রমজান মাসে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার ১০টি উপায়

রমজান মাস: আত্মশুদ্ধির মাস

মুহাম্মদ আবুল হুসাইন

পবিত্র রমজান মাস হলো তাক্বওয়া অর্জনের মাস, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার মাস, পরহেজগারির মাস, আত্মশুদ্ধির মাস। ইসলামী পরিভাষায় তাক্বওয়া বা পরহেজগারি বলতে বুঝায় আল্লাহকে ভয় করে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা। আর এই তাক্বওয়া অর্জন করাই হচ্ছে রোজার রোজার মূল উদ্দেশ্য। আল্লাহ বলেছেন, ‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর; যাতে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পারো।’’ – সূরা আল বাকারা।

কাজেই কেউ যদি রোজা রেখে খোদাভীতি বা তাক্বওয়া অর্জনের চেষ্টা না করে, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা না করে, তাহলে বুঝতে হবে সে রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত নয় এবং এই রোজা তার কোন কাজেই লাগবে না।এ বিষয়টিই ব্যাখ্যা করে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা আর মিথ্যা কাজ থেকে বিরত থাকতে পারলো না তার উপোস থাকা আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।’’

তাছাড়া আপনি যদি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা না করেন বা মুত্তাকি না হন, তাহলে আপনার পক্ষে হেদায়াত লাভ বা ইসলামের পথে চলা কখনো সম্ভব হবে না।কারণ, পবিত্র কোরআনে সূরা বাকারার একেবারে শুরুতেই আল্লাহপাক জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই মহাগ্রন্থ হচ্ছে তাদের জন্য পথপ্রদর্শক যারা মুত্তাকি; অর্থাৎ যারা সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করে চলে।

তাই, এই পবিত্র মাসে আমাদের নিজেদের মধ্যে এমন কিছু গুণ-বৈশিষ্ট্য অর্জনকরা উচিত যা আমাদেরকে গুণাহ থেকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে এবং সেই সাথে অনাকাক্সিক্ষতভাবে কোন গুনাহ হয়ে গেলে সাথে সাথেই যেন আমাদের মধ্যে অনুশোচনাবোধ তৈরি হয় এবং আমরা যেন যথাযথভাবে তওবা করে নিজেদেরকে শুধরে নিতে সক্ষম হই। এখানে আমরা এমন দশটি গুণ-বৈশিষ্ট নিয়ে আলোচনা করব যেগুলো এ বিষয়ে আমাদেরকে সাহায্য করবে বলে আমরা আশাবাদী।

১) দৃঢ় সিদ্ধান্ত: গুনাহ থেকে বেঁচে থাকারজন্য সিদ্ধান্তের দৃঢ়তাএকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সিদ্ধান্তে অটল থাকতে না পারা বা দুর্বল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা অনেক সময় বিবেকহীন কাজ বা গুনাহ করে ফেলি এবং তওবার উপর অটল থাকতে পারি না। যে কারণে আজ হয়তো অনুশোচনা করলাম কিন্তু কালই আবার ভুলে গেলাম এবং আবার তওবা করলাম এবং আবার ভূল করলাম।

সিদ্ধান্তের উপর অটল বা দৃঢ় থাকার রয়েছে কয়েকটি উপায়। প্রধানউপায় হল আল্লাহ’র স্মরণ। আমরা আমাদের হৃদয়টিকে আল্লাহ’র দিকে রুজু রাখার চেষ্টা করতে পারি। মনের মধ্যে আল্লাহ’র স্মরণ এবং ভয় জারি থাকলে কারো পক্ষে গুনাহ করা সম্ভব হয় না।
আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে; কারণ এটি বারবার চেষ্টা করার অভ্যাস গড়ে তোলে।

২) আল্লাহ’র সাহায্য কামনা: আমাদের উচিত আল্লাহর সাহায্য কামনাকরা। নামাজের সময় সিজদায় কিংবা মুনাজাতের সময় আমরা আমাদের পরোওয়ারদিগারের কাছে আরজ করতে পারি, যেন তিনি আমাদেরকে সিদ্ধান্তে অটল থাকার শক্তি দেন, আমরা যেন আন্তরিকভাবে তওবা করতে পারি এবং তিনি যেন আমাদের তওবা কবুল করেন।

ঈমানদারীর বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে সব কাজে আল্লাহ’র সাহায্য কামনাকরা। মানুষেরমধ্যে সবচেয়ে আদর্শস্থানীয় হচ্ছেন নবী-রাসূলগণ। সেই নবী-রাসূলগণ পর্যন্ত গুণাহ থেকে বেঁচে থাকতে এবং সকল কাজে সব সময় আল্লাহর সাহায্য কামনা করতেন এবং ক্ষমা চাইতেন। পবিত্র কোরআন মজিদে বহু নবীর প্রার্থনার বর্ণনা রয়েছে। যেমন: ‘স্মরণ কর, ইব্রাহিম ও ইসমাইল যখন এই (কা’বা) ঘরের প্রাচীর নির্মাণ করছিল, তখন উভয়েই দোয়া করছিল এই বলে: হে আমাদের রব! আমাদের এই কাজ তুমি কবুল কর, তুমি নিশ্চয়ই সব কিছু শুনতে পাও এবং সবকিছু জানো। হে আমাদের রব! তুমি আমাদের দুজনকেই তোমার ফরমানের অনুগত (মুসলিম) বানিয়ে দাও। আমাদের বংশ হতে এমন একটি জাতির উত্থান কর যারা হবে তোমার অনুগত (মুসলিম)। তুমি আমাদেরকে তোমার ইবাদতের পন্থা বলে দাও এবং আমাদের দোষ-ত্রুটি ক্ষমা কর। নিশ্চয়ই তুমি অতীব ক্ষমাশীল এবং অতিশয় অনুগ্রহকারী।’ -(সূরা আলবাকারা: আয়াত ১২৭-১২৮)

আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)ও দোয়া করতেন এভাবে: ‘হে আমার প্রভূ! আমাকে ক্ষমা কর এবং আমার অপরাধ সমূহ মাফ কর। নিশ্চয়ই তুমি অতীব ক্ষমাশীল এবং অত্যন্ত মেহেরবান।’-সিনানে তিরমিজি (৩৪৩৪) এবংআবু দাউদ(১৫১৬)।

৩) খারাপ পরিবেশ এবং অসৎ সঙ্গ থেকে বেঁচে থাকা : গুনাহ’র কাজে প্রলুব্ধ করে এমন পরিবেশ এবং সঙ্গী-সাথী’র সংস্পর্শ থেকে বাঁচতে পারলে গুনাহ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। কথায়আছে-‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ হাদীসে আছে- মানুষ যে ধরনের লোকদেরসাথে ওঠা-বসা করবে হাশরের দিন সে ধরনের লোকদের সাথেই তাদের পুণরুত্থান হবে।

৪) নৈরাশ্য ও হতাশাপরিহারকরা: মানুষের অন্তরে শয়তানের প্রবেশ করার ক্ষেত্রে এ ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। মুসলমানদের জন্য নিরাশ হওয়া নিষেধ। আল্লাহ বলেন: ‘আল্লাহ’র রহমত থেকে কখনো নিরাশ হয়ো না। অবিশ্বাসী ছাড়া কেউ আল্লাহ’র রহমত থেকে নিরাশহয় না।’-(সূরাইউনুস: আয়াত ৮৭)

হতাশা কাটাতে মহানবীর (সা.) এই হাদীসটি আমাদের সহায়ক হতে পারে: ‘আল্লাহ’র কসম করে বলছি, যাঁর হাতে আমার জীবন, তুমি যদি এমন মানুষ হও যে কখনো কোন পাপ করেনি, তাহলে আল্লাহ তোমাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিবেন এবং অন্য কাউকে তোমার স্থলাভুক্ত করবেন যে গুনাহ করবে এবং তার জন্য আল্লাহ’র কাছে মাফ চাইবে এবং আল্লাহ তাকে মাফ করতে পারবেন।’-(সহিহ মুসলিম-২৭৪৯)

আরেকটি হাদীসে আল্লাহ’র নবী বলেছেন: ‘সমস্ত আদম সন্তানই গুনাহগার। এদের মধ্যে সর্বোত্তম গুনাহগার হল তারা, যারা অনুতপ্ত।’ -(সুনানে তিরমিজি-২৪৯৯)

৫) বেশি বেশি নেক আমলের চেষ্টা করা: গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার সবচেয়েভাল উপায়হল বেশি বেশি নেক আমল করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেন: ‘নিশ্চয়ই নেকআমল বদ আমলকে দূর করে দেয়।’ –(সূরা হুদ, আয়াত-১১৫)

সকল মানুষেরই নেক আমল করার সক্ষমতা রয়েছে। এ কারণে আমাদের উচিত বেশি বেশি নামাজ, কোরআন পাঠ, তওবা এস্তেগফার করা, রোজা এবং যিকর বা আল্লাহ’র স্মরণ সহ নেক আমলের মধ্যে যুক্ত থাকা। এছাড়া ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন, কোরআনপাকের তাফসীর, দরসে হাদীসএবং সাহাবীদেও জীবনী অধ্যয়নও সময় কাটানোর এক ভালো উপায়। রোজা রেখে টেলিভিশন দেখে বা ফেইসবুক/ইউটিউবে ডুবে না থেকে আমরা ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়নের মাধ্যমে মাহে রমজানের পবিত্র সময় গুলোকে কাজে লাগাতে পারি।এছাড়া আমরা অন্যদেরকে সৎ কাজে উদ্বুদ্ধ করা এবং অসৎ কাজ থেকে নিরুৎসাহিৎ করার কাজও করতে পারি।

আমরা আমাদের পিতা-মাতার সেবা করতে পারি এবং অন্যদেরকেও সাহায্য করতে পারি। এভাবে যতটা সম্ভব ভালো কাজের মধ্যে আমরা সম্পৃক্ত থাকতেপারি।

৬) আল্লাহ’র প্রতি, আল্লাহ’র ইবাদতের প্রতি আন্তরিক হওয়া: আমরা যখন আমাদের প্রভূর ব্যাপারে আন্তরিক হব, ইবাদত-বন্দেগীতে আন্তরিক হব, তখন আল্লাহও আমাদের সবকিছু সহজ করে দিবেন। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন কাদেরকে শাস্তি দিবেন তা পবিত্র কোরআন মজিদে উল্লেখ করেছেন। তারপর বলেছেন ‘তাদেরকে ছাড়া যারা তওবা করেছে, নিজেদেরকে শুধরে নিয়েছে, আল্লাহ’র সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছে, আল্লাহ’র জন্যই ইবাদত-বন্দেগীতে আন্তরিক থেকেছে তারা ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত এবং আল্লাহ ঈমানদারদের জন্য বিরাট পুরুষ্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন।

৭) দূরবর্তী আশা পরিহার: পৃথিবীতে আমাদের জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত এবং এ বিষয়টি মাথায় রেখে খুব বেশি দূরবর্তী আশা পরিহার করতে হবে। অর্থাৎ খুব বেশি দীর্ঘ মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা করে তাতে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখার আশা পরিহার করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ’র রাসূল একবার হযরত ওমর (রাঃ)-কে বলেন, ‘পৃথিবীতে এমনভাবে বসবাস কর যেন তুমি একজন মুসাফির।’ – সহীহআলবুখারী

একই প্রসঙ্গে পরবর্তীতে ইবনে উমর একবার বলেছিলেন, ‘তুমি যখন রাতে ঘুমাতে যাবে তখন এ আশাক’রোনা যে তুমি সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠবে। আবার যখন সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠবে তখন রাত পর্যন্ত বেঁচে থাকার প্রত্যাশা করবে না। কাজেই যখন তোমার শরীর ভাল থাকে তখন অসুস্থ হওয়ার আগে তাকে কাজে লাগাও এবং যতক্ষণ জীবিত থাকো মৃত্যু আশার আগে তাকে কাজে লাগাও।’

৮) গুনাহ’র খারাপ পরিণতির ব্যাপারে সজাগ থাকা: কোন গুনাহকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। ছোট-বড় সব গুনাহকেই বিপজ্জনক মনে করে তা থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। গুনাহ’র প্রভাব অনেক সময় গুনাহগারের অধীনস্থ লোক এবং যানবাহনের ওপড়ে পড়ে থাকে। গুনাহকে ছোট করে দেখার কয়েকটি উদাহরণ:

ক. ধর্মীয়জ্ঞান থেকে বঞ্চিত থাকা: এই জ্ঞান হচ্ছে জান্নাতের পথ। জ্ঞান হচ্ছে আলো যা আল্লাহ আমাদের হৃদয়ে স্থাপন করেন আর পাপ এই জ্ঞানকে নিভিয়ে দেয়।

প্রখ্যাত ফকীহহযরতশাফী (র.) যখন শিশু বয়সে তাঁর উস্তাদ হযরতমালিকি (র.) অধীনে পড়াশোনা করছিলেন, তখন মালিকি (র.) তাঁর ছাত্রের মেধা এবং বিচক্ষণতা লক্ষ্য করে তাকে উপদেশ দিয়েছিলেন এই বলে: ‘আমার মনে হচ্ছে আল্লাহ তোমার অন্তরে আলো স্থাপন করেছেন। দেখো, গুনাহ’র অন্ধকার দিয়ে এই আলোককে নিভিয়ে ফেলোনা।’

খ. দ্বীনদারীর নামে জীবনকে কঠিন করে ফেলা:একইভাবেদ্বীনদারীঅবলম্বন করতে যেয়ে কেউ কেউ অহেতুক নিজেকে সেহরি এবং খাদ্য-পুষ্টি থেকে বঞ্চিত রাখে এবং জীবনকে অহেতুক কঠিনতর করে ফেলে। মূলত বৈরাগ্যবাদীধারণা থেকেই মানুষ এটি করে থাকে; যদিও বৈরাগ্যবাদের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই।

পিবিএ/এএইচ

আরও পড়ুন...