খুমেক হাসপাতালে ওয়ার্ডবয় ও নার্সদের দিয়ে চলছে চিকিৎসা সেবা

পিবিএ, খুলনা: রেলওয়ে পুলিশের সদস্য কিসলুর রহমান (৩৫) মেরুদন্ডের ব্যাথা নিয়ে গত ৬ মে ভর্তি হয়েছিলেন খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের অর্থপেডিক বিভাগে। বৃহস্পতিবার (৯ মে) পর্যন্ত তিনি ওই বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পাননি। কাঙ্খিত সেবা না পেয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিতে চাইছেন তিনি।

কিসলুর রহমানের অভিযোগ, গত চার দিন ধরে হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় ও নার্সদের সেবা পেয়েছেন। তারা কেবল ব্যথানাশক ওষুধ প্রয়োগ করেছেন। মাঝে মাঝে একজন ইন্টার্নি চিকিৎসক এসে তার খোঁজ খবর নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘রাতে ব্যথার যন্ত্রনায় ঘুমাতে পারি না। বড় ডাক্তরের কথা জানতে চাইলে তাঁরা ছুটিতে আছেন বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।’
গত বুধবার ( ৮ মে) হাতের আঙুল ভাঙা নিয়ে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে আসেন মূর্শিদা পারভীন নামে এক রোগী। তাকে প্রথমে সার্জারি বিভাগে পাঠানো হয়। সেখানকার কর্তব্যরত ইন্টার্ণি চিকিৎসক তার আঙুলের এক্সরে করার পরামর্শ দেন। হাসপাতালের এক্সরে বিভাগে সরাদিন ঘোরাঘুরির পর জানিয়ে দেওয়া হয় এক্সরে মেশিন নষ্ট। বাইরে থেকে এক্সরে করিয়ে হাসপাতালের রিপোর্ট দেখানোর পর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া অর্থপেডিক বিভাগে। গত দু’দিনে তার আঙুলের ভাঙা জায়গায় ব্যান্ডেজ বাঁধার মত চিকিৎসক পাওয়া যায়নি। বৃহস্পতিবার সকালে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে চিকিৎসক রাতে আসবেন।

কেবল অর্থপেডিক বিভাগের কিসলুর রহমান, মূর্শিদা পারভীন নয়। চিকিৎসক না পাওয়ার এমন অভিযোগ হাসপাতালের মেডিসিন, সার্জারি বিভাগসহ অন্যন্য বিভাগে ভর্তি রোগীদের। অনেকেই হাসপাতালের বেডে দীর্ঘদিন পড়ে থেকেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাক্ষাৎ না পেয়ে ছাড়পত্র নিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (৯মে) সরেজমিন হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে রোগীদের দূর্দশার এমন চিত্র পাওয়া গেছে। চিকিৎসকদের কক্ষগুলিতে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। হাসপাতালটিতে পদে পদে রোগীদের হয়রাণি করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া রোগীদের যে কোন ওষুধ সাপ্লাই না থাকার অজুহাতে বাইরে থেকে কিনে আনার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। অনেক ওয়ার্ডে শয্যা খালি থাকলেও রোগীদের বরান্দায় ঠাসাঠাসি করে থাকতে দেখা গেছে। শয্যা খালি থাকা প্রসংগে ওয়ার্ডের দায়িত্বরত স্টাফদের কাছে জানতে চাইলে তারা ওই প্রসংগে কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে রোগীর স্বজনরা জানিয়েছেন, স্টাফদের সাথে টাকা দিয়ে যোগাযোগ করলে সীট পাওয়া যায়।

হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তিকৃত কয়েকজন রোগীর স্বজন অভিযোগ করেন, সকালে একজন চিকিৎসক ওয়ার্ডে চক্কর দিয়ে চলে যান। সরাদিন আর কোন চিকিৎসকের দেখা পাওয়া যায় না। জরুরী মূহুর্তে ওয়ার্ডে কর্মরত নার্স অথবা ওয়ার্ডবয়কে জানালে তারাই চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। অনেক সময় কর্তব্যরত চিকিৎসককেও ডেকে পাওয়া যায় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালে কর্মরত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধিকাংশেরই ব্যাক্তিগত চেম্বার রয়েছে। হাসপাতালেই নিজস্ব লোক রয়েছে এসব চিকিৎসকের। তারা রোগীদেরকে সরকারি সেবার নানা দূর্দশার কথা বলে ব্যাক্তিগত চেম্বারে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আবার এসব চিকিৎসক বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে জড়িত থাকায় রোগীদের ওইসব হাসপাতালে ভর্তি হওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়। এ জন্য বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিরা মধ্যস্থতা করে থাকেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইন্টার্ণি চিকিৎসক জানান, ‘বড় স্যারেরা সময় দিতে পারেন না। আমাদেরকে চালিয়ে নিতে বলেন। অনেক সময় অনেক জটিল চিকিৎসা আমাদেরকে এড়িয়ে যেতে হয়।’ তিনি জানান, এই হাসপাতালের নানান সমস্যা। হাসপাতালে চিকিৎসকদের কাজ করি আমরা। এখানে তাদেরকে পাওয়াই যায় না। এখানে বেশিরভাগই দরিদ্র রোগীরা আসে। আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজ একটাই যে, কিভাবে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করা যায়।
খুমেক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এটিএম মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, ‘হাসপাতালে সার্বক্ষনিক চিকিৎসক রয়েছে। রোগীদের সেবা না পাওয়ার তো কোন কারণ দেখি না। তবে কিছু সমস্যা রয়েছে, সেগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে।’

উল্লেখ্য ২০০৪ ও ২০১১ সালে সার্টিফিকেট জাল ও দূর্ণীতির অভিযোগে মামলা হয়। এছাড়া দুদকের ঝটিকা অভিযানে সেখানে চিকিৎসক না থাকা, প্যাথলোজি বিভাগে অর্থ আদায়, দালালদের দৌরাত্মসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে।

পিবিএ/এইচআর/হক

আরও পড়ুন...