দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন

হাসিনার শাসনামল ছিল স্বৈরতন্ত্র, সহিংসতা ও দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের ক্ষমতায় এসেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সোমবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরোপুরি সক্রিয় হতে পারেনি। পুলিশের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা সরকার পতনের পর থেকে এখনও কাজে যোগ দেননি।

পুলিশের যথাযথ সক্রিয়তার অভাবে বাংলাদেশের সর্বত্র সব সবধরনের অপরাধ বাড়ছে, গোষ্ঠীবদ্ধ অপরাধও (গ্যাং ক্রাইম) বাড়ছে ব্যাপক হারে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহম্মদ ইউনূসের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থী-জনতার ব্যাপক অভ্যুত্থানের মুখে টিকতে না পেরে গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা; এখনও সেখানেই আছেন তিনি।

তার বিদায়ের মধ্যে দিয়ে পতন ঘটে বাংলাাদেশে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের। হাসিনার দেশত্যাগের ৩ দিন পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন বিশ্বখ্যাত বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনূস, যিনি ‘দরিদ্রদের স্বাবলম্বী করতে ক্ষুদ্রঋণ’ প্রকল্পের ধারণা আবিষ্কার ও প্রয়োগের জন্য ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল জয় করেছেন।

৮ আগস্ট যখন তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন, তখনও অভ্যুত্থানের ধকলে বিবর্ণ বাংলাদেশ। সড়ক-মহাসড়ক রক্তে ভেজা; হাসপাতালের মর্গে পড়েছিল ১ হাজারের বেশি মানুষের লাশ, যারা শেখ হাসিনার নেত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে জীবন দিয়েছেন।

দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করেছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তারপরও বরাবরই তাকে রাজনৈতিক হুমকি বলে মনে করতেন শেখ হাসিনা। এ কারণে বছরের পর বছর ধরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের হয়রানি-অপমান-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। গত ১৫ বছরের বেশিরভাগ সময়ই অবশ্য বাংলাদেশের বাইরেই কাটিয়েছেন ইউনূস।

কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা যখন তাকে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হওয়ার আর্জি জানান, তিনি তাতে সম্মতি জানান। ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘বিগত ১৫ বছরে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা বিশাল এবং অভূতপূর্ব। বিগত সরকার দেশকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলেছে। বাংলাদেশ এখন আরেকটি গাজা। বিগত সরকার এই দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠান, নীতি, জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে ধ্বংস করে ফেলেছে।’’

প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের শাসনামল ছিল স্বৈরতন্ত্র, সহিংসতা এবং দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ। বিশেষ করে শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থান দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে যে ১ হাজার ৪ শতাধিক নিহতের ঘটনা ঘটেছে, সেজন্য জাতিসংঘও তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করেছে। হাসিনা অবশ্য সব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন।

মুহম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার পর অনেকেই আশা করেছিলেন, বাংলাদেশে একটি নতুন যুগের সূচনা ঘটতে চলেছে। কিন্তু আজ ছয় মাস পর আপনি যদি ঢাকার সড়কে হাঁটেন, তাহলে অনুভব করবেন যে দেশটি ফের খাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশে যদিও ইউনূসের প্রতি ব্যাপক শ্রদ্ধা ও গ্রহণযোগ্যতা এখন পর্যন্ত রয়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে এও সত্য যে অপরাধ দমন ও শান্তি রক্ষায় তার নেতৃত্বাধীন সরকারের ক্ষমতা নিয়ে ওঠা প্রশ্ন দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

এর একটি বড় কারণ, শেখ হাসিনার শাসনামলে যারা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ ও নীতি নির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন ধরা পড়েছেন এবং বাকিরা সবাই আত্মগোপনে আছেন। ফলে সার্বিক চেইন অব কমান্ডে একধরনের ফাঁকা ভাব বা শূন্যতা দেখা দিয়েছে, যা নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির জন্য দায়ী। ঢাকার রাস্তাঘাটে ব্যাপকভাবে বাড়ছে সংঘবদ্ধ অপরাধ বা গ্যাং তৎপরতা। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অভিযোগে সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা।

অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বর্তমানে নবগঠিত রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির (এনসিপি) প্রধান নাহিদ ইসলাম দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘‘বর্তমানে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবস্থা, তাতে শিগগিরই একটি অবাধ ও মুক্ত নির্বাচন হওয়া অসম্ভব।’’

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্ক্ষলা রক্ষার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান বলেছেন, ‘‘দেশ নৈরাজ্যের দিকে চলছে’’ এবং যদি এটি অব্যাহত থাকে, তাহলে বাংলাদেশের ‘‘স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংকটের মুখে পড়বে।’’

গার্ডিয়ানকে অবশ্য ইউনূস বলেছেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ‘খুবই ভালো’ এবং সেনাপ্রধানের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত তার কাছে ‘কোনো চাপ আসেনি।’

আরও পড়ুন...