সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসায় নি:স্ব কার্তিক চন্দ্র

পিবিএ,কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রামে ঘটা করে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস পালন করা হলেও এর সেবা থেকে বঞ্চিত সাধারণ মানুষ। থ্যালাসেমিয়া রোগ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত্ব নেই স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে। অনেকটা দায়সাড়াভাবে চলছে এর কার্যক্রম। নাগেশ্বরীর মাদারগঞ্জ কমিউনিটি ক্লিনিকের পরিত্যক্ত জমিতে আশ্রয় নেয়া ভুমিহীন কার্তিক চন্দ্র দাসের পরিবার থেলাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত। এ তথ্য নেই কোথাও। যেন আলোর নীচে অন্ধকার। নাগেশ্বরীতে হরিজন সম্প্রদায়ের কার্তিক চন্দ্র দাসের দুই সন্তান সাগর ও শাওন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত।

অসহায় এ পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর যেন কেউ নেই। চার বছর ধরে চিকিৎসার পিছনে শখের তবলা-হারমোনিয়াম, গলার চেন, দুল এমনকি হাড়ি-পাতিল ও ঘরের খুটি বিক্রি করে নি:স্ব হয়ে গেছেন তিনি।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারের দ্বারে-দ্বারে ঘুরেও মেলেনি সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা’র আওতায় কোন সহায়তা। ফলে নদী ভাঙনের শিকার এই অসহায় পরিবারটি এখন জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি বৃত্তবানদের সহযোগিতা চেয়েছেন।

স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, মরণ ব্যাধী থ্যালাসেমিয়া বংশগত রক্তস্বল্পতা জনিত একটি রোগ। দেশে প্রায় দেড় কোটি মানুষ এই রোগের বাহক। এই রোগের স্থায়ী চিকিৎসা হচ্ছে ‘বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন’ ও ‘জিন থেরাপী।’ তবে এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসায় নি:স্ব কার্তিক চন্দ্র
কার্তিক চন্দ্র দাসের পরিবার

কার্তিক চন্দ্র দাস (৪২) জানান, নাগেশ^রীর কচাকাটা ইউনিয়নের মাদারগঞ্জ এলাকায় তাদের মূল বাড়ী ২০১১ সালে ব্রহ্মপূত্র নদের ভাঙনে বিলিন হয়ে যায়। এরপর তারা মাদারগঞ্জ কমিউনিটি ক্লিনিকের এক কোনে স্থানীয়দের সহযোগিতায় মাসহ পরিবারপরিজন নিয়ে ঝুপড়ি ঘরে ঠাসাঠাসি করে ঠাঁই নেন। মাদারগঞ্জ বাজারে রাস্তার পাশে একটি ঘর তুলে সেখানে মোবাইল সার্ভিসিং-এর ব্যবসা শুরু করেন কার্তিক।

পাশাপাশি সঙ্গীত পাগোল এই মানুষটি গানের টিউশনি করাতেন বাড়ী বাড়ী গিয়ে। এভাবে টানাটানির সংসারে দুই পূত্র ও এক কন্যা সন্তান তাদের সংসারে আলো করে আসে। কিন্তু ২০১৬ সালে অসুস্থ্য বড় ছেলে সাগর চন্দ্র দাস (১৫)কে কুড়িগ্রামে ডাক্তার দেখালে তারা রংপুরে ডা: কামরুজ্জামানের কাছে রেফার্ড করেন। সেখানে বড় ছেলে সাগর ও ছোট ছেলে শাওনের থ্যালাসেমিয়া হয়েছে বলে সনাক্ত করা হয়।

এসময় মেয়ের বিয়ের জন্য জমানো ডিপিএস’র ২২ হাজার টাকা ভেঙ্গে রংপুরে চিকিৎসার পিছনে খরচ হয়ে যায়। এছাড়াও ঘাড়ের উপর বোঝা হয়ে আছে আরডিআরএস ও স্থানীয়ভাবে লাভের উপর ঋণের ৪০ হাজার টাকা।
হতাশ কার্তিক চন্দ্র দাস ছলছল চোখে বলেন, প্রথমে ১৫দিন পর পর দুই ভাইকে দুই ব্যাগ করে রক্ত দেয়া হতো। দুজনই ‘ও’-পজেটিভ গ্রুপের। এতে মাদারগঞ্জ থেকে নাগেশ^রী নিয়ে এসে বন্ধু-বান্ধবদের সহযোগিতায় রক্তদান করে আসছেন তিনি।

এছাড়াও প্রতি মাসে রংপুর যাতায়াত ও খরচ বাবদ রাস্তার পাশে নেয়া দোকানের পজেশন বিক্রি করে দিয়েছেন। স্ত্রীর গলার চেন, কানের দুল, মেয়ের বিয়ের জন্য জমানো ডিপিএস ভাঙিয়েছেন। ভূমিহীন এই নি:স্ব পরিবারটি সন্তানদের চিকিৎসা ও দু’বেলা অন্ন জোটানোর জন্য ঘরের হাড়ি-পাতিল, খুটি বিক্রি করে দিয়েছেন। মোবাইল সার্ভিসিং করে দিনে ২ থেকে ৩শ’ টাকা আয় হয় তাই দিয়ে চলে টানাটানির সংসার।

নিজের পরিবারের অসহায়ত্বের কথা বলেও চেয়ারম্যান বা মেম্বারের কাছ থেকে এতটুকু সহায়তা পাননি তিনি।
কার্তিকের স্ত্রী ঝুনি রানী (৩৪) জানান, মেঝো মেয়ে ঝিলিক রানী (৭) ও এখন অসুস্থ্য হয়ে পরছে। তিনি কান্নাজড়িত স্বরে বলেন, অসুস্থ্য অবস্থায় ছেলেদের পেট ফোলা থাকতো। পা ও মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা হতো। জ¦র থাকতো সবসময়। চোখ ও প্রসাব হলুদ হতো।

এছাড়াও দু থেকে তিনদিন পরপর পায়খানা হতো। বড় ছেলে সাগর মাদারগঞ্জ বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্র। সে লেখাপড়ার পাশাপাশি মাদারগঞ্জ বাজারে ঝাড়–দারের কাজ করে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে জানান, ‘হামরাগুলা নীচু জাতের মানুষ। হামাকগুলাক দেকপের কাঁইয়ো নাই। ঘরোত খাবার নাই। ছওয়া দুইটার চিকিৎসের টেকা নাই। চেয়ারম্যানও কিছু দেয় না। হামরা শ্যাষ হয়া গেছি। হামাক কি কাঁইয়ো দেকপের নয়।’

বিষয়টি নিয়ে কচাকাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আকমল হোসেনের ফোন নম্বরে বারবার যোগাযোগ করেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা: এস.এম আমিনুল ইসলাম পিবিএকে জানান, স্বাস্থ্য বিভাগে থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্তদের তালিকা করা হয় নাই। তবে সারথী নামে একটি সংগঠন তালিকার কাজ করছে। কাল আসলে সেটি দেয়া যাবে। তবে এই পরিবারটিকে তালিকাভুক্ত করা না হলে সেটি আমরা দেখবো।

পিবিএ/এমআইবি/আরআই

আরও পড়ুন...