পিবিএ,ঝিনাইদহ: ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার সুইতলা-মল্লিকপুরে অবস্থিত এশিয়ার বর্ববৃহৎ বটগাছ। কিন্তু অযত্নে অবহেলায় আজ ধ্বংসের দারপ্রান্তে অবহেলায় আপন সৌন্দর্য আর ঐতিহ্য হারাতে বসেছে বৃহত্তম এই গাছটি। সংরক্ষন ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এশিয়াবাসীর গর্ব এই গাছটি আর কতদিন টিকে থাকবে তা নিয়েও সংশয় অনেকের।সরেজমিনে দেখা যায়, আনুমানিক ৩’শ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন এই বটগাছটির বর্তমান বিস্তৃত এলাকা ১১ একর। বটের ‘ব’ নেমে নেমে পুরো এলাকাটি দৃশ্যত পৃথক গাছে পরিণত হয়েছে। মূলগাছ কোনটি তা আর এখন চেনার উপায় নেই। গাছটির জন্ম কত সালে তার কোন সঠিক ইতিহাস কারো জানা নেই। তবে বয়ঃবৃদ্ধদের মূখে শোনা যায় গাছটির বয়স ৪শ বছরের বেশী হবে।
বর্তমানে গাছটির দিন দিন বেড়েই চলেছে। যে কারণে পাশের রাস্তা কয়েক বার সরিয়ে নির্মাণ করতে হয়েছে। বাংলা ১৩৬০ সালে এই গাছটিকে কেন্দ্র করে মল্লিকপুর বেথুলীতে প্রথম বাজার বসে। যে বাজার আজ গাছের সঙ্গে অনেক বড় হয়ে উঠেছে। দোকানের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বর্তমানে ৫৫ থেকে ৬০ টি দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বাজারটিতে। বাজারের প্রথম ব্যবসায়ী মল্লিকপুরের মুনসুর আলী, মোনতাজ আলী, আঃ হামিদ, বেলায়েত মিয়া, বেথুলী গ্রামের স্বারজিত বিশ্বাস প্রমুখ।
উল্লিখিত ব্যক্তিরা প্রথম টোং দোকান বসিয়ে ব্যবসা শুরু করে। এখন সেখানে গড়ে তুলেছেন স্থায়ী পাকা ইমারত ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান। ১৯৮২ সালে বিবিসি’র এক তথ্যানুযায়ী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যে, ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার বেথুলী মৌজায় অবস্থিত সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছটি এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহত্তম বটগাছ। তখন থেকে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে কালীগঞ্জের বটগাছের কথা।
এরপর দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী গাছটি দেখতে আসা শুরু করেন। গাছটির ইতিহাস সম্পর্কে যতটুকু শোনা যায়, আজ থেকে ৪শ বছর পূর্বে গাছটি ছোট থাকা অবস্থায় গাছের নিচে একটি কুয়া ছিল। কুয়ার পানি ছিল স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ। কম জনবসতি এলাকাটিতে দুর-দুরান্তে লোক এই কুয়ার পানি পান করার উদ্দ্যেশ্যে নিয়ে যেত। কুয়ার উপরের বটগাছটির ডালপালা প্রচুর হওয়ায় গাছের নিচে গরমের সময় ঠান্ডা আর ঠান্ডার সময় গরম অনুভূত হত। জনসাধারনের মধ্যে গাছটি পূণ্য স্থানে পরিণত হয়।
বিভিন্ন রোগের জন্য আগত লোকজন গাছের গোড়ায় মানত করতে শুরু করে। সাধারনের মাঝে বিশ্বাস জাগতে শুরু করে যে গাছটির ডাল কাটলে বা ক্ষতি করলে নিজেদের ক্ষতি হতে পারে। তাই গাটিকে সবাই পরিচর্যা করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে গাছটির ডালপালা থেকে ‘ব’ নামতে নামতে বৃহত আকার ধারণ করে। কিন্তু মানুষ আজ আর কোন নিয়ম মানে না, ভয়ও পাই না। তাই এলাকার এক শ্রেণীর মানুষ গাছের বড় বড় ডালগুলো নির্বিচারে কেটে নিয়ে যাচ্ছে।
১৯৮২ সালে বিবিসির জরিপে কালীগঞ্জে সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছটি এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ বট গাছ হিসাবে স্বিকৃতি পায়। এরপর থেকেই এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে ও স্থানটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে সংরক্ষনের উদ্যোগ নেয় সরকার। সরকারের পাশাপাশি এই ঐতিহাসিক স্থানটিকে রক্ষায় এগিয়ে আসেন স্থানীয়রা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে গাছটির চারপাশ দিয়ে ১১ একর (৩৩) বিঘা জমির উপর দেওয়া হয় সীমানা প্রাচীর। গাছের পাশে প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় একটি রেষ্ট হাউজ।
দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে গাছের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় পাকা বেঞ্চ ও গার্টেন ছাতা সংযোজন করা হয়। রেষ্ট হাউজ নির্মিত হওয়ার পর বটগাছের পাশে ১৬৯ মৌজার ১৬নং দাগে ৩২ শতক জমি মল্লিকপুরে গ্রামের মৃত জহুর আলী বিশ্বাসের স্ত্রী কুন্টি বিবি ২৫/০৪/৯০ ইং তারিখে ঝিনাইদহ জেলা পরিষদের নামে দানপত্র লিখে দেন। সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়াম্যান শওকতুল ইসলাম ঐতিহ্যবাহী স্থানটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি ঘটাতে গাছের নীচে বিভিন্ন ফুলের গাছ রোপন করেন। কিন্তু সরকার এসব দেখভালের জন্য কোন লোক নিয়োগ করেনি।
দীর্ঘদিন অরক্ষিত থেকে সরকারি টাকায় নির্মিত রেষ্ট হাউজটি আজ নেশাখোরদের দখলে চলে গেছে। নেশাখোরেরা রেষ্ট হাউজের জানালা দরজা লোহার গ্রীল সবই কেটে নিয়ে গেছে। রেষ্ট হাউজটি এখন পরিত্যাক্ত। এ ছাড়া এলাকার প্রভাবশালী মহল রাতে গাছের বড় বড় ডালপালা পর্যন্ত কেটে নিয়ে যায়। মানুষের নানাবিধ অত্যাচারে সৌন্দর্যবর্ধনকারী এই বটগাছটি আজ তার সৌন্দার্য ও ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এভাবে চলতে থাকলে এশিয়াবাসীর গর্ব এই বৃহৎ বট গাছটি আর কতদিন তার আপন ঐতিয্য ও সোন্দর্য ধরে রাখতে পারবে তা নিয়েই সংশয় প্রকাশ করেন সুইতলা মল্লিকপুরে অবস্থিত।
পিবিএ/এটি/আরআই