পিবিএ ডেস্কঃ মারধর, চেঁচামেচিতে ফল হয় বিপরীত। আবার বাবা-মায়ের অতিরিক্ত স্নেহ বা উদাসীনতাতেও বিপথগামী হতে পারে ক্লাস এইটের ছাত্র কিংবা তেরো বছরের কিশোরী। বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের শারীরিক-মানসিক পরিবর্তন সামলাবেন কী করে? বাবা-মায়ের শাসন বাঁধন ছিঁড়ে স্বাধীনচেতা হয়ে উঠতে চায় কৈশোর মন। এদিকে বাড়ন্ত বাচ্চাকে অপত্য স্নেহ দিয়ে বা শাসনকরে আগলে রাখতে চান বাবা-মায়েরা। এই দুই পক্ষের চাওয়ার বৈপরীত্যে অশান্তি তীব্র হয় সুখের সংসারে। লেখাপড়ায় অমনোযোগিতা, অবাধ্যতা, জেদ, নিজেকে গুটিয়ে রেখে একলা থাকার অভ্যাস, মানসিক অবসাদ, ইন্টারনেটের নেশা, লুকিয়ে সিগারেট-মদ কিংবা বিপজ্জনক যৌনতা-বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানের এমনই সব নানা ব্যবহারে উদ্বিগ্ন হন অভিভাবকরা। মারধর, শাসন করলে আরও দূরে সরে যায় আবেগপ্রবণ টিনএজার। সময় দিয়ে, বন্ধু হয়ে বাবা-মায়েরাই শেখান মূল্যবোধ। খুঁজে দিন সঠিক পথ।
বয়ঃসন্ধিঃ এখন ১৩-১৪ বছর বয়সের আগেই শুরু হয়ে যাচ্ছে। এটা কি স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার পক্ষে ভাল?
ভাল-মন্দে একে বাঁধা সম্ভব নয়। চিনের মতো দেশে মেয়েদের বয়ঃসন্ধি শুরু হয় ১২-১৩ বছর বয়সে। ছেলেদের চোদ্দ-পনেরোয়। আবার নরওয়ের মতো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কান্ট্রিতে মেয়েদের বয়ঃসন্ধি হয় সতেরো বছর বয়সে। ছেলেদের চোদ্দ-পনেরোতেই। মেয়েরা ঋতুমতী হওয়ার পর শরীরী গঠনের পরিবর্তন শুরু হওয়ার সময়টাই হল বয়ঃসন্ধিক্ষণ।
বয়ঃসন্ধিতে ছেলেমেয়েদের সমস্যাঃ বড়দের জুতোয় পা গলানো স্বভাব বাচ্চাদের। ভাবে, কবে বড় হবে। বাল্যকাল আর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার মাঝামাঝি সময়টাই টিনএজ। এই সময় ওরা নিজেদের বড় হয়ে গিয়েছে বলে ভাবতে থাকে। নিজস্ব ভাবনা, ধারণা, মতামত তৈরি হয়। তাদের এইসব মতামতকে অভিভাবকরা গুরুত্ব না দিলে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তর্ক করে। জেদ ধরে। এমন ব্যবহারিক পরিবর্তন অস্বাভাবিক নয়। এই পরিস্থিতিতে সন্তানকে নম্রভাবে বোঝান। তার বক্তব্য মন দিয়ে শুনুন।
বাবা-মায়েরা সময় দেবেন কীভাবেঃ যতই কাজের ব্যস্ততা থাকুক প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা কোয়ালিটি টাইম দিন সন্তানকে। এই সময় ছেলেমেয়ে যা বলবে বাবা-মা তাই শুনবে। সেটা একসঙ্গে গল্প করা, টিভি দেখা, গেমস খেলা যে কোনও কিছুই হতে পারে। সব সময় নিজের মতামত সন্তানের উপর চাপিয়ে দেবেন না। অন্যের সঙ্গে সন্তানের তুলনা করবেন না। কোনও জিনিস কেনার আগে ছেলেমেয়ের বক্তব্য শুনুন। তারপর যে মতামতে ভোট বেশি হবে তাতে সিদ্ধান্ত নিন। সপ্তাহে এক-একদিন এক-একজনের দাবিমতো রান্না করুন। পরিবারে গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। এতে সন্তানের পরিবারের প্রতি দরদ ও দায়বদ্ধতা বাড়ে। একলা নিজের জগৎ গড়ে তোলার অভ্যাস তৈরি হয় না। এতে সন্তানের আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা বাড়ে, বাবা-মাকে গোপন করার প্রবণতা কমে, সৎ হয়। অন্যকে সম্মান করা, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার অভ্যাস গড়ে ওঠে।
কখন শাসন জরুরিঃ অতিরিক্ত বায়না, অতিরিক্ত ইন্টারনেট-মোবাইল ব্যবহার করলে অবশ্যই শাসন করুন। অপত্য স্নেহ সর্বনাশের কারণ। কোনও জিনিস চাইলে তা আদৌ তার কতটা দরকার তা বুঝে শাসন শুরু করুন। যদি সন্তানের চাহিদা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় তাহলে নিশ্চয়ই দিন। কিন্তু ক্লাস নাইনের ছাত্র যদি মোবাইল, বাইক বা এমন কিছু জিনিস চায় যা তার ব্যবহারের বয়স হয়নি, তাহলে প্রথমেই নাকচ করে দিন। কখনও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবেন না। মারধরও করবেন না। এর ফল খুব খারাপ হয়।
অবাধ্য হয়ে উঠলে কী করবেনঃ বাবা-মা ঠিকমতো সময় না দিলে বা সঠিক ব্যবহার না করলেই কিন্তু অবাধ্যতা, জেদ, একগুঁয়েমি বাড়ে। ছেলেমেয়ের এই প্রবণতা আটকাতে বাবা-মাকে উদাহরণ হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। ধৈর্য ধরে, সঙ্গ দিয়ে, ভাল করে বুঝিয়েও যদি অবাধ্যতা না কমে তাহলে শিশু ও বয়ঃসন্ধিকালের বিশেষজ্ঞ মনোবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডা আব্দুস সালাম বলেন কিশোরীদের নানা সমস্যা নিয়ে বাবা-মায়েরা আসেন। খুব প্রয়োজন না হলে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা না করে শুধুমাত্র বুঝিয়েই বহু বিপথগামীকে সঠিক পথে নিয়ে আসেন মনোবিদরা।
বাবা—মায়েদের ভুলঃ তুই পারিস না, তোর দ্বারা হবে না-এমন নেতিবাচক কথা বলবেন না। মারধর করবেন না। আত্মসম্মানে লাগে এমন কথা বলবেন না। বাবা-মা নিজেদের ঝগড়া সন্তানের সামনে করবেন না। সন্তানের সামনে সিগারেট-মদ খাবেন না। ঘনঘন মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন না। এগুলি ওরা পরিবারের সদস্যদের দেখেই শেখে।
পড়াশোনায় অমনোযোগে কী করবেনঃ সব ছেলেমেয়ে পড়াশোনায় ভাল না-ও হতে পারে। কিন্তু কেউ যদি পড়াশোনায় হঠাৎ অমনোযোগী হয়ে পড়ে তাহলে তার প্রভাব পড়ে রেজাল্টে। নিয়মিত স্কুল-কোচিংয়ের শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে বাবা-মায়েরা জেনে নিন সন্তান লেখাপড়া ঠিকমতো করছে কি না। অমনোযোগী হয়ে পড়লে সন্তানের মনের গতিবিধি অনুসন্ধান করুন। না পারলে মনোবিদের কাছে নিয়ে গিয়ে কাউন্সেলিং করান।
কতক্ষণ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেবেনঃ পড়াশোনার প্রয়োজনে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। তবে তা দিনে নির্দিষ্ট সময়ে এক-আধ ঘণ্টার বেশি নয়। অন্য সময় ইন্টারনেট কানেকশন বন্ধ করে দিন। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার নয়। মাঝে মাঝে লক্ষ্য রাখুন ইন্টারনেটে কোন ওয়েবসাইট চেক করছে।
যৌন সচেতন করার দায়িত্বঃ বাবা-মাকে এই দায়িত্ব নিতেই হবে, এমন নয়। স্কুলেরই উচিত যৌন সচেতনামূলক শিক্ষা দেওয়া। টিনএজাররা বন্ধুদের কাছ থেকেই সব কিছু জেনে যায়। তবে অকারণ কৌতূহল দেখলে বাবা-মায়েরা অবশ্যই জানাতে পারেন।
পিবিএ/এমআর