মো. নুরুল করিম আরমান, লামা, বান্দারবান: বাঁচতে হলে কাজ করতে হবে, এমন প্রতিজ্ঞা করেই যেন বৈষম্যময় পরিবেশ মেনে নিয়েই কাজে নামেন বান্দরবানের লামা ও আলীকদম উপজেলার প্রায় ২ হাজারেরও বেশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ও বাঙ্গালী নারী শ্রমিক। কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে লড়াই করে কাজ করে চলছেন তারা। কখনও সমান কিংবা কখনো বেশি কাজ করছেন এ নারী শ্রমিকরা। আবার এই নারীদেরই জীবিকার জন্য মাঠে-ঘাটে কাজ করলেই শুধু চলে না, তারা বাইরের হাড়ভাঙা খাটুনির পর ঘরে ফিরে সংসারও সামাল দিচ্ছেন। যেন কোনো মানুষ নন তারা, তারা দম-দেওয়া মেশিন। ক্রমাগত কর্মের প্রহারে পাংশু তাদের জীবন। ঘরের কাজে যেমন স্বীকৃতি নেই, তেমনি বাইরের কাজেও ন্যায্য মজুরি থেকে তাদের হতে হচ্ছে বৈষম্যের শিকার।
আবার বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি নারী শ্রমিকদের কাজের গতি ও ধরন দেখে বোঝার উপায় নেই নারী-পুরুষের কাজের পার্থক্য। নারী শ্রমিকদের পুরুষের সমান পারিশ্রমিক প্রদান করা না হলেও এ বৈষম্যের ব্যবধান কমানোর জন্য দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি মৌসুমে লামা ও আলীকদম উপজেলায় প্রায় ১০ হাজার একর ফসলি জমিতে তামাক ও তিন হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে রবি শস্যের চাষ হয়েছে। এসব জমিতে পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি প্রায় দুই হাজার পাঁচশত নারী শ্রমিকও কাজ করছেন। একজন পুরুষ যেখানে দৈনন্দিন কাজের জন্য ৫০০-৬০০ টাকা পারিশ্রমিক পান, সেখানে একজন নারী শ্রমিক একই সময়ে শ্রম দিয়ে পান মাত্র ২০০-২৫০ টাকা। তামাক চাষের বীজতলা তৈরি, চারা উত্তোলন, জমি প্রস্তুতকরণ, চারা লাগানো, পরিচর্যাকরণ, পাতা ভাঙানো, স্টিক করা এবং তামাক চুল্লিতে তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণসহ বোরো ও রবি শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন কাজে পুরুষ শ্রমিকদের সাথে সমানতালে নারী শ্রমিকরা কাজ করছেন বিরামহীন ভাবে।
সরেজমিন লামা পৌরসভা এলাকার ছাগল খাইয়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এক সাথে বেশ কয়েকজন নারী তামাক ক্ষেত ও তামাক প্রক্রিয়াকরণসহ ধানের চারা রোপণ, আগাছা পরিষ্কার, ভুট্টা, আলু, আখ, বেগুনসহ বিভিন্ন সবজি পরিচর্যায় কাজ করছেন। এদের কারো বা স্বামী নেই, আবার কারো বা স্বামী থেকেও নেই; চলে গেছেন, কারোর বা স্বামী অসুখে অচল। আবার কারোর স্বামী জুয়া খেলা ও নেশাগ্রস্ত থাকেন। তাই পরিবারের হাল ধরতে এই নারীরা সংসারের দুর্বহ বোঝা তুলে নিয়েছেন নিজেদের অশক্ত কাঁধে। বেছে নিয়েছেন দিনমজুরের কাজ। এছাড়াও উপজেলা দু’টির মাঠে-ঘাটে, বাসাবাড়িতেও হাজারো নারী শ্রমিককে কাজ করছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী শ্রমিকদের সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় সারিবদ্ধ লাইনের মাধ্যমে ধান ও তামাক চারা রোপণ করতে দেখা গেছে যায় উপজেলা দুটির বিভিন্ন এলাকায়। জীবনে হার না মানা এসব নারী শ্রমিক পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছেন দিনরাত। যেন একচিলতে ফুসরত নেই দম ফেলানোর। একদিকে ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ আর অন্যদিকে সংসারের অপরিহার্য চাহিদার কথা মাথায় রেখেই চলছে তাদের এ অদম্য সাহসী যাত্রা বলে জানান নারী শ্রমিকরা।
জানা গেছে, কখনো তীব্র শীত আবার কখনো প্রচন্ড গরম উপেক্ষা করে পুরুষ এবং নারী শ্রমিকরা একসঙ্গে সময়ে কাজে আসেন। মধ্যাহ্ন বিরতি দিয়ে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে কোদাল হাতে নারী শ্রমিকরা নিরলসভাবে কাজ করে থাকেন। এক্ষেত্রে পুরুষ এবং নারী শ্রমিকরা সমান শ্রম ঘণ্টা কাজ করে থাকেন এবং উভয় শ্রমিকরা একই ধরনের কাজ করে থাকেন। দৈনন্দিন কাজের জন্য পুরুষ শ্রমিকরা ৫০০থেকে ৬০০ টাকা এবং নারী শ্রমিকরা তাদের কাজের জন্য ২০০-২৫০টাকা হারে পারিশ্রমিক পান। এ ছাড়া মধ্যাহ্ন বিরতিতে চা-নাস্তার জন্য সামান্য টাকা পেলে সেখানেও নারী শ্রমিকরা বৈষম্যের শিকার হন।
লামা পৌর এলাকার লামা মুখ, নুনারবিল, ছাগলখাইয়া এলাকায় তামাক চাষে কর্মরত নারী শ্রমিক বিলকিছ, শরিফা, খতিজা, শাহেনুর, মেহেরুন ও আলীকদম উপজেলার রুবিনা, ছেমন খাতুনসহ আরো অনেকে অভিযোগ করে জানিয়েছেন, অন্যান্য ফসলের চেয়ে তামাক চাষে বেশি শ্রম দিতে হয়। পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে একই সময়ে কাজে এসে, একই সময়ে কাজ ছাড়ার পরও পারিশ্রমিক প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। নারী-পুুরুষ উভয়ে একই শ্রম ঘণ্টা কাজ করার পরও তাঁরা শুধু নারী, এ অজুহাতে তাদেরকে পুরুষের অর্ধেক বেতন দেওয়া হচ্ছে।
পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও তামাক চাষি স্বার্থ সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি মো. শাহজাহান চলতি মৌসুমে ২ একর জমিতে তামাক চাষ করেছেন। তিনি জানান, তামাক চাষে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে। পর্যাপ্তসংখ্যক পুরুষ শ্রমিক পাওয়া না যাওয়ায় তাঁরা তামাক চাষের কাজে নারী শ্রমিক নিচ্ছেন। নারী শ্রমিকরা পুরুষের সমান কাজ করতে পারেন না। তিনি বলেন, একজন পুরুষ শ্রমিক ২-৩ জন নারী শ্রমিকের সমান কাজ করেন। সেজন্য পুরুষ শ্রমিকের পারিশ্রমিক বেশি আর নারী শ্রমিকের পারিশ্রমিক কম।
লামা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সাহেলা বেগম বলেন, সরকার নারীদের উন্নয়নে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন। সকল ক্ষেত্রে সমান সুযোগ দিয়ে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন হলেও আমাদের বেশির ভাগ জনগণেরই এখনো দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে এমন বৈষম্য কাম্য নয়। কৃষি কাজে নারী শ্রমিকদের এ বৈষম্য দূর হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।
পিবিএ/হক