কিশোর গ্যাংয়ের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের তালিকা করা হচ্ছে: মহিদ

কিছু দিন আগের তুলনায় বর্তমানে কিশোর গ্যাং এর তালিকা বড় হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন্স) ড. খ: মহিদ উদ্দিন।

তিনি বলেন, কিছু দিন আগেও ঢাকায় ৩৪ টা কিশোর গ্যাং ছিল। সম্প্রতি এই তালিকা বড় হয়েছে। এই কিশোর গ্যাং কালচারের নেপথ্যে আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের তালিকা করা হচ্ছে। এর নেপথ্যে যে বড় ভাই থাকুক না কেন, যেই রাজনৈতিক দলেরই হোক না কেন, শিশুদের ভিন্নভাবে অপরাধকাজে ব্যবহার করা অপরাধ। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদেরও তালিকা করে প্রচলিত আইনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

শনিবার (২৩ মার্চ) রাজধানীর তেজগাঁওস্থ বাংলাদেশ চলচিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনে (এফডিসি) ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত ‘কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির কারণ নিয়ে ছায়া সংসদ’- এ তিনি এসব কথা বলেন।

কিশোর গ্যাং এর পেছনের মদত দাতাদের শনাক্তের সময় এসেছে কিনা? প্রশ্নের জবাবে মহিদ উদ্দিন বলেন, সময় এসেছে না সময় এসেছিলই। সময় কখনো নোটিশ করে আসে না। প্রথমত আমি বলছি অপরাধীর কোন দল থাকে না। কারণ অপরাধী নামে বাংলাদেশে কোন দল নেই। বরং অপরাধীরা গিয়ে দলের মধ্যে আশ্রয় নেয়। অপরাধীরা তাদের শেল্টারের জন্য দলের মধ্যে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করে থাকতে পারে। কিশোর গ্যাং নিয়ে আমাদের সংসদেও আলোচনা হয়েছে।

সংসদ সদস্যরা ও বলেছেন এটির সাথে যারাই সংশ্লিষ্ট তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং আইনের আওতায় নিয়ে আসতে। অতীতে আমরা তাই দেখেছি।

আমি আমাদের পক্ষ থেকে বলতে চাই ডিএমপি’র পক্ষ থেকে বলতে চাই, কিশোর অপরাধের পেছনে যদি কেউ কোন পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোন বাঁধা আছে বলে আমি মনে করি না।

কিশোর অপরাধের পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিশোর অপরাধী গ্যাং ছিল ৩৪ টি এটা সম্প্রীতি বেড়েছে। আমরা বেশ কিছু কিছু জ্ঞানকে নতুন করে সনাক্ত করেছি। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই কিশোর অপরাধে যারা জড়িত বা সংশ্লিষ্ট তাদের বিরুদ্ধে আইনের মাত্রা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আর এই কিশোর অপরাধে যেন কেউ পৃষ্ঠপোষকতা না করে। কার্যক্রমের জন্য কিশোরদের কে ব্যবহার করা না হয়।এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর। যদি শিশু কিশোরদেরকে অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়াতে বাধ্য করা হয়। সে যেই হোক। তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পৃষ্ঠপোষকদের তালিকা করবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক কয়েকটি কিশোর গ্যাংয়ের কার্যক্রমে পৃষ্টপোষকদের নাম এসেছে। তাদের তালিকা করা হবে। নাম কিছু এসেছে। নাম আসলেই তো আস্তে আস্তে তালিকা তৈরি হতে থাকে। আরও কিছু আসলে তালিকা হালনাগাদ করা হবে। তালিকায় যাদের নাম আসবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ছায়া সংসদে বিতর্কি প্রতিযোগিতায় পার্লামেন্টে স্পিকার হিসেবে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।

কিরণ বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের নেপথ্যে মদদ দাতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছ ব্যতিত কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। অভিযোগ রয়েছে কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতারা তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে কিশোরদের ব্যবহার করছে।

স্থানীয় প্রভাব প্রতিপত্তি, চাদাবাজী, মিছিল-মিটিং, দখলবাজী, দলবাজী ইত্যাদি কাজে যাতে শিশু কিশোরদের ব্যবহার করা না হয় সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে রাজনৈতিক উচ্চ পর্যায় থেকে প্রশাসনের সর্বস্তরে সদিচ্ছা পোষণ জরুরী। প্রচলিত শিশু আইনে কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়া জটিল মনে হলে প্রয়োজনে তা সংস্কার করা যেতে পারে।

তিনি বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের সঠিক কোন হিসাব না থাকলেও ঢাকা চট্টগ্রামসহ সারাদেশে কমবেশি ২০০টির বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে। এসব কিশোর গ্যাংয়ের নানা রকম আজগুবি নাম রয়েছে যেমন- কোপাইয়া দে গ্রুপ, বগা গ্রুপ, লাড়া দে গ্রুপ, ঘুটা দে গ্রুপ, ভইরা দে গ্রুপ, গাইরালা গ্রুপ, ডেভিল বয়েজ গ্রুপ, রোমান্টিক গ্রুপ, কিং রন গ্রুপ, লাভ লেন গ্রুপসহ বহু কিশোর গ্যাং রয়েছে সারা দেশে। ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা, শিথিল সামাজিক বন্ধন, পারিবারিক বন্ধনের ঘাটতি, মাদকের সহজলভ্যতা, দারিদ্রতা, কর্মসংস্থানের অভাব, সুশাসনের ঘাটতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবসহ নানা কারণে কিশোর ও তরুণরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতাকে আরো বেশি উস্কে দিচ্ছে। বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, লাইকি, ইমু, মাইস্পেস, হাইফাইভ, বাদুসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার কিশোর

অপরাধের মাত্রাকে ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে জানিয়ে কিরন বলেন, কিশোর তরুণদের জন্য বর্তমানে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ওয়েব সিরিজ।

কিছু কিছু অনলাইন প্লাটফর্মে তুমুল অশ্লীলতা, নোংড়া সংলাপ, উদ্ভট গল্প দিয়ে ওয়েব সিরিজ প্রদর্শিত হচ্ছে। এসব ওয়েব সিরিজগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে সহজেই কিশোর-কিশোরীরা আসক্ত করে ফেলছে। ভারতীয় বিতর্কিত ওয়েব সিরিজগুলোর মধ্যে কলেজ রোমান্স, ক্যাম্পাস ডায়েরি, অভয়, আস্তে লেডিজ, দুপুরের ঠাকুর পো খুবই অশ্লীল। এছাড়া বাংলাদেশে তৈরি ১৪ ই আগস্ট, বুমেরাং, সদর ঘাটের টাইগারসহ বেশ কিছু বিতর্কিত ওয়েব সিরিজ রয়েছে। বিটিআরসিকে এই ধরণের বিতর্কিত ওয়েব সিরিজগুলো সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

এছাড়াও বিতর্কিত অ্যাপস টিকটকের মাধ্যমে তরুণরা সস্তা হিরোইজমের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের পরিবারের কিশোরীদের অনৈতিক কর্মকান্ডের ফাঁদে ফেলছে এসব কিশোর অপরাধীরা। পুল পার্টি, ড্যান্স পার্টি ইত্যাদির নামে প্রতারিত করছে সাধারণ কিশোর-কিশোরীদের।

এ সময় তিনি কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে ১০ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করেন। সুপারিশগুলো হলো, কিশোর অপরাধ রোধে রাজনৈতিক উচ্চ পর্যায় থেকে প্রশাসনের সর্বস্তরে সদিচ্ছা প্রদান করা, প্রচলিত শিশু আইনে কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়া জটিল মনে হলে প্রয়োজনে আইনের সংস্কার করা, স্যোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন অনুযায়ী বিতর্কিত অ্যাপসগুলো বন্ধ করতে বিটিআরসিকে উদ্যোগ গ্রহণ করা। রাত ১০ টার পর অতি জরুরী নয় এ ধরণের অ্যাপসগুলো বন্ধ রাখা, স্কুল কলেজগুলোতে পাঠ দানে বৈচিত্রতা তৈরি করে শিশু কিশোরদের আরো বেশি সৃজনশীল কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করা।

এলাকাভিত্তিক পাঠাগার, খেলাধুলাসহ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও বিনোদন ব্যবস্থা করা।

পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা এলাকার ওয়ার্ড পর্যায়ে কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে সিটিজেন মনিটরিং কমিটি গঠন করা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্মহ অভিযানের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংদের বিরদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহন করা, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে জাতীয় পর্যায়ে কমিটির মাধ্যমে কাউন্সেলিং গাইডলাইন প্রস্তুত করে তা বাস্তবায়ন করা, সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পরিবারের ভূমিকা বাড়ানোর লক্ষ্যে কৌশল নির্ধারণ করা এবং কিশোর অপরাধ সংশোধন কেন্দ্রগুলি আধুনিকায়ন করে সেখানে কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করা।

এসময় সোশ্যাল মিডিয়ার অবাধ ব্যবহারের কারণে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে” শীর্ষক ছায়া সংসদে প্রস্তাবের পক্ষে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের বিতার্কিকদের পরাজিত করে বিপক্ষে সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিতার্কিকরা বিজয়ী লাভ করেন।

প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মোহাম্মদ রইস, ড. রাশেদা রওনক খান, সাংবাদিক এস এম ফয়েজ, সাংবাদিক মাসুদা লাবনী এবং সাংবাদিক জুমাতুল বিদা।

আরও পড়ুন...