বর্তমান বাস্তবতায় ন্যূনতম সংস্কারের মাধ্যমে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া জরুরি। নয়তো সংকট আরও বাড়বে। এ মন্তব্য এসেছে ঢাকায় এক গোলটেবিল বৈঠকে।
বক্তারা বলেছেন, রাষ্ট্রকে জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে সংস্কার প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলে সংস্কার না আনলে অন্য কোনো সংস্কারই স্থায়ী হবে না বা থাকবে না।
শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ কোন পথে’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা। জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে সাপ্তাহিক একতা।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ রাজনৈতিক দলের নেতাদের অবসরের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, একজন নেতা হলেন আর তিনি স্থায়ীভাবে পদ পেলেন, এটা ঠিক নয়। পদে স্থায়ী হওয়ার ভাবনা থেকেই স্বৈরতন্ত্রের জন্ম হয়। তাই রাজনৈতিক দলের প্রতিটি স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকা দরকার। এই প্রতিনিধির বয়সসীমাও নির্ধারিত হওয়া উচিত।
রাজনৈতিক দলের সংস্কারে জনমত তৈরি করার আহ্বান জানিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, একটি জাতীয় পর্যায়ের দল হতে হলে এর মধ্যে সব ধর্ম, জাতি ও লিঙ্গের ভারসাম্য থাকা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে জনগণের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ হবে না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি শাহ আলম দ্রুত নির্বাচনের পথে যাওয়ার আহ্বান জানান। নয়তো সংকট আরও বাড়বে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি স্বীকার করেন, জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রথম পর্বটি তাঁরা ধরতে পারেননি। এ জন্য ডানপন্থীরা শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে দ্বিতীয় পর্বে বাম গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তৈরির ওপর জোর দেন তিনি।
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান বলেন, অতীতের সামরিক সরকারগুলোও সংবিধান নতুন করে তৈরির চেষ্টা করেনি। তারা সংবিধান বাতিল রেখে শাসন চালিয়েছে। এখন সংবিধান নতুন করে লেখার চেষ্টা হচ্ছে। তিনি বর্তমান সংবিধানের চার মূলনীতি পরিবর্তনের প্রস্তাবের সমালোচনা করেন।
সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু ন্যূনতম সংস্কার করে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের দ্বার খুলে দেওয়ার আহ্বান জানান।
অধ্যাপক তাজুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারের আমলে লুটপাট করার সুযোগ তৈরির জন্যই গণতন্ত্রহীন রাখা হয়েছিল। সুতরাং নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। দুই, তিন কিংবা চারটা নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসবে বলে তিনি মত দেন।
১৭ বার কাটাছেঁড়া করার পরও সংবিধানে অনেক ভালো ভালো কথা লেখা আছে। কিন্তু কেউ তা মানছে না বলে মন্তব্য করেন বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ। তিনি বলেন, আজকে যে সংস্কার প্রস্তাব এসেছে, তা ভবিষ্যতে মানবে, এর নিশ্চয়তা কী? তাই রাজনৈতিক দলে সংস্কার দরকার।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, তাঁদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা আশ্বাস দিয়েছিলেন, রাজনৈতিক দলসহ যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলোই সংস্কার করা হবে। আর দ্বিমত হলে তিনি আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। এটাই যেন বহাল থাকে। তিনি দ্রুত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার বিষয়ে আলোচনা শুরুর তাগিদ দেন।
গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সাপ্তাহিক একতার সম্পাদক ও সিপিবির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আফরোজান নাহার রাশেদা। আরও বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ জাসদের নেতা মুশতাক হোসেন, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান প্রমুখ। সমাপনী বক্তৃতায় আলোচকদের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেন আফরোজান নাহার রাশেদা।
গোলটেবিল বৈঠকে সংবিধান ও নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতিসংঘের সাবেক উন্নয়ন গবেষণাপ্রধান এবং ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান গ্রোথের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। এ ছাড়া বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও আর্থসামাজিক সংস্কার বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এম আকাশ।
নজরুল ইসলাম তাঁর প্রবন্ধে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে সংবিধান প্রস্তাব নতুন করে লেখার প্রয়োজন আছে কি না, সে প্রশ্ন তোলেন। তবে জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে সংস্কার হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার বিষয়ে বলেন, কেন বাংলাদেশে এ ধরনের আইনসভা দরকার, তা স্পষ্ট করা হয়নি। দুই কক্ষের এখতিয়ার ও ক্ষমতার ভাগাভাগি কীভাবে হবে, তা–ও পরিষ্কার করা হয়নি।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হচ্ছে আনুপাতিক নির্বাচন। সংস্কার কমিশন উচ্চকক্ষে আনুপাতিক হারে সদস্য নির্বাচনের কথা বলেছে। আসলে নিম্নকক্ষের জন্য আনুপাতিক সদস্য নির্বাচন করা সবচেয়ে জরুরি।
সংবিধান ও নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, সেগুলো ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক নজরুল। তবে জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ গঠনের যে কথা বলা হয়েছে, তাতে এটি ক্ষমতার আরেকটি ভরকেন্দ্র হয়ে উঠে কি না, সেই আশঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি।
আর্থিক খাত, জ্বালানিব্যবস্থা ও বাজারব্যবস্থার সংস্কার জরুরি বলে তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেন অধ্যাপক এম এম আকাশ। তিনি বলেন, নয়তো সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। যার লক্ষণ ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে।
এম এম আকাশ তাঁর প্রবন্ধে আরও বলেন, বিগত সরকারকে অন্যায়ভাবে সহায়তা করা পুলিশ, শিক্ষা কর্মকর্তা, আমলা ও ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে তালিকা করে বিচার করতে হবে। লঘু অপরাধীদের উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে বিচার (মব জাস্টিস) ছেড়ে না দিয়ে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া বিপুল পরিমাণ যে টাকা পাচার হয়েছে, তা কীভাবে উদ্ধার করা হবে, সে বিষয়ে জোর দিতে হবে।
প্রবন্ধের শেষের দিকে এম এম আকাশ তাঁর প্রত্যাশা হিসেবে লেখেন, ‘ভবিষ্যৎ যত অনিশ্চিতই হোক না কেন, অন্তত যেন মুক্তিযুদ্ধের মতো মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে কোনো নতুন বাগ্বিতণ্ডা ও গৃহযুদ্ধ না হয়, সেটাই কাম্য।’
দুটি মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শ্বেতপত্রে দেখানো হয়েছে যে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। এই টাকা ফিরিয়ে আনতে গেলে পাচারকারীরা একত্র হয়ে বিরোধিতায় নামবে। তবে এর জন্য পিছিয়ে যাওয়া যাবে না। টাকা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
বর্তমান সরকারের ওপর টাকা আয়ের চাপ আছে, এ কথা উল্লেখ করে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক দিয়ে আয় বাড়ানো যাবে না। প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে দেশে যে কর ফাঁকির একটা প্রবণতা চলে এসেছে, এই জায়গায় চাপ দেওয়ার একটা সুযোগ এই সরকারের ছিল। তারা শুরুতেই সেটি হাতছাড়া করেছে। তবে এখনো সময় আছে।