গাইবান্ধায় মনোবাসনা পূরণের ঐতিহ্যবাহী মেলা

পিবিএ, গাইবান্ধা: গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ভরতখালীতে প্রতি বছরের মতো এবারও শুরু হয়েছে মাসব্যাপী মনোবাসনা পূরনের মেলা। প্রতি বছর বৈশাখ মাস জুড়েই সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার চলে ঐতিহ্যবাহী এই মেলা। সনাতন ধর্মালম্বীদের বিশ্বাস পূজা অর্চনা ও বলি দান করলে মনোবাসনা পূরণ হয়। ভরতখালী কাষ্ঠ কালি মন্দির এ অঞ্চলের হিন্দু ধর্মালম্বীদের তীর্থ স্থান।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় দুইশত বছর পূর্বে এ মন্দির নির্মিত হয়। তবে এই মন্দিরকে ঘিরে অলৌকিক একটি ঘটনা রয়েছে। তা হল যমুনা নদী থেকে ভেসে আসা একটি পোড়া কাঠ থেকে এই মন্দির সৃষ্টি হয়েছে। তৎকালীন জমিদার রমনী কান্ত রায় স্বপ্নাদেশ পান যে, আমি তো ঘাটে এসেছি, তুই আমাকে পূজা দে। রাজা এই পোড়া কাঠের টুকরোটিকে পূজা দিলে এখান থেকেই এটি কালী মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়। তখন থেকে নিয়মিত পূজা অর্চনার ব্যবস্থা হয়ে ওঠে। কয়েক বছর আগে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভাঙ্গতে শুরু করে এবং এই মন্দিরের কাছে চলে আসে। এরপর এই মন্দিরের কাছ থেকে ভাঙ্গন বন্ধ হয়ে যায়।

গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ভরতখালীতে প্রতি বছরের মতো এবারও শুরু হয়েছে মাসব্যাপী মনোবাসনা পূরনের মেলা
মনোবাসনা পূরণের ঐতিহ্যবাহী মেলা

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পুণ্যার্থীদের পাশাপাশি মেলায় হাজারো দর্শনাথীদের ভীড়ে পা রাখার যায়গা নেই। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ মন্দিরে মানত নিয়ে এসেছে। আর এই মানত মনোবাসনা পূরণের আশায়। মন্দিরে ধূপ, মোমবাতি, আগরবাতি জালিয়ে তারা মায়ের (ঈশ্বর) কাছে প্রার্থনা করছে। মন্দিরের চারপাশে অনেককেই পাঠা (ছাগল) নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। মনোবাসনা পূরণের লক্ষে প্রার্থনা শেষে মন্দিরের গুরুর (ঠাকুর) নির্দেশ মোতাবেক পাঠা (ছাগল) বলি দেওয়া হচ্ছে পায়ের মায়ের নিচে। এছাড়াও প্রার্থনা শেষে অনেকই আবার বিভিন্ন খাবার ও মিষ্টি বিতরণ করছে।

এ উপলক্ষে মন্দিরের পাশে পাকুর তলায় প্রায় ৭ একর এলাকাজুড়ে বসেছে গ্রামীণ মেলা। শুধু উত্তরাঞ্চলই নয় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ ঘুরতে আসেন এখানে। মেলায় বাহারি খাবার, বাঁশের তৈরী কুলা, ডালি, চালন, মাটির তৈরি হাড়ি, থালা, বিভিন্ন মূর্তি, পুতুল, বাঘ, আম এবং নানা তৈজসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানিরা।

মনোবাসনা পূরণের ঐতিহ্যবাহী মেলা

অঞ্জলি রানী বলেন, জন্মের পর থেকে আমি শুনে আসছি যে কাষ্ঠ কালি মন্দিরে পূজা হয় এবং এটা এতই জাগ্রত যে যা মানত করে মানুষের মনোবাসনা পূরন হয়। আমার বিয়ের পর সংসার জীবনে সন্তান হচ্ছিল না। মার কাছে মানত করার পর আমি এক ছেলে সন্তানের মা হই। এরপর আবার একই সমস্যায় অনেক দিন অতিবাহিত হয়। পূর্বের ন্যায় মায়ের স্বরনাপন্ন হই। এরপর আবার দ্বিতীয় সন্তানের মা হই এবং এই সন্তানদের সাথে করে মায়ের পায়ের কাছে পাঠা বলি দিলাম।

মনোবাসনা পূরনের জন্য মন্দিরে মানত দিতে আসা জয়া রানী বলেন, আমার স্বামী এক্সিডেন্ট করে গুরুত্বর আহত হয়। সেজন্য আমি মায়ের (ঈশ্বর) কাছে অনেক কান্নাকাটি এবং মনেমনে মানত করি আমার স্বামীর সুস্থ্যতার জন্য। এরপর মায়ের কৃপায় আমার স্বামীকে সুস্থ্য অবস্থায় ফিরে পেয়েছি। মাকে সন্তুষ্ট করার জন্য সেই মানত হিসেবে পাঠা (ছাগল) নিয়ে বলি দিতে এসেছি মন্দিরে।

মনোবাসনা পূরণের ঐতিহ্যবাহী মেলা

আসা সুদিপ কুমার বলেন, এখানে কেউ মানত করলে তাদের মানত পূর্ণ হয় বিধায় এখানে লোকজনের সমাগমটা অনেক বেশি। অনেক দিন থেকে বেকার বসে আছি। আমার চাকুরী হওয়ার জন্য মানত হিসাবে পাঠা বলি দিতে এসেছি।

মেলার ব্যবসায়ীরা বলেন, আমরা প্রতিবছর এই মেলায় দোকান দিয়ে থাকি। এবছরের মেলায় তুলনামূলক বেচা-কিনা একটু বেশি। নিরাপত্তা বেষ্টিত এই মন্দির তাই আমাদের কোন ঝুট-ঝামেলা পোহাতে হয় না।
কাষ্ঠ কালি মন্দিরের কমিটির সভাপতি রনজিৎ কুমার চন্দ্র বলেন, এই মন্দিরের সৃষ্টির সঠিক কোন সাল জানা যায়নি।

প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শনি ও মঙ্গলবার দিন গুলোতে এই মন্দিরে পাঠা বলিসহ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সনাতন ধর্মালম্বীদের এই মেলায় সমাগম ঘটে।

পিবিএ/এস/আরআই

আরও পড়ুন...