শুধু দিনের আলোতে মেয়েদের গ্রামে পুরুষের প্রবেশাধিকার

 

নতুন রকমের একটা জীবনের খোঁজে অনেক নারী মিলে তৈরি করেছেন নতুন এক ঠিকানা, যার নাম দেয়া হয়েছে জিনওয়ার
উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় কুর্দি নারীদের জিনওয়ার ছবি:সংগৃহিত

পিবিএ,ডেস্ক: নতুন রকমের একটা জীবনের খোঁজে অনেক নারী মিলে তৈরি করেছেন নতুন এক ঠিকানা, যার নাম দেয়া হয়েছে জিনওয়ার। কুর্দিশ ভাষায় এর অর্থ ‘মেয়েদের জায়গা।’

দুই বছর আগে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় এই গ্রাম তৈরি করেন কুর্দি নারীরা। এই গ্রামে নারীরা সদাস্বাগত। শিশুরাও। ধর্ম, জাত, রাজনৈতিক মতামতে কোনও বাধা নেই সেখানে।কট্টর পরিবার, পারিবারিক কলহ বা বিবাদ আর গৃহযুদ্ধের বীভৎসতা পেরিয়ে এ গ্রামে ঠাঁই নিচ্ছেন অনেক নারী।তেমনই এক নারী ফাতেমা এমিন, আইএসের সঙ্গে যুদ্ধে স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি তার বাচ্চাদের নিয়ে ঠাঁই নিয়েছিলেন এই জিনওয়ারে।অনেক লড়াই থেকে ঘুরে-ফিরে ‘জিনওয়ারে’ এসে পৌঁছেন সিরিয়ার ফাতেমা।

আন্তর্জাতিক একটি সংবাদ সংস্থাকে ফাতেমা বলছিলেন, নারীদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছেন যারা বা যারা ভাবেন, সমাজে নারীরা দুর্বল, তারা নিজেদের আর বাচ্চাদের সামলাতে পারেন না, সেসব ব্যক্তির মুখের উপরে জবাব দিচ্ছে জিনওয়ার। নারীরা নিজের বাড়ি তৈরি করছেন। আমরা একটা গ্রাম তৈরি করেছি, শুধু কুর্দি নারীদের জন্য নয়। আরব, ইয়েজিদি এবং বিদেশি অনেক বন্ধুও আছে আমাদের সঙ্গে।

দুই বছর আগে জিনওয়ার শুধু এক খণ্ড জমি ছিল। স্থানীয় কুর্দি নারীরা একজোট হয়ে সেখানে বসতি গড়ার পরিকল্পনা করেন। পাশে দাঁড়ায় আন্তর্জাতিক কিছু সংগঠনও। গড়ে তোলা হয় ৩০টি বাড়ি, একটা বেকারি আর একটি দোকান। চাষের জন্যও রয়েছে কিছুটা আবাদি জমি। শিশুরা বড় হলে তারা যদি এখানেই থেকে যেতে চায়, থাকবে। না চাইলে, নয়। এখনও তারা গ্রামের বাইরে স্কুলে যায়। আর গ্রামের নারীদের শিক্ষা দেয়া হয় বিশেষ পদ্ধতিতে।

এই গ্রামের ঘরগুলো হাতে তৈরি মাটির ইট দিয়ে বানানো। এখন জিনওয়ারে থাকেন ১৬ জন নারী আর ৩২টি শিশু। পুরুষেরা এখানে আসতে পারেন শুধু দিনের বেলায়। তবে নারীদের সম্মান করা যে পুরুষদের ধাতে নেই, তাদের জন্য জিনওয়ারের দরজা বন্ধ। নারীরাই নজর রাখেন, গ্রামে কে ঢুকছে, কে বেরোচ্ছে। রাতে তাদের সঙ্গে থাকে অস্ত্র, নিরাপত্তার জন্য।

চার বছর আগে আগস্টে স্বামীকে হারিয়েছিলেন ফাতেমা। ছয় সন্তানকে নিজের কাছে রাখার জন্য ৩৫ বছর বয়সী এই নারীকে লড়াই চালাতে হয়েছে শ্বশুরবাড়ির লোকদের সঙ্গে। তারা চাননি ফাতমা কাজ করুক। সিরিয়ার শহর কোবানিতে সরকারি কাজ করতেন লড়াকু ফাতমা। শ্বশুরবাড়ির লোকের দাবি ছিল, কাজ ছেড়ে মেয়েদের বড় করুন ফাতমা। অবশ্যই তা হতে হবে শ্বশুরবাড়ির তত্ত্বাবধানে।

ফাতমার ভাষায়, ‘ওদের মনে হয়েছিল, আমি একা নারী, ছয়টা মেয়ে নিয়ে! এত দুর্বল। কোনও পুরুষ নেই দেখভালের জন্য। একা মেয়েদের জন্য এক নারী বেঁচে রয়েছে, এটা ওদের ভাবনাতেই আসত না।’কুর্দ নারী আন্দোলনকারীদের একটি গোষ্ঠীর সাহায্যে মেয়েদের নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন ফাতেমা। তাকে আপন করে নেয় জিনওয়ার।

ফাতেমার মতো জিনওয়ার গ্রামে গিয়েছেন জিয়ান আরফিন নামে এক নারী। ৩০ বছর বয়সী এই নারী দুই মেয়ে আর এক ছেলের মা। তিন মাস আগে জিনওয়ারে এসেছেন জিয়ান। সিরিয়ার উত্তর পূর্বের শহর আফরিনে তুরস্কের অভিযান থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসেন তিনি।

আরফিন বলেন,‘জিনওয়ার এক অসাধারণ বসতিস্থান। এখানে একটা স্বাভাবিক জীবন রয়েছে প্রত্যেকের জন্য । আমরা কাজ করি, ফসলের চাষ করি,তা থেকে অর্থও পাই। গ্রামের কাউন্সিলর সব দেখা শোনা করে।’

এমন আরও অনেক মুখ। ভিটেছাড়া, ধর্ষিতা, জেলবন্দি— আইএস বা অন্য কোনও গোষ্ঠীর নির্যাতন শেষে এখন বাঁচার মানে খুঁজে পেয়েছেন।সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে তৈরি হওয়া শরণার্থী সঙ্কট এখনও প্রতি মুহূর্তে তাড়া করছে গোটা পৃথিবীকে।

ফাতেমা বলেন, ‘যুদ্ধে আমাদের সবার ক্ষতি হয়েছে।আমরা সবকিছু হারিয়েছি । সব নারী আঘাত পেয়েছেন। সব নারী অনেক কিছু হারিয়েছেন। জিনওয়ার সবাইকে এক সুতোয় বেঁধেছে।’

পিবিএ/এইচটি

আরও পড়ুন...