মা দিবসে সকল মা’র প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী

অলোক আচার্য,পাবনা: আমাকে তোমরা একটি শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দেবো। সম্রাট নেপোলিয়নের এই উক্তি সবার জানা। মা আসলে কে? একজন মা তার সন্তানের জন্য একটি পৃথিবী। পৃথিবীর কোথাও আশ্রয় না মিললেও মা’র আঁচলতলে ঠিকই আশ্রয় মিলে যায় সন্তানের। সে সংখ্যায় যতজনই হোক। মাকে আমার পরে না মনে,শুধু কখন খেলতে গিয়ে,হঠাৎ অকারণে,একটা কী সুর গুনগুণিয়ে, কানে আমার বাজে, মায়ের কথা মিলায় যেন,আমার খেলার মাঝে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা’কে নিয়ে লেখা এই কবিতা পড়লে মা’র কথা মাকে হারানোর কথা মনে পরে। মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বন্ধু। পৃথিবীর কোন সম্পদ,টাকা-পয়সা,গাড়ী,বাড়ি হারানোর সাথে মা’কে হারানোর তুলনা হয় না। মা নিয়ে যুগে যুগে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা,গান,গল্প,উপন্যাস,প্রবন্ধ। ম্যাক্সিম গোর্কির মা, শওকত ওসমানের জননীসহ কেবল মা’কে কেন্দ্র করেই কত সাহিত্য উঠে এসেছে। আরও বহু রচনা রচিত হবে নিশ্চিত। মোট কথা যতদিন এ বিশ^ তার অস্তিত্ত বজায় রাখবে ততদিন মাকে নিয়ে অনুভূতির কথা, বেদনার কথা নানাভাবে উঠে আসবে। পৃথিবীর সব সম্পর্ক, সব ভালোবাসা একটি সম্পর্কের কাছে এসে মাথা নোয়ায়। তা হলো মা আর সন্তানের সম্পর্ক। কোন ব্যাখ্যা নেই, কোন নাম নেই, কোন লাভ ক্ষতির হিসেব নেই, পাওয়া বা না পাওয়ার অতৃপ্তি নেই আছে কেবল পরিপূর্ণতা। এ এক নির্মোহ পবিত্র বন্ধন। যা কেবল মা আর সন্তানের মধ্যে হতে পারে। মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার বিশ^ মা দিবস পালন করা হয়।
মা’কে নিয়ে আলাদা একটি দিবসের প্রচলন হলেও বস্তুতপক্ষে কোন নির্দিষ্ট দিনে বা সময়ে বা উপলক্ষ করে মা’র প্রতি ভালোবাসা হিসেব করা যায় না। এটি সর্বকালের,সর্বসময়ের। মাতৃস্হনেহ সকল গন্ডির উর্ধে। মা’র আঁচল ছায়ার প্রশান্তি পৃথিবীর সব শান্তি আর সুখের উপরে। ঠান্ডা এসির বাতাসও বুঝি মায়ের আঁচলের ছায়ার প্রশান্তি এনে দিতে পারবে না। কারণ এটি একদিনে প্রশান্তি অন্যদিকে নিরাপত্তার ছায়া। কোন সংজ্ঞায়,কোন মনীষির লেখায় মা’র তুলনা সম্পূর্ণ উপস্থাপন করা সম্ভব হবে না। তা কেবল খন্ডিতই থেকে যাবে। থেকে যাবে অপূর্ণতা। রচিত হবে কোন মা’কে নিয়ে অন্যরকম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তাই মাকে শ্রষ্ঠা পর স্থান দেয়া হয়েছে। সন্তানের সকল সুখ শান্তি এমনকি স্বর্গ মায়ের পায়ের নিচেই নিহিত।
মা দিবস চালু হওয়ার পেছনে মূলত কয়েকটি দেশের ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস পাওয়া যায়। ভিন্ন মতগুলো একত্রিত করে আজকের দিবসে এসেছে। তবু পৃথিবীর সব দেশ কিন্তু একই সাথে এই দিবস পালন করে না। কিছু দেশে আলাদা দিনও রয়েছে। কয়েকটি ইতিহাসের একটি হলো ১৬ শতকে ইংল্যান্ডে মা দিবস পালন করার খবর পাওয়া যায়। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সেই সময়ে জুলিয়া হাও নামের এক গীতিকার যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে আমেরিকার সব মাকে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক মা দিবস পালন করতে চাচ্ছিলেন।

তিনি আংশিক সফলও হয়েছিলেন। কারণ সারা বিশ্বে না হলেও তার শহরে ঘটা করেই পালিত হতো। ১৯১২ সালে আনা জার্ভিস স্থাপন করেন আন্তর্জাতিক মা দিবস সমিতি এবং মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার ”আর মা দিবস” শব্দের বহুল প্রচলন করেন। আবার হাজার বছর আগেও প্রাচীন রোম ও গ্রীসে তাদের দেবীর বন্দনায় আজকের মা দিবসের কিছুটা মিল দেখা যায়। এছাড়া ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে দীর্ঘকাল ধরে মাদারিং সানডের মত বহু আচার পালন করা হতো মায়েদের এবং মাতৃত্বকে সম্মান জানানোর জন্য। এভাবে দেখা যায় মা দিবস হিসেবে পালন করার অনেক আগে থেকেই মায়েদের সম্মানার্থে এরকম বহু অনুষ্ঠান পালন করা হতো। এবং সারা বিশ্বে বিভিন্নভাবে এসব আয়োজন ও পালন করতো।

সন্তান কখনোই মা’র কাছে বোঝা হয় না কিন্তু মা অনেক সন্তানের কাছেই বোঝা হয়। একজন মায়ের অনকেগুলো সন্তান থাকলেও সবাইকে সমান ভালোবাসা দিয়ে বড় করে, তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু সেই অনেকগুলো সন্তানের কাছে একজন মা অনেক ক্ষেত্রে বোঝা হয়ে দাড়ায়। তখন দেখা যায় মা’র খাওয়া দাওয়া ভাগ হয়ে যায়, পোশাক দেয়ার দায়িত্ব ভাগ হয়ে যায়। তাকে একবেলা এই সন্তানের ঘরে তো আরেক বেলা অন্য সন্তানের ঘরে খেতে হয়। অথচ এই একমায়ের বুকের দুধ খেয়েই এসব সন্তান বড় হয়েছে।
তাইতো বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে বহু বৃদ্ধা মহিলার দেখা মেলে যাদের সন্তান বড় বড় পদে আসীন। মা’র কাছে একাধিক সন্তান বহনের ক্ষমতা থাকলেও অনেক সন্তান মিলে একজন মা’কে বহন করতে হিমশিম খেয়ে যায়! পণ্যের মতো তাকে ভাগ করে নেয়। কোন সন্তান কতদিন মা’কে দেখবে, কে কতদিন খেতে দেবে এসব আরকি। মা’র জন্য একটু জায়গা তাদের নেই। মা বাবাকে দেখভাল করার জন্য আজ আইনের দরকার হয়। যদিও এই দাবি যুগোপযুগী এবং সময়ের সাথে প্রয়োজন হয়ে দেখা দিয়েছে। সন্তান দেখাশোনার জন্য বা বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য তো কোন আইন নেই। একদিন যখন সন্তানের সুখের জন্য নিজের আঁচল বিছিয়ে দিয়েছিল সেই সন্তানের দামী দামী আসবাবপত্রের ভিড়ে মা’র জন্য থাকার জায়গা কোথায়! মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে শুরু করে কথিত হাই সোসাইটিতে এসব চিত্র চোখে পরে।

তাই মা’র ঋণ জন্ম জন্মান্তরেও শোধ করা যায় না। প্রতিটি মায়ের শেষ বয়সটা যেন একটু নিরাপদে, সন্তানের সাথে পরিবারের ভেতর হাসি আনন্দে পার করতে পারে সে দায়িত্বটুকু আমাদের নিতেই হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান দিয়ে শুরু করেছিলাম। শেষ করি নচিকেতার গান দিয়ে। ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার, মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার, নানান রকম জিনিস আর আসবাব নামী দামী, সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি।
কেবল একটি দিবস দিয়ে মা’র প্রতি ভালোবাসা দেখানো যায় না। কত মা প্রতিদিন রাস্তায় অনাহারে আধপেটায় রয়েছে তার খবর কে রাখছে। কয়েকদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম এক অন্ধ বৃদ্ধা মহিলাকে তার সন্তানরা গোয়ালঘরে রেখে দিয়েছে। এই যদি হয় মায়েদের অবস্থা তাহলে বছরের একদিন মায়েদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে দিবস পালন করা উপহাস ছাড়া কিছু মনে হয় না।

পিবিএ/হক

আরও পড়ুন...