বাংলাদেশ: নিরাপদ যাত্রাপথ হবে তো?

ফকির আব্দুল্লাহ আল ইসলাম: চিরসবুজের সম্ভার আমাদের বাংলাদেশের আয়তন ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গ কি.মি. যার মধ্যে সড়ক পথের দৈর্ঘ্য কাঁচা পাকা মিলিয়ে ২ লক্ষ ৪১ হাজার ২৮৬ কি.মি.। বিআরটিসি ( বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্পোরেশন) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬১ সালে। বাংলাদেশের প্রথম রেল লাইন স্থাপিত হয় ১৮৬২ সালে। চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত। বাংলাদেশের বর্তমান রেলপথের দৈর্ঘ্য ২৮৭৭ কি.মি.। বাংলাদেশে মোট ৫০৫টি রেল ষ্টেশন রয়েছে। বাংলাদেশের সারা বছর নাব্য ভ্রমন নদী পথের দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ২০০ কি.মি. আর বর্ষাকালে ৬ হাজার কি.মি. ইওডঞঈ (বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৮ সালে। রাজধানী ঢাকার সাথে দক্ষিনাঞ্চলসহ প্রায় ৫০টি রুটে নৌ চলাচল করে। বাংলাদেশ বিমান সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। ২০০৭-এ নাম পরিবর্তন করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লি. নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশ বিমান দেশের ৮টি রুটসহ ১৮টি আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল করে।

এবার বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার খোলামেলা চিত্র দেখা যাক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডঐঙ- এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে প্রায় ২০ হাজার লোক মারা যায়! অন্যদিকে বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৭২ হাজার ৭৪৮ জন , আহত হয়েছে ৫২ হাজার ৬৮৪ জন , পঙ্গুত্ববরণের সংখ্যা দ্বিগুণের চেয়েও বেশি! একই সাথে নৌ-দুর্ঘটনায় স্বাধীনতা পরবর্তী লোক মারা যাওয়ার সংখ্যাও হাজার-হাজার! আর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নানামুখি ত্রুটি ও অনিয়ম বরাবরই আলোচিত ইস্যু।

সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত এ যাবত-কাল মামলা হয়েছে ৮৩ হাজারের ওপরে। অথচ হাতেগোনা কয়েকটি মামলার বিচার শেষ হয়েছে বলে জানা যায়! হায়রে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা! আমাদের ঢাকা শহরের বয়স ৪শ’ বছরের অধিক অথচ কোথায় কয়েক দশকের সিঙ্গাপুর শহর আর কোথায় আমাদের ইতিহাসের শহর ঢাকা! বিদেশিরা ঢাকা শহর ঘুরে দেখার পরে মন্তব্য করে যায় ঢাকা শহর ইটের তৈরি এক বস্তি শহর! আমাদের সমসাময়িক স্বাধীনতা অর্জনকারী আমাদের এশিয়ারই কয়েকটি দেশ যেমন, সিঙ্গাপুর, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, বাহরাইন, ওমান, ভূটান, ইয়েমেন।

তা ছাড়া এশিয়ার গর্ব চীন, জাপান, প্রভৃতির কথা আর বললাম না। কেমন তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা আর কেমন আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা! আমাদের থেকে আরো দু’এক দশক পরে স্বাধীনতা অর্জনকারী আমাদের এশিয়ারই আরো কয়েকটি দেশ যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমাদের থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে। এতো গেল-এশিয়ার হিসাব এর বাইরে দুনিয়াব্যাপী কত উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা যা আমাদের শুধু চোখ ধাঁধিয়েই দিবে! বাংলাদেশে মজুরী ও নির্মাণ সামগ্রীর দাম বিশ্বে সবচেয়ে নিচের দিকে থাকার পরেও সেতু ও সড়ক নির্মাণে কি.মি. প্রতি ব্যয় বিশ্বে সর্বাধিক।

ভারত , চীন, মালয়েশীয়ায় ফ্লাইওভারে কি.মি. প্রতি ব্যয় যেখানে ৪০ থেকে ৬০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে সেখানে ব্যয় ১৩০ থেকে ৩১৬ কোটি টাকা! দক্ষিণ এশিয়ায় জীবন-যাপনের মানের বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান সবার শেষে। আমাদের দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় কেন এতসব দুর্ঘটনা ঘটে? প্রশ্ন সহজ উত্তর বেশ কঠিন ও লম্বা-চওড়া। প্রধাণত রাজধানীসহ সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সূদুর-প্রসারীভাবে গড়ে তোলা নয়।

ঢাকা তো পুরোই অপরিকল্পিত এক নগরী। সড়কের হাল পাল্টানো ও আলাদা আলাদা লেন দরকার। শিক্ষিত লোক মানেই অফিসের চাকুরী করতে তার জন্ম এই মানসিকতার কারণে পুরো পরিবহণ সেক্টর নিরক্ষর ব্যক্তিদের হাতে পরিচালিত হয়ে থাকে। ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী ড্রাইভারের অভাব যেন ধূমকেতুর মতো! আছে প্রশাসনিক দুর্বলতা, অসততা ইত্যাদি। মোটকথা যোগাযোগ খাতে দুর্ঘটনার জন্য যা যা দরকার বাংলাদেশে তার থেকেও অনেক বেশি কারণ বিদ্যমান।

মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৪ অনুসারে বছরে একবার বিআরটিএতে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু পরিদর্শক দল গাড়ি না দেখে ১০০ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাদিয়া নিয়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়ে থাকেন। রাজধানীতে ৫ হাজার বাস-মিনিবাস চলাচল করে। যার ৮৮ শতাংশই ফিটনেসবিহীন। এতো গেল ঢাকার হিসাব। তাহলে ঢাকার বাইরে কি অবস্থা ? নসিমন, করিমন, ভটভটি, মাহেন্দ্র এগুলো মহাসড়কে নিষিদ্ধ গত বছর থেকে অথচ এরা আজো বেপরোয়াভাবে মহাসড়ক দাপিয়ে-কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে! জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল মহাসড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কি.মি. আর লোকাল সড়কে ৪০ কি.মি. নির্ধারণ করেছে। কিন্তু চালকেরা সেই গতিসীমা মানে না। আর এগুলো তদারকি করবে কি হাজার হাজার গাড়ির পেছনে হাতে গোনা নির্দিষ্ট স্থানে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশ ?

বুয়েটের এক সমীক্ষায় সড়ক দুর্ঘটনার জন্য কয়েকটি কারণ বলা হয়েছে। ১. গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইলে কথা বলা, ২. খেয়ালীপনায় রাস্তা ফাঁকা পেয়ে প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চালানো, ৩. ফিটনেসবিহীন গাড়ি, ৪. ট্রাফিক আইন না মানা, ৫. ফুটপাত দখল, ৬. ত্রুটিযুক্ত গাড়ি, ৭. যাত্রীদের অসর্তকতা, ৮. নির্ধারিত গতিসীমা অমান্য করা , ৯. ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা। নৌ পথের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও একই ধরনের আরো অনেকগুলো কারণ রয়েছে।

খবর বেরিয়েছিল বরিশালে ডুবে যাওয়া ও উদ্ধার হওয়া ‘ঐশি’ লঞ্চের সবই ছিলো অবৈধ! শিশুসহ ২৪ লাশ উদ্ধার হয়েছিল, নিখোঁজ ছিল ৬ জন। ভালো খবর! ভালো বলছি এজন্য যে, পদ্মায় ডুবে যাওয়া লঞ্চের মতো একেবারে নিখোঁজ বা সন্ধানহীন হয়নি তাই! কেবলমাত্র ২০১৬ সালের ঈদুল আযহার ঈদ যাত্রায় ২৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। যার মধ্যে বিবাহ হতে যাওয়া বর , বরযাত্রীও রয়েছে। আর গতবছর জাবালে নূর পরিবহণ দুর্ঘটনা কেন্দ্রিক কোমলমতি শিক্ষার্থীতের আন্দোলন ও করুণ পরিনতি সবারই জানা! এরপরে সুপ্রভাতের কুÑপ্রভাতসহ আরো কত প্রভাত এল আর গেল! প্রতিবছর যাত্রাপথের দুর্ঘটনায় ২০ হাজার লোকের করুণ মৃত্যু আর কতকাল দেখবো? আমরা কে কখন সড়ক, নৌÑপথের দুর্ঘটনায় পতিত হবো না এর নিশ্চয়তা একশো ভাগই ফাঁকা! কার কাছে বিচার দিব? বাঁচাও আমাদের! ছোট মুখে বড় কথা বলছি আমাকে গুলি করে বা ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেলার বিনিময়েও যদি আমাদের যাত্রা পথের নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয় তাহলে আমি তৈরি আছি! সড়কে মৃত্যুর মিছিল আর নয় বাঁচার মতো বাঁচুক প্রিয় দেশবাসী।

পিবিএ/হক

আরও পড়ুন...