মুহাম্মদ আবুল হুসাইন
স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার আগ থেকেই দেশের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বখতিয়ারের মনটা আনচান করছে। সময় যেন আর শেষ হতে চায় না, নচ্ছার পরীক্ষাটা যে কবে শেষ হবে আর কবে যে সে দাদা-দাদীর কাছে যেতে পারবে, এ নিয়ে তার অস্থিরতার যেন আর শেষ নেই। আলী আর রাইয়ানের অবস্থাও একই। দাদী আর তুপ্পির জন্য তাদের ছোট্ট মনটাও নাকি কেমন যেন খালি আকুলি-বিকুলি করে। আব্বুকে কেবলই প্রশ্ন করে, আব্বু আমরা কবে দেশে যাবো? কিন্তু আব্বু যতই বলেন, এই তো বাবা, পরীক্ষাটা আগে শেষ করো, তারপরই আমরা দেশে যাবো; কিন্তু এসব বুঝা সত্তেও তাদের ছেলেমানুষি আর অস্থিরতা যেন ততই আরো বেড়ে যায়। দাদীর জন্য আর বিশেষ করে তুপ্পির জন্য তাদের তিনজনেরই পরাণটা নাকি কেবলই আনচান করে। এখানে বলে রাখা ভাল, আলী-বখতিয়ারের তুপ্পি মানে হল তাদের ফুপু বা ফুপ্পি। পিচ্চি সময়ে বখতিয়ার তার ফুপ্পিকে ডাকতো তুপ্পি বলে। এরপর তার দেখাদেখি আলীও তুপ্পি ডাকে এরপর ছোট্ট রাইয়ানও তার কচি মুখে তুপ্পি ডাকা শিখেছে। এখনতো আলী-বখতিয়ার অনেকটা বড় হয়েছে, কিন্তু তুপ্পি ডাকটা তারা আর বদলাতে রাজি নয়। তুপ্পি ডাকটাই নাকি তাদের বেশি ভাল লাগে! আর তাদের ফুপু সায়মাও তার ছোট ভাইপোদের এই আদুরে ডাকে খুব খুশি। সেও তাদের ছোট কালের কচি মুখের এই ডাকটাকে ধরে রাখতে চায়। তাই তাদেরকে কেউ সংশোধন করে দিতে গেলে সেও বাধা দেয়।
শহরের বৈচিত্রহীন নাগরিক জীবনের মধ্যে বন্দী থাকতে থাকতে বড়রাই তো হাঁপিয়ে ওঠে, তারপরে ওরা তো ছোট মানুষ! গ্রামের মেঠোপথ, খোলা মাঠে প্রাণ খুলে দৌড়ঝাপ ও সতেজ বাতাসে নিশ্বাস নেয়ার জন্য স্কুল বন্ধের এই সময়টাতে তাই তারা অস্থির-চঞ্চল হয়ে ওঠে। তাই বার্ষিক পরীক্ষা শুরুর আগ থেকে তিন ভাই’র চলছিল বাড়িতে যাওয়ার হিসেব-নিকেষ, পারলে এখনই উড়াল দেয় আর কি!
কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পরীক্ষাটা। বখতিয়ারের তো পরীক্ষাটার উপর রীতিমত রাগই হচ্ছিল, নচ্ছার পরীক্ষাটা তাড়াতাড়ি শেষ হবে তা না!
আর আলীর কাছে তো এটি রীতিমত একটি গায়ের জ্বরের মত। যত তাড়াতাড়ি এই জ্বর সারে ততই যেন সে বাঁচে। রাইয়ানের অবশ্য পরীক্ষা-টরীক্ষার কোন চিন্তা নাই।
দাদী ও তুপ্পির মায়াবী মুখের মত গ্রামের শ্যামল-সবুজ রূপও বখতিয়ার ও আলীকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ, সবুজ বৃক্ষের সাড়ি, নদীর বুকে পাল তোলা নৌকা, ছায়াঢাকা-পাখি ডাকা গ্রামীণ মেঠো পথ, পথের পাশেই মাঠ জুরে চোখ জুড়ানো ঝলমলে শর্ষেফুলের ঢেউ, কলাই-কলমি লতার নীলাভ সফেদ ফুল, পুকুরের শাপলা এমনকি কচুরি পানার চমৎকার ফুল – এসব তো শহরের একঘেয়ে পরিবেশে কল্পনাও করা যায় না। আর পুকুরে সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, নৌকা চালানো, মাঠে আর মেঠোপথে ছুটে চলার আনন্দও তো বছরের এই কটা দিন ছাড়া তারা পায় না।
গ্রামের বাড়ি যেতে দুই ভাইয়ের সবচেয়ে প্রিয় বাহন হল স্টীমার আর পাল তোলা নৌকা। আজকাল সড়ক পথেও দেশে যাওয়া যায়, কিন্তু সড়ক পথের চেচামেচি, যানজট, কালোধোঁয়া ওদের একেবারেই অপছন্দ। তাই প্রতিবারেই দেশে যাওয়ার সময় নদীপথে যাওয়ার জন্য বখতিয়ার ও আলী তাদের আব্বুকে আগে থেকেই বিশেষ ভাবে বলে রাখে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বলা যায় তাদের নোটিশ পেয়েই আব্বু স্টীমারের টিকিট কাটতে বাধ্য হয়েছেন।
আসলে নদীপথে ভ্রমণের মজাই অন্যরকম। একদিকে সড়ক পথের নানা বিড়ম্বনা থেকে বাঁচা যায়, তেমনি নদীপথের ভ্রমণে অনেক বেশি আনন্দ ও বৈচিত্র উপভোগ করা যায়। কত কী যে দেখা যায়! নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা হাট-বাজার, শহর-বন্দর, গ্রাম কত কিছু যে চলচ্চিত্রের মত একের পর এক চোখের সামনে এসে পড়ে!
নৌকায় করে জেলেদের মাছ ধরা, ধানি জমি, কৃষকের ব্যস্ততা, নদীর ঘাটে কলসীতে পানি ভরছে গ্রামীণ বধু-বালা, উঠোনে ধান রোদ দিচ্ছে কৃষকের বউ-ঝি, ইটের ভাটা, কল-কারখানায় শ্রমিকের ব্যস্ততা, লাইন ধরে মালামাল উঠা-নামা, মাটি কাটার দৃশ্য, গয়না নৌকায় করে দূর-দূরান্তে পণ্য বয়ে নেয়া, পাল তোলা নৌকায় মাঝি-মাল্লার গান এক কথায় নদীমাতৃক পুরো রূপসী বাংলাকেই যেন দেখা হয়ে যায়!
আর গাঙচিলের উড়াউড়ি! সে কথা বলতে তো ভুলেই গেছি! আর জেলে নৌকাগুলোতে জ্যান্ত ইলিশ যখন লাফালাফি করে আর সে সময় সোনালী রোদ ইলিশের রূপালী গায়ে পড়লে যে চোখ ধাঁধাঁনো দৃশ্যের সৃষ্টি হয়, তা নদীভ্রমণ না করলে তুমি দেখবে কীভাবে?
এতো গেল সকালে বা দূপুরে নদী ভ্রমণের মজা। কিন্তু এসবকে পেছনে ফেলে বিকেলে স্টীমারটি যখন মাঝ নদীতে প্রবেশ করে তখন হয় এক অন্যরকম অনুভূতি। যতদূর চোখ যায় শুধু বিশাল জলরাশি। আর দূরে, বহু দূরে নদীতীরের গ্রামগুলোকে তো মনে হয় একটি কাজল রেখার মত। আর আকাশটা যেন মিশে গেছে নদীর সেই তটরেখায়। উপরের বিশাল নীলাকাশ আর নিচের বিশাল জলরাশি উভয়েই যেন মিশে গেছে একাকার হয়ে। প্রকৃতির এই অপূর্ব রূপ ও রহস্য নদীপথে ভ্রমণ না করলে কি বুঝা যায়?
বিকেল বেলা চা-নাস্তা সেরে রাইয়ান আর বখতিয়ার-আলী যখন আব্বুর সাথে স্টীমারের ডেকের উপর রেলিং ধরে দাঁড়ালো তখন আকাশের কী রূপ! বখতিয়ার তো তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল। পাশ্চিমাকাশে সূর্যটা তখন কেবল হেলতে শুরু করেছে, সাদা সাদা মেঘগুলো সুনীল আকাশের চির চেনা সৌন্দর্য প্রকাশ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল স্থির হয়ে। যখন সূর্য ডুবতে শুরু হল এক অপূর্ব রঙের খেলা। কিছুক্ষণের মধ্রেই সাদা মেঘগুলো হলুদ ও কমলা রঙের মিশ্রণে চমৎকার রূপ ধারণ করল। তার কিছুক্ষণ পরই সেগুলো ধারণ করল লাল ও কমলা রঙ। তার একটু পর কে দিল ধূসরের উপর লালচে রঙের প্রলেপ। এভাবে এক রহস্যের মায়াজাল সৃষ্টি করে সূর্যটা ডুবা শুরু করল। আর নদীর বুকে বসে সূর্যাস্তের এই দৃশ্য দেখে বখতিয়ার আর আলী দু ভাইয়েরই মুখ থেকে বেরিয়ে এল একটি শব্দ ‘অপূর্ব’। আলী বলল, ঠিকই বলেছো ভাইয়া, আকাশের গায়ে রঙের এত নিপুণ আলপণা, আমার কাছে মনে হচ্ছে, এ যেন কোন এক মহান শিল্পীর আঁকা এক অপূর্ব শিল্পকর্ম।