ব্যবহার করছে, তার প্রভাব তরুণ-তরুণীদের উপরও পড়ছে এবং উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আজ তামাকে আসক্ত। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার হিসেব মতে, বিশ্বের প্রতি ১০ জন তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অন্তত একজন ধূমপানে আসক্ত।
বলাবাহুল্য এই আত্মঘাতি বিষপান তরুণদের স্বাস্থ্যের উপর অত্যন্ত মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে এবং তাদের কাক্সিক্ষত স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও বিকাশকে ব্যাহত করছে।

শুধু তাই নয়, ধূমপানের ফলে তাদের শরীরে মারাত্মক রোগ বাসা বাঁধে যার সুদূর প্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তাদের পরবর্তী জীবনেও। তাই অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তামাকজাত পণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ করা, তামাকজাত দ্রব্যের দাম বাড়ানো, তামাকের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা এবং ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা একান্ত অপরিহার্য।

পিবিএ/মু.আ.হু

আরও পড়ুন...