গাজী মনিরুজ্জামান,খুলনা ব্যুরো: সুন্দরবন পর্যটকদের কাছে প্রকৃতির এক অপর বিস্ময়ের নাম। পৃথিবীর অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রগুলো থেকে সুন্দরবন একদম স্বতন্ত্র। বাঘ, হরিণ, কুমির, বানরসহ নানা প্রজাতির মাছ, সরীসৃপ ও পাখির আবাসস্থল সুন্দরবন।
কোলাহলমুক্ত নির্মল পরিবেশ, সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য, নদী-খালে জোয়ার-ভাটার খেলা, অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও বনজীবীদের জীবনসংস্কৃতি দেখতে প্রতিবছর সুন্দরবনে আসেন কয়েক লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটক।
ইট-পাথরের ব্যস্ত শহরের বাইরে নির্জন বনভূমিতে নিজেকে নতুন করে খুঁজে ফেরেন পর্যটকরা। বন্যপ্রাণীর পদচারণা, পাখি দেখা, বনের নির্জনতা উপভোগ করতে ফুট ট্রেইল, ওয়াচ টাওয়ার, ঝুলন্ত ব্রীজ, গোলঘর, ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার (তথ্যকেন্দ্র) ও স্যুভেনির শপ রয়েছে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে।
ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ^ ঐতিহ্য, জীব-বৈচিত্রের প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা, নদী নালা ও খালে বিছানো সুন্দরবন বিশে^র একক ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেষে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় অবস্থিত। রায়মঙ্গল ও হাড়িয়াভাঙ্গা নদী সুন্দরবনকে বাংলাদেশ ও ভারতের অংশে বিভক্ত করেছে।
সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশে এবং বাকীটা ভারতে। ম্যানগ্রোভ বনের বৈশিষ্ট হলো উজানে মিষ্টি পানির প্রবাহ, ৬ ঘন্টা পরপর সামুদ্রিক লবনাক্ত পানির জোয়ার-ভাটা, শ^াসমূল এবং গাছে থাকতে বীজের অঙ্কুরোদগম।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা খুলনা অফিস সূত্রে জানা যায়, সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত সুন্দরবনে প্রায় ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। এদের মধ্যে ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৮ প্রজাতির উভচর। এছাড়া ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড রয়েছে। আর প্রায় ৪৫০টি নদ-নদী ও খালে রয়েছে প্রায় ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া ও ৪২ প্রজাতির শামুক ঝিনুক, যা পর্যটকদের কাছে আকর্ষনীয়।
সূত্র আরো জানায়, প্রতিবছর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস সুন্দরবন ভ্রমণের সেরা সময়। এ সময় নদী ও সমুদ্র শান্ত থাকে বলে সুন্দরবনের সব দর্শনীয় জায়গা সহজেই ঘুরে দেখা যায়।
বন অধিদপ্তর সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় পর্যটকবান্ধব ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র্র গড়ে তোলা হয়েছে করমজল, হারবাড়িয়া, আন্ধারমানিক, কটকা, কচিখালী, আলিবান্দা, দুবলা, নীলকমল, শেখেরটেক, কলাগাছিয়া, দোবেকী ও কালাবগীতে। এর মধ্যে নতুন চারটি পর্যটনকেন্দ্র পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। আন্ধারমানিক, আলিবান্দা, শেখেরটেক ও কালাবগী-এসব কেন্দ্রে এক দিনে গিয়ে সুন্দরবন দেখে ফেরত আসা যায়।
গত ২৭ জানুয়ারি খুলনা প্রেসক্লাবের শতাধিক সদস্যের একটি টিম সুন্দরবন ভ্রমণে যায়। তিন দিনের এই ভ্রমণে সুন্দরবনের অভয়ারণ্য আন্ধারমানিক, কচিখালী, কটকা, ডিমেরচর, জামতলা সি বিচ এবং করমজল পর্যটন স্পটে প্রচুর পরিমাণে পর্যটক দেখা যায়। পর্যটন স্পটগুলোতে প্রতিদিন সাত-আটটি ছোট-বড় ভেসেল জাহাজ নোঙর করতে দেখা গেছে। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকে স্পটগুলো বলে জানিয়েছেন ট্যুর গাইডরা।
পর্যটকদের কাছে সরাসরি সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী দেখা রোমাঞ্চকর। আন্ধারমানিক, কচিখালী, কটকা, ডিমেরচর, জামতলা সি বিচে যাওয়ার পথে দেখা মিলেছে বানর ও হরিণের দলবদ্ধ ছোটাছুটি, বন্য শুকর, সুন্দরবনের বিলুপ্তপ্রায় বিশাল আকৃতির মদনটাক ও ঈগলের। সকালে করমজলের খালের পাড়ে বিশাল আকৃতির দুটি কুমিরকে রোদ পোহাতে ও আরেকটি কুমিরকে পানিতে ভেসে থাকতে দেখা যায়। যা সবাইকে রোমাঞ্চিত করে। এছাড়াও নদীতে ডলফিনের ডুব সাঁতার ছিল হৃদয়কাড়া। সুন্দরবনের নদী, খালে সাদা বক, মাছরাঙা, শঙ্খচিল, গাংচিলের মাছধরা ও ওড়াউড়ি ছিল চোখে পড়ার মতো। সুন্দরবনের লক্ষীপেঁচা, দোয়েল, মৌটুসিসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কলরবও ছিল মনোমুগ্ধকর।
খুলনা প্রেস ক্লাব থেকে আসা পর্যটক ও খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বাঞ্চল-এর সম্পাদক মোহাম্মদ আলী সনি বলেন, বই পুস্তকে সুন্দরবন সম্পর্কে পড়া আর সচক্ষে সুন্দরবন ঘুরে দেখা তার চেয়ে বেশি রোমাঞ্চকর ও মনোমুগ্ধকর। তিনি জানান, প্রকৃতির কোলে নিজেকে নতুন করে আবিস্কার করতে হলে সুন্দরবনের বিকল্প নেই।
ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের (টোয়াস) সাধারণ সম্পাদক এবং রূপান্তর ইকোট্যুরিজমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান ডেভিড বলেন, লাক্সারি লঞ্চগুলোতে ভালো পর্যটক হচ্ছে। তবে ছোট ছোট লঞ্চে তেমন পর্যটক নেই। আন্ধারমানিক, কচিখালী ও কটকা পর্যটনকেন্দ্রে এ বছর পর্যটকদের আগ্রহ বেশি। এছাড়া সুন্দরবনের প্রবেশমুখ করমজল পর্যটন স্পটে স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা বেশি যাচ্ছেন।
সুন্দরবন খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, সুন্দরবন যেহেতু জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এলাকা ও এখানে অনেক বিরল বিপন্ন প্রাণী আছে। কাজেই পর্যটকদের রাতে থাকার জন্য বনের অভ্যন্তরে কটেজ নির্মাণ করা হয়নি। এটা বিজ্ঞানসম্মতও নয়। যারা লঞ্চযোগে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে যাবেন, তারা রাতে বেলা বনে অবস্থান করতে পারবেন না, তবে লঞ্চে অবস্থান করতে পারবেন। তিনি বলেন, সার্বিকভাবে ইকো-ট্যুরিজম পর্যটকবান্ধব অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও নতুন কয়েকটি ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি আরো জানান, পর্যটনের জন্য বন বিভাগের পক্ষ থেকে রাজস্ব টার্গেট থাকে না। আমরা চাই সহনশীল মাত্রায় সুন্দরবনে পর্যটক আসুক। যাতে করে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব না পড়ে। কারণ, সুন্দরবন একটি সংরক্ষিত বন। এটি বিশ্ব ঐতিহ্য। এই বনকে সুরক্ষিত রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব।