ভালোবাসা ভাড়া বাসায় বাস করে না

পিবিএ, ঢাকা: কী অদ্ভুত, সম্পর্ক! যার সঙ্গে এই সম্পর্ক, মনটা কেবল তারমুখী হয়ে থাকে। রাত, দিন চব্বিশ ঘণ্টা বিরতিহীন। শুধু কী মন, তার সঙ্গে সময়, বেঁচে থাকার নিত্যকাজকর্মও যুক্ত হয়ে যায়।

কাগজ, কলমে, পোশাক-আশাকে সবখানেই আধিপত্য বিস্তার। রুটিনমাফিক জীবনের কত কিছু যে বদলে যায়। উদাসীনতায় উড়াল হয়। পেটে মারাত্মক রকম শূন্যতাবোধ না হলে খাবারের কথা মনে হয় না। কী খেতে বেশি পছন্দ, চিন্তা করেও খুঁজে পাওয়া যায় না। অরণ্যের অবস্থা তেমন।

নিউমার্কেট যেয়ে বড় বড় বইয়ের দোকানে তন্নতন্ন করে ভালোবাসার উপন্যাস খোঁজে। ব্যাকুল তৃষ্ণার চাপ সবকিছুর চেয়ে যেন বেশি। রোদ-বৃষ্টি বেঁধে রাখতে পারে না।

কত ঘটনা চারপাশ, কোথাও মন বসে না। মনের ক্ষুধা এলোমেলো, অগোছালো। তৃষ্ণা মেটে না। প্রায় কিছুদিন ধরে নির্ধারিত সময়ের আগেই অফিসের কাজ শেষ করে। ঢুকে পড়ে শহরের বই বিক্রির বড় বড় দোকানে।

মাথা তুলে বেশ পরিপাটি হয়ে দাঁড়িয়ে সেসব। উন্নত পরিবেশ, আধুনিক আসবাবপত্র আর ব্যবস্থাপনায় অতি আধুনিকতার ছাপ সবটুকু জায়গাজুড়ে। বই সব থরে থরে সাজানো।

অরণ্য খুঁজে ফিরে, একটা ভালো ভালোবাসার উপন্যাস। এক সেলফ থেকে আরেক সেলফ। একটা ভালো প্রেমের উপন্যাস তার খুব দরকার।

ভালো একটা ভালোবাসার উপন্যাস চাই। দেখাতে পারবেন?

স্বাভাবিক চলাচলে হার্ডব্রেক যেন। বিক্রেতা অবাক। মাছের বাজার নয়, বইয়ের দোকান। এখানে বই আর লেখকের নাম বলতে হয়। লেখকের নাম জানতে চায় বিক্রেতা।

বলবে কী করে, নিজেও তো জানে না অরণ্য, বই কিংবা লেখকের নাম। একটা অন্যরকম, অসাধারণ প্রেমের উপন্যাস চাই, এটুকুনই বুঝে নিয়েছে। উপন্যাস চায়, লেখক নয়। কৈশরে পড়া প্রেমের বইয়ের তালিকা দীর্ঘ। মনে পড়ছে না। সব কেমন সাদা হয়ে আছে।

আপনার পছন্দ মতো দেখানো না হয়।

বিক্রেতার বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে। আর অরণ্য টগবগে আঠাশে দাঁড়িয়েছে সবে। ভালো বেতনের একটা চাকরি হয়েছে সম্প্রতি। পোশাক-আশাকে যথেষ্ট স্মার্ট। অন্যের পছন্দে কেউ বই কেনে, জানা ছিল না। বিক্রেতা কৌতুক মেখে নেয় ঠোঁটজুড়ে। আজব এক প্রাণীর সঙ্গে এবার শুরু হবে যেন ঠাট্টামাশকারা।

আমি তো প্রেমের গল্প পড়ার বয়স হারিয়েছি সেই কবে। প্রেম করে ছ্যাঁকা খাওয়া পাবলিক ভাই আমি। ওসব পড়ার অভ্যাস সবার হয় না। প্রেমে ডুবেছেন মনে হয়। আমি আপনাকে হেল্প করতে পারি। আপনি বই ও লেখকের নাম বললে, আমি দেখতে পারি বইটা আছে কিনা।

মুশকিল। আমি অন্য কোথাও দেখি। অরণ্য দোকান থেকে বের হতে চাইলেও উপায় থাকে না। বিক্রেতা পথ রোধ করে। মনে হল অরণ্যকে ব্যর্থ মনে ফিরতে দেবে না। সহানুভূতি প্রকাশে কার্পণ্য নেই।

একটু দাঁড়ান। সময় দিন, আমি খুঁজে দেখি। সময় নিয়ে, শ্রম দিয়ে একটা বই চোখের সামনে মেলে ধরল। ড্যানিয়েল স্মিথের লেখা। বাংলায় বইটির নামকরণ হয়েছে ‘ভালোবাসার সিঁড়ি’। অনুবাদক যিনি, তার নাম অপরিচিত।

সিরিয়াস পাঠক না হলেও দেশের কয়েকজন অনুবাদকের নাম জানে অরণ্য। সেই দলের কেউ নন। বাজারে অনুবাদ করা বই বেশ পাওয়া যায়। অধিকাংশ অরিজিনাল নয়, ফটোকপি।

কখনো সখনো এক বইয়ের লেখা আরেক মলাটের বইতে চলে যায়। অদক্ষ হাতে কাজগুলো করা হয় অতি মুনাফার জন্য। বইয়ের চেহারা চকচক করলেও ভেতরটা বড় মলিন।

বাংলায় বইয়ের নামটা ভালো লেগেছে। হৃদয় ছুঁয়েছে। কিন্তু ইংরেজিতে মূল নামটা কোথাও খুঁজে পেল না অরণ্য। পৃষ্ঠাগুলো কেমন কালচে। মুদ্রিত লেখাগুলো ডাবল লাগে। ঝাপসা ঝাপসা ভাব। কোনো কোনো শব্দ জলছাপের মতো।

এটা নিতে পারেন। ভালো।

আপনি পড়েছেন?

আমার পড়ার সময় কোথায়! সকাল থেকে রাত অবধি তো বই দেখাই পাঠককে। নাম বলে দেয়, বইটা কেমন হবে। বিক্রেতার কথায় অরণ্যের বুকে পুঞ্জীভূত ভালোবাসার ব্যাকুলতা ভেজে না। মেটে না পিয়াস। বন্ধুদের কাছে শোনা নীলক্ষেতে সস্তায় ভালো ভালো বই পাওয়া যায়। জগতের সব লেখকের বই নাকি আছে সেখানে। নিউমার্কেটের বড় বড় বইয়ের দোকানের সঙ্গে খুব বেশি তফাৎ নেই। ভালো কিছু না পেলে ভালোবাসার সিঁড়ি নিয়ে যাবে, আশ্বাস দিয়ে বের হয় অরণ্য।

বন্ধুদের কাছ থেকে শোনা কথায় হাঁটা দেয় নীলক্ষেতের দিকে। ঢাকা শহরের এক চতুর্থাংশ লোকজন যেন এখানে। দূরত্ব যত নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানগুলোর সন্নিকটবর্তী হয়, শিক্ষার্থীদের কোলাহল তত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনায় মত্ত হয়ে বই খোঁজে। সঙ্গে চলে আড্ডা।

প্রতিদিন সবার সঙ্গে সবার দেখা হয়, কথা হয়। অথচ কথা শেষ হয় না। বরং প্রতিদিন যেন নতুন করে কথা শুরু হয় নতুন আবেগে। প্রতিদিনই থাকে ওরা বিস্মিত আর চমকিত কথা বলায়, কথা শোনায়।

বইয়ের মার্কেটের বাইরের দিকে ফুটপাতজুড়ে অনেক বই। রাস্তা প্রায় খুচরা বই বিক্রেতাদের দখলে। ইন্ডিয়ান লেখকদের কপি করা মোটা মোটা বই সারিবদ্ধভাবে শুয়ে আছে। গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে।

সমরেশ মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতবিতানও রয়েছে। বাংলাদেশের আছে হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, জাফর ইকবালের বই। এছাড়া আর কারোর বই তেমন চোখে পড়ে না। মাঝারি বা নতুন লেখকদের বই এই পর্যন্ত আসে না। চোখে পড়ে না।

একটা ভালো ভালোবাসার উপন্যাস হবে?

রাইটারের নাম বলুন।

লেখকের নাম পছন্দ করতে চাইছি না। লেখা পছন্দ করতে চাইছি। আপনার পছন্দ মতো একটা দেখান।

মানে! বেকুব বনে গেলেন বিক্রেতা। আশ্চর্য এক প্রাণী আজব এক পছন্দের কথা বললেন যেন, ভাবটা এমনই। জীবনে এমন কথা শুনেছেন বলে মনে হল না।

সব্বাই তো লেখকের বই খোঁজে! বইয়ের নাম বলে। আর আমি ফুটপাতে বই বিক্রি করি, আমার মতো কেউ ভাতডাল বিক্রি করে। আমার পছন্দ কি আপনার সঙ্গে মিলবে? আর আমাদের পড়ার সময় কই? মাশকরা করতে আইছেননি ভাই? গড়গড় করে কথাগুলো বলে হাসে বিক্রেতা। হাসিটা মেজাজ খারাপ করে দিল অরণ্যের। হাসির কী হল। বিক্রেতার হাসি সাপের মতো শরীর পেঁচিয়ে ধরল।

শরীর কেঁপে ওঠে। শরীরে বিষের জ্বালা। উল্টো দিকে হাঁটা শ্রেয়। হাঁটা শুরু। মনটা এত রোদেও ভিজে যায় কষ্টের জলে। ভালোবাসার মানুষকে একটা ভালোবাসার বই উপহার দেয়ার কী ব্যাকুলতা, সে তো কেবল অরণ্যই জানে। আর মাত্র দুই দিন বাকি, সেই মুহূর্ত কাছে আসতে। খুঁেজ পেতেই হবে একটা ভালো ভালোবাসার বই।

চাকরি পাওয়ার পর থেকে বিয়ের জন্য ব্যতিব্যস্ত অরণ্যের পরিবার। প্রায় প্রতিদিন মেয়ে দেখে ফিরছে অরণ্যের বাবা-মা। খাবার টেবিলে উচ্ছ্বসিত গল্পে সেই দেখার বর্ণনা চলে।

প্রায় প্রতিদিন একজন করে নারীর গল্প শোনে অরণ্য। নিরুত্তর সে। বাবা-মা ভেবে নেন, ছেলে তাদের লাজুক। লজ্জায় হয়তো কিছু বলছে না। মা চুপিসারে জানতে চায়, তোর কী কোথাও পছন্দ আছে, বাবা? ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে, জবাব দেয় না অরণ্য। খুব চেষ্টা করেন মা, একটা কিছু শোনার জন্য। সুখকর কিছু শোনার অপেক্ষা মায়ের।

যদি ছেলে বলত, জানো মা, মেয়েটি অনেক ভালো। ভালো মনের মানুষ। আমার পছন্দ। হয় না তেমন শোনা। ছেলে দ্রুত অন্যত্র সরে যায়। মায়ের দৃষ্টির আড়ালে সরে যাওয়ার তাড়া তার। সম্পর্ক, পছন্দ থেকে হয়। পছন্দ ছাড়া সম্পর্ক কী করে হয়। অরণ্য পছন্দ করতে শিখেছে। একটা সম্পর্কে জড়িয়েছে সে। ঘোরে রেখেছে সম্পর্ক।

প্রতিদিন একটু একটু করে পড়ে তা। মন থেকে শরীরে সেই পড়াশোনা স্থানারিত হয়। চারপাশকেও প্রভাবিত করে। প্রবল টান। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে সবকিছুর মাঝে। সময় হলে একদিন মাকে সেই সত্য শোনাবে।

পড়াশোনা শেষ করে বেকার জীবন কাটাতে হয়নি। চাকরি জুটেছে অরণ্যের। মন্দ নয়। প্রায় অর্ধ লাখ টাকা বেতন। শুরুতে এমন বেতন নিজের ওপর আস্থা বাড়িয়েছে। নিজে পাঁচ হাজার টাকা রেখে বাকি সব মায়ের হাতে তুলে দেয়। আপত্তি করেও নিবৃত্ত করতে পারেনি অরণ্যকে। যতদূর জেনেছে, মা সেই টাকা অরণ্যের নামে ব্যাংকে জমা রাখেন।

অফিস এসে কাজে মন বসাতে পারে না। প্রায়ই হচ্ছে। কিছুদিন ধরে ভালো একটা প্রেমের উপন্যাস খুঁজে না পাওয়ার ব্যর্থতা এখন কষ্টে পরিণত হয়েছে। আজকের মধ্যে পাওয়া দরকার। আজই হবে শেষ চেষ্টা।

বিশ্বাস, আজ পেয়ে যাবে সে। অফিসের বস অরণ্যের অন্যমনস্কতা হয়তো খেয়াল করেন। জানতে চান, কোনো সমস্যা? ওয়াশরুমে যেয়ে আয়নায় নিজের চেহারা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন, কোনো সমস্যা কোথাও লেখা আছে কিনা। অদ্ভুত ব্যাপার নিজের চোখে তেমন কিছুই পড়ে না। শুধু চোখের নিচে রাতজাগা সুরমার টান ছাড়া। ভালোবাসার মানুষটির জন্মদিন আটচল্লিশ ঘণ্টা পর। আজ উপন্যাস পাওয়া চাই।

রিসিপশন থেকে ফোন। একজন নারী সাক্ষাৎপ্রার্থী অরণ্যের। কে তার সঙ্গে অফিস পর্যন্ত দেখা করতে আসতে পারে, ভেবে অবাক। এমন কেউ নেই এই শহরে অফিস পর্যন্ত ছুটে আসবে অরণ্যের কাছে। এই অফিসের ঠিকানাও কেউ জানে না। রিসিপশনে এসে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো অবস্থা দাঁড়ায়।

কর্তব্যরত স্টাফ ইশারায় যাকে দেখাল, তিনি একজন অতীব সুন্দরী তরুণী। দূর থেকেই তার রূপ পরিমাপ করা সম্ভব। সেলফোনে কিছু দেখতে ব্যস্ত। হয়তো ফেসবুকিং চলছে।

মুহূর্তের মধ্যে একজন মানুষ কত কথা যে কতজনার সঙ্গে বলে, তার ইয়াত্তা নেই। কাছে আসে অরণ্য। দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চলে।

এক্সকিউজ মী!

নিজের কণ্ঠস্বর অপরিচিত শোনায়। বিস্ময় সেখান থেকে তরুণীর দিকে। অসম্ভব সুন্দর চাহনি। কাটাকাটা রূপের তরুণী মুখ তুলে তাকায়। যেন একমুঠো আলো ছুটে আসে অরণ্যের দিকে। দৃষ্টিতে কী ছিল কে জানে। মনটা নড়ে উঠল অরণ্যের। অপ্রত্যাশিত বিস্ময় চেপে ধরেছে।

সরি! আপনাকে বিরক্ত করছি। আমি কি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?

কে, কেন, কোথা থেকে এসেছে, এমন সব প্রশ্ন করার যথেষ্ট সুযোগ থেকে যায়। অরণ্য সেই দিকে হাঁটে না। ইচ্ছে হয় না। বিহ্বল দৃষ্টিতে তরুণীর কথা শুনতে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে সে যেন এরই মধ্যে।

ব্যাপরটা এমন যে, প্রস্তুতি হয়তো আগেই করে রেখেছে প্রকৃতি, অরণ্য টের পায়নি। এমন সুন্দরী তরুণীর কথা শুনতেই হয়। অফিসের ভেতরে নিতে ইচ্ছে হল না। যতজন সহকর্মী, তত রকম কৌতূহল মৌমাছির মতো মৌ মৌ করে। বরং অফিসের পাশে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান আছে, সেখানে যাওয়া যায়।

বসে কথা বলার ব্যবস্থাও আছে। ছোট ছোট দোকানগুলোতে আজকাল কাস্টমারকে বসার প্রাণান্তকর চেষ্টা করা হয় মূলত তরুণ ও তরুণীর কাছে দোকানকে জনপ্রিয় করে তুলার জন্য। ব্যবসার ফাঁদ।

ইদানীং মানুষের ব্যক্তিগত কথাবার্তার পরিমাণ বেশি। দেখা সাক্ষাতের নেপথ্যে এ কথা মুখ্য হয়ে ওঠে। ফাস্ট ফুডের দোকানে বসে শোনা শ্রেয়। বাধ্যগতের মতো তরুণী অরণ্যকে অনুসরণ করে।

ফাস্ট ফুডের দোকানে মুখোমুখি বসে। এরকমভাবে কোনো তরুণীর সঙ্গে এই প্রথম বসা। অস্বস্তি নেই, লাজুক প্রকৃতির আড়ষ্টতা আছে। দু’কাপ কফির অর্ডার হল। অরণ্যই শুরু করে,

বলুন।

আপনি সিঁড়িকে ভালোবাসেন। সিঁড়ি নাম উচ্চারিত হতেই অরণ্যের শরীর ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে যায়। গত কিছু দিন ধরে ভালো প্রেমের উপন্যাস খুঁজে ফেরার গল্পগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল।

তার ভেতর বড় ধরনের একটা ভূকম্পন অনুভূত হল। চারপাশ পরিপাটি ছিল। হঠাৎ নেই যেন, অগোছালো হয়ে গেল। কেমন এক অজানা আশঙ্কার দোলা। কে এই তরুণী, কী করে চেনে সিঁড়িকে।

সিঁড়ি কিন্তু আপনাকে ভালোবাসে না। সে আরেকজনকে ভালোবাসে। সে আপনার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করে। তোতা পাখির মতো মুখস্থ বলছে তরুণী। কী সর্বনাশা কথা। এমন কথা বলবার সাহস কে দিল এ তরুণীকে। সিঁড়ির সঙ্গে অরণ্যের সম্পর্ক নষ্ট করার পাঁয়তারা কিংবা শত্র“তা নয়তো!

আপনি আমাকে এসব কথা বলতে এসেছেন! কে আপনি? আমাকে কীভাবে চেনেন।

খুব স্বাভাবিকভাবে বসে থাকা তরুণী একটু নড়ে বসল। কফির কাপ থেকে এক চুমুক কফি টেনে তরুণী বলে,

আমি সিঁড়ির বান্ধবী।

বান্ধবী হয়ে বান্ধবীর সর্বনাশ করতে এসেছেন!

ঠুনকো ভালোবাসেন যে, আমার কথায় আপনার ভালোবাসা নষ্ট হয়ে যাবে! বেশ শব্দ করে হাসে তরুণী। বলে, না। না তো।

আমি সিঁড়ির উপকার করার জন্য এসেছি। সেইসঙ্গে আপনারও। সোজাসাপ্টা জবাব তরুণীর। তরুণীর মুখ থেকে বাকি অংশ শোনার ব্যাকুল প্রতীক্ষায় অরণ্য।

আপনি সিঁড়ির জীবন থেকে সরে না গেলে, সে বিপদে পড়বে। একদিকে আপনি, আরেকদিকে তার ভালোবাসার মানুষ। সিঁড়ির ভালোবাসার মানুষ, কথাটা অরণ্যের কানে আছড়ে পড়ল। অরণ্যের মনে উঁকি দিল, সিঁড়ি কী এই তরুণীকে তার কাছে পাঠিয়েছে তবে। অরণ্য যেন সিঁড়ির জীবন থেকে সরে যায় নিজ থেকে।

সিঁড়ি আদৌ ভালোবাসেনি অরণ্যকে, সেই সত্যটাই জানাতে পাঠিয়েছে এ তরুণীকে, তাই কী? তবে কী অন্য কাউকে ভালোবাসে সিঁড়ি, যা জানে না অরণ্য। কোনোভাবেই জানতে পারেনি। সম্পর্ক যেন অথৈ সাগরে ডুবে যেতে নিয়েছে। রক্ষা না করলে, নির্ঘাত সাগরে তলিয়ে যাবে।

বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। মুখ ফসকে অরণ্যের মুখ থেকে বের হয়ে এলো, আপনি নিশ্চয়ই জানেন সিঁড়ি কাকে ভালোবাসে, তার পরিচয়? অরণ্যের এমন প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিল তরুণী। সেটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল। আমি জানতাম, এমন প্রশ্ন আপনি আমাকে করবেন। না করে মহত্ত্বের পরিচয় দিতে পারবেন না। কেউ তা পারে না।

আমি কী আরেক কাপ কফি পেতে পারি? নিশ্চয়ই। অরণ্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আরেক কাপ কফির অর্ডার হয়। তরুণী বেশ সরাসরি তাকাতে পারেন। অরণ্য কিছুটা গুটিয়ে নেয়।

সিঁড়ির দিকেও অপলকে তাকাতে পারেনি কখনও। কফির কাপে ঠোঁট ছুঁয়ে নিজেকে রিচার্জ করল। আমি তো ধারণা করেছিলাম আপনি তাকে চেনেন, জানেন। যাক। কেমন লাগছে এসব শুনে?

কেমন লাগার কথা? কেমন লাগবে? পাল্টা প্রশ্ন অরণ্যের।

বিশ্বাস খানখান হয়ে যাওয়ার কথা। কেউ আপনাকে ঠকাচ্ছে, এটা নিশ্চয়ই সুখের নয়। সহ্য করার নয়। ভালোবাসার নয়। ঠিক? তরুণী গুরুদায়িত্ব নিয়ে এসেছে ভাবটা এমন এবং তা ক্রমশ দৃশ্যমান করতে শুরু করেছে।

সত্যিই ভালো লাগছে না কিছুই অরণ্যের। অবিশ্বাস, অজগরের মতো সব শরীর পেঁচিয়ে ধরেছে। সাপের বিষের চেয়েও অবিশ্বাস বেশি বিষাক্ত। বিষ ছড়িয়ে গেছে শরীরজুড়ে। আপন মনে হয় এ তরুণীকে। মুহূর্তের পরিবর্তন। কী অদ্ভুত।

চেনা নেই, জানা নেই, দেখাও নেই কখনও, এমন একজনকে এত দ্রুত বিশ্বাস করে ফেলে অরণ্য। সিঁড়ির কাছ থেকে ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বেদনা হতে পারে। কিংবা অতি সুন্দর নারীর প্রতি এও এক আকস্মিক দুর্বলতা।

কথার মাঝে হালকা মাত্রার বিরতি। অরণ্য কী কথা বলবে, ভেবে পায় না। শুকনো কাঠে কেরোসিন ঢেলে কে যেন দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে দিল। দিনটা ঘুরপাক খাচ্ছে একই জায়গা দাঁড়িয়ে সমানে।

সময় পাড় করার উপায় কী। কফির পেয়ালা শূন্য করে তরুণী উঠে দাঁড়ায়। ঠোঁটে মৃদু হাসি মেখে নেয়। তরুণীর কথা পিলে চমকে ওঠার মতো। তরুণী বলে চলেছে,

বাজি ধরে এসেছিলাম। সিঁড়ির বিশ্বাস ছিল, সে অরণ্যকে ভালোবাসে, এ কথাটাই কেবল অরণ্য বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে বেঁচে আছে। তার ভালোবাসার মতোই অরণ্য স্বচ্ছ। আমি বলেছিলাম, ভুল। সম্পূর্ণ ভুল ধারণা সিঁড়ির। তরুণীর ভুল শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে রহস্য মেখে ছিল। অরণ্যের চোখে চোখ রেখে তরুণী বলে,

ভালোবাসার সঙ্গে শুধু বিশ্বাস নয়, অবিশ্বাসও থাকে। মানুষ বোকার মতো শুধু বিশ্বাসকে মেনে নেয়, অবিশ্বাসকে নয়। সিঁড়ি বোকার মতো আপনাকে ভালোবেসে বিশ্বাসকেই গ্রহণ করেছিল।

আর আপনি? আমার সামান্য সাক্ষাতে ওকে অবিশ্বাস করে ফেললেন! জানতে চাইছিলেন, সিঁড়ি কাকে ভালোবাসে? আশ্চর্য! সিঁড়ি এ জগতে যে মানুষকে শুধুই ভালোবেসেছে, সে অরণ্য।

যদি কেউ সিঁড়িকে বলত, অরণ্য আর কাউকে ভালোবাসে, সিঁড়ি তা বিশ্বাস করত না। ভালোবাসা কখনও ভাড়া বাসায় বসবাস করে না। নিজের বাসায় বসবাস করে, নিজ ঘরেই তার মৃত্যু হয়।

কথাটা বলে তরুণী আর দাঁড়ায় না। যাওয়ার সময় কফির বিল পরিশোধ করে যায়।

অরণ্য দেখতে পেল, রাস্তার ওপারে সিঁড়ি দাঁড়িয়ে। তরুণী সিঁড়িকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় অতঃপর।

(স্বপ্না রেজা)

পিবিএ/এফএস

আরও পড়ুন...