মুহাম্মদ আবুল হুসাইন
রমজান মাসের মাহাত্ম্যের গোপন রহস্য
মাহে রমজান সমাগত।এই পবিত্র মাসকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের জীবনকে আলোকিত করতে চাই, সমৃদ্ধ করতে চাই।কিন্ত এই মাস নিজে কতটা আলোককে, কতটা সমৃদ্ধিকে ধারণ করে আছে বা কী কারণে এই মাস এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তা জানতে না পারলে এর যথাযথ গুরুত্ব যেমন আমরা উপলব্ধি করতে পারব না, তেমনি এ থেকে যথাযথ ফায়দা লাভের উদ্দেশ্য সাধনেও আমরা একনিষ্ঠ, দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ এবং স্থিরচিত্তও হতে পারব না।মূলকথা, মাহে রমজানের মর্যাদার গোপন রহস্য আমাদের জানতে হবে।
মূলতঃ এই মাসের বড়ত্ব, গুরুত্ব ও মহত্বেও মূলে রয়েছে একটি বিষয়, আর তা হল আল্লাহ’র কালাম আল কোরআনের আত্মপ্রকাশ। এই মাসেই ক্বদরের রাত্রিতে সর্বপ্রথম লাওহে মাহফুজে সমগ্র আল কোরআন নাযিল এবং সংরক্ষণ করা হয়। তারপর এই মাসেই পৃথিবীতে হেরা গুহায় সর্বপ্রথম কোরআন নাযিল শুরু হয় এবং রাসূলের তেইশ বছরের নবুওয়তি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়োজন অনুসারে অল্প অল্প করে সমগ্র কোরআন নাযিল সম্পন্ন হয়।
অন্যকথায়, অত্যন্ত মেহেরবান ও অতিশয় দয়ালু আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন এ মাসেই আমাদের মাঝে সর্বশেষ আসমানী কিতাব নাযিল করে মানবজাতির চূড়ান্ত মুক্তির পথ-নির্দেশ প্রদান করেন। এ মাসেরই মহিমান্বিত রাত লাইলাতুল ক্বদরে মহান সৃষ্টিকর্তার অসীম, অনতিক্রমনীয় জ্ঞানের আলোক উদ্ভাসিত হয়ে মানবতার মুক্তির পথ সিরাতুল মুশতাক্বিমকে স্পষ্ট করে তোলে, যা আমাদের জন্য চিন্তা ও কর্মের সঠিক ধারা এবং ন্যায় বিচার ও নীতি-নৈতিকতার একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেয়, যার নাম হল আল কোরআন; যা সব রকম ভূল-ত্রুটি, বিকৃতি ও বিচ্যূতি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত। মূলত আল্লাহ’র কালাম আল কোরআনকে বুকে ধারণ করার কারণেই এই মাস এত পবিত্র এবং এ কারণেই এর এত মর্যাদা, এত গুরুত্ব। কারণ আল্লাহ’র কালাম হল পরশ পাথরের ন্যায়; যেই তার স্পর্শ পায় সেই মর্যাদাবান হয়ে ওঠে। কাজেই রমজান মাসের মর্যাদা শুধু এই জন্য নয় যে এই মাসে রোজা রাখা হয় এবং কোরআন তেলাওয়াত করা হয়। বরং কোরআন নাযিল করার কারণেই আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন এ মাসটিতে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেন:
‘রমজান সেই মাস, যে মাসে কোরআন নাযিল করা হয়েছে; যা সমগ্র মানব জাতির জন্য হেদায়াত, সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশ এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। তোমাদের মধ্যে যেই এ মাসের সাক্ষাৎ পাবে, সে যেন রোজা রাখে।’ – আল বাকারা: ১৮৫
বস্তুত, আল কোরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্য আল্লাহপাকের এক অনন্য ও অতুলনীয় দান এবং তাঁর দয়ার অপূর্ব নিদর্শন। পৃথিবীতে আল্লাহ’র কালামের আত্মপ্রকাশ মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা। আল্লাহ তায়ালা নিজেও এই কালামকে আমাদের জন্য তাঁর এক বিশেষ দয়া বলে উল্লেখ করেছেন:
‘পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহ’র নিকট থেকে অবতীর্ণ এই কালাম। – সূরা ৪১, আয়াত-২।
পৃথিবীতে আমরা সারাক্ষণই আল্লাহপাকের অসীম দয়া, দান ও নেয়ামতের মধ্যে ডুবে আছি। কিন্তু এসবই ক্ষণস্থায়ী। আমাদের এই শরীর থেকে যখন শেষ নিঃশ্বাস বের হয়ে যাবে তখন আমাদের এই শরীর সহ সবকিছুই অর্থহীন হয়ে পড়বে। কিন্তু একটি জিনিস যা আমাদের পৃথিবীজীবনের ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তগুলোকে চিরস্থায় করবে, ক্ষণস্থায়ী নেয়ামতসমূহকে আল্লাহ’র ইচ্ছায় চিরস্থায়ী ও অফুরন্ত রূপ দিবে, তা হল আল্লাহ’র কালাম আল কোরআন। এ কারণে পৃথিবীতে সকল সম্পদের বড় সম্পদ হল আল কোরআন। এ কারণে যে রাতটিতে এই মহিমান্বিত ও বরকতময় কোরআন নাযিল হয়েছে সেই রাতটিকে বলা হয়েছে ‘শ্রেষ্ঠ বা শক্তির রাত’ এবং ‘মহিমান্বিত রাত’।
আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন যখনই ‘অহী’ নাযিলের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন, তখনই তিনি এর সাথে তাঁর দয়া, জ্ঞান ও শক্তির কথা যুক্ত করেছেন। এমনকি রমজানের শেষে ঈদ উৎসব পালনের যে নির্দেশ আল্লাহ দিয়েছেন; তাও দিয়েছেন কোরআন নাযিলের আনন্দ ও উৎসব হিসেবেই:
‘হে লোক সকল, তোমাদের কাছে তোমাদের আল্লাহ’র কাছ থেকে নসিহত (কোরআন) এসে পৌঁছেছে; এতে রয়েছে অন্তরের রোগের পূর্ণ নিরাময়; আর যে তা কবুল করবে তার জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে পথনির্দেশ এবং রহমত। (হে নবী) বল: ‘এটা আল্লাহ’র অনুগ্রহ ও অপার করুণা যে, তিনি এই প্রত্যাদেশ নাযিল করেছেন। এজন্য তো লোকদের আনন্দ-উৎসব করা উচিত। এটা সেসব থেকে উত্তম, যা লোকেরা সংগ্রহ ও আয়ত্ত করে থাকে।’
দিন ও মাস সমূহ সবই সমান, সবই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তারপরও কিছু মুহূর্ত এমন আছে, যার উপর সমগ্র মানব জাতির ভাগ্য নির্ভর করে। পবিত্র হেরা গুহায় মহানবীর (সা.) উপর আল্লাহ’র কালাম নাযিল হওয়া ছিল সেই মুহূর্ত। সেই মুহূর্তেই ঘটেছিল মানব ইতিহাসের সেই সবচেয়ে বিরাট ঘটনা এবং এটিই মাহে রমজানের বড়ত্ব, মহত্ব ও গুরুত্বের মূল রহস্য।