দূর্বল বেড়িবাঁধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় খুলনা উপকূলের মানুষ

পিবিএ,খুলনা: ‘নদীর এক একটা ঢেউ যেন কলিজায় আঘাত করে। এই বুঝি সব শেষ। ভিটে মাটি, সহায়-সম্পদ রক্ষা হলো না।’ শুক্রবার রাতে কপোতাক্ষের ঢেউ যখন বাঁধে আছড়ে পড়ছিল এরকমই মনে হচ্ছিল উপকূলীয় এলাকা খুলনার কয়রা উপজেলার হরিণখোলা গ্রামের কপোতাক্ষ পাড়ের বাসিন্দাদের।

বেড়িবাঁধ
হরিণখোলা গ্রামের কপোতাক্ষ পাড়ের নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ সকলেই বাঁধ রক্ষায় দিন রাত প্রচেষ্টা

আইলার আঘাতে বাঁধ ভেঙে সহায় সম্পদ হারানো মানুষগুলো দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর একটু ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ঠিক সেই সময় নতুন আতংক নিয়ে তাদের সামনে এসেছে ঘূর্ণিঝড় ফণি। সতর্কবার্তা পাওয়ার পর পরই গ্রামের বাসিন্দাদের চোখে ঘুম নেই। এলাকার নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ সকলেই বাঁধ রক্ষায় দিন রাত প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কারণ, এ বাঁধ ভাঙলে হরিণখোলা গ্রামসহ পাশের গোবরা ও ঘাটাখালি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এলাকা ছাড়তে হবে তিন গ্রামের কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষকে।

হরিণখোলা গ্রামের বাসিন্দা শেখ সিরাজুদ্দৌলা জানান, আইলার ভাঙনে কপোতাক্ষের বুকে বিলিন হয়েছে তার বাপ দাদার বসত ভিটেসহ প্রায় ১০ বিঘা জমি। প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি সহযোগীতা ও নিজের প্রচেষ্টায় নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। অন্যের জমি ইজারা নিয়ে করেছেন ১০ বিঘার চিংড়ি ঘের। ৫ বিঘা জমিতে লাগিয়েছেন ফসল। তিনি বলেন, ‘এবার বাঁধ ভাঙলে আমাগের আর বাঁচার উপায় থাকবে না। পথে বসতে হবে।’

তাঁর মত ওই তিন গ্রামের অনেক মানুষ এলাকায় থেকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই এলাকা ছেড়ে অন্য গ্রাম অথবা শহরেও চলে গেছেন। গ্রামে থাকা মানুষগুলোর চোখে মুখে আতংকের ছাপ স্পষ্ট। রক্ত পানি করা শ্রমের ফসল চোখের সামনে ভেসে যাওয়ার ভয়ে কারো চোখে ঘুম নেই।

সরেজমিন দেখা গেছে, হরিণখোলা এলাকায় আগে থেকেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধের অবস্থা নাজুক। মাস খানেক আগে সেখানে প্রায় ৩০০ মিটার বাঁধ ধসে যায়। সেটি স্থানীয় গ্রামবাসির চেষ্টায় মেরামত করতে না করতেই ফণির প্রভাবে আবারও ভয়াবহ অবস্থা। এ মুহুর্তে সেখানে প্রায় এক কিলোমিটারের মত বাঁধ ধসে গেছে। ঢেউয়ের আঘাতে চিকন হতে হতে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।

বাঁধ রক্ষায় বৃহস্পতিবার থেকে দিন রাত সেখানে কাজ করছেন শত শত নারী পুরুষ। শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত সেখানে পালাক্রমে কাজ করেছে তারা। তবুও শঙ্কা কাটছে না। স্থায়ি কোন ব্যবস্থা না হওয়া অনেকের মনে ক্ষোভ রয়েছে। তারা বার বার দুষছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। তাদের উদাসীনতাই নাকি বাঁধের এমন অবস্থা।

ঘাটাখালি গ্রামের আবুল কালাম শেখ, মোস্তাফিজুর রহমান, গোবরা গ্রামের হেলাল উদ্দীন, ইমতিয়াজ উদ্দীন, রফিকুল ইসলামসহ অনেকেই অভিযোগ করেন, বাঁধ সংস্কারের নামে পাউবো কর্মকর্তাদের বরাদ্দ লুটপাট বন্ধ না হলে স্থায়ি কোন সমাধান সম্ভব হবে না। তাদের গাফিলাতি বাঁধ ভাঙার মূল কারণ বলেও অভিযোগ করেন স্থানীয় মানুষ।

পাউবো’র উপসহকারি প্রকৌশলী মশিউল আবেদীন বলেন, ওই বাঁধটি মেরামতের জন্য গত ২৫ মার্চ দরপত্রের মাধ্যমে ১৮ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কাজ শুরুর আগেই ঘূর্ণিঝড় ফণির প্রভাবে সেখানে ভাঙন দীর্ঘায়িত হয়েছে। বাঁধটি টিকিয়ে রাখতে গ্রামবাসির সাথে আমরাও সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিমুল কুমার সাহা জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় ফণির প্রভাবে কেবল হরিণখোলা নয়, কয়রা উপজেলার দশহালিয়া, মাটিয়াভাঙ্গা, জোড়শিং, গাজীপাড়া, গাববুনিয়াসহ আরও কয়েকটি স্থানে প্রায় ১০ কিলোমিটার বাঁধ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। ওই সব স্থানেও গ্রামবাসি দিন রাত পরিশ্রম করছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদেরকে সহযোগীতা করা হচ্ছে। শুক্রবার রাতের জোয়ারে এসব বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে বলে জানান তিনি।

গত বৃহস্পতিবার থেকে কয়রায় অবস্থান করছেন স্থানীয় সাংসদ মোঃ আখতারুজ্জামান বাবু। তিনি বলেন, কয়রা উপজেলার মানুষের দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ দূর্বল বেড়িবাঁধ। এসব বাঁধ স্থায়িভাবে মেরামত করা না হলে সামনে বড় বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। আমি এ ব্যাপারে সংসদেও আলোচনা করেছি।

পিবিএ/এইচআর/আরআই

আরও পড়ুন...