চাঁদপুরে কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোই স্বাস্থ্যসেবার মূলমন্ত্র

পিবিএ,চাঁদপুর: স্বামীকে হালের জমিতে “জলপানী” (বেলা ১০টায় সকালের খাবার) দিয়ে ফরিদা এসেছিলেন গন্ধর্ব্যপুর উত্তর কমিউনিটি ক্লিনিকে। চার বছরের শিশু বিশুর জ্বর। সেই সাথে খক খক করে কাশিও হচ্ছিল। দুদিন ধরে ঘ্যানর ঘ্যানর করছিল বাড়িতে। বর্গা জমিতে বোরো ধানের চারা রোপণ করতে হবে তাই উপজেলা হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে যাবার মতো সময় নেই তার স্বামীর।
স্বামী বাড়ি ফেরার আগেই আবারো দুপুরের খাবার ঠিক ঠাক করতে হবে তাকে। তাই বিশুর জন্য জ্বরের ওষুধ নিয়ে তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। পথে ফরিদা পিবিএ’কে জানান, তার সংসার জীবনের এসব ব্যস্ততার কথা। তারপরও তিনি (ফরিদা) খুশি ছেলেকে নিজেই ক্লিনিকে ডাক্তারের কাছে আনতে পেরেছিলেন বলে। বিনাপয়সায় ছেলের জন্য প্যারাসিটামল ও অ্যামোক্সাসিলিন নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন ওই গৃহবধূ।


ফরিদা ছাড়াও তখন ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন সুফিয়া, ওবাইদা ও মিতা রানীসহ আরও অনেকে। তাদের বাড়ি উপজেলা সদর থেকে ১১ কিমি দূরে, প্রত্যন্ত গ্রাম গন্ধর্ব্যপুরে। জানালেন, তারাও সংসারের কাজ হাতে ঠেলে পাশের ক্লিনিকে এসেছেন চিকিৎসাসহ ওষুধ নিতে। এ সময় গ্রামের বৃদ্ধ খবির উদ্দিনেরও (৭০-৭২) দেখা মিললো। হাতের লাঠি ভরসা করে তিনি মাথা ব্যথার ওষুধ নিতে ক্লিনিকে এসেছিলেন দেড় কিলোমিটার হেঁটে। গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকে আগত রোগি শহিদুল ইসলাম জানান, সাধারণ অসুখ-বিসুখে এখন তাদের আর হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয় না। ছুটে যেতে হয় না উপজেলা সদরের হাসপাতালে। কালচোঁ উত্তর কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসা নাজমা বিবি জানান, কমিউনিটি ক্লিনিক চালু হবার পর হাতের নাগালে চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ দুটোই পাচ্ছেন তারা।

শিক্ষা বঞ্চিত অজোপাড়া-গাঁর এসব দরিদ্র বাসীন্দারা চিকিৎসার জন্য চিরদিন হাতুড়ে ডাক্তার ও বৈদ্য-কবিরাজদের ওপর নির্ভর করেছিলেন। কিন্তু সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু হবার পর খোদ এসব গ্রামেই এখন চিকিৎসা ব্যবস্থার দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। সাধারণ অসুখ-বিসুখসহ প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে এখন আর তাদের হাতুড়ে ডাক্তার বা ভুতুড়ে কবিরাজের শরণাপন্ন হতে হয় না। কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রশিক্ষিত হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার রয়েছেন। তার মাধ্যমেই কমিউনিটিবাসী চিকিৎসা ও ওষুধ দুটোই পাচ্ছেন।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষে ৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এইসব কমিউনিটি ক্লিনিকের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই ক্লিনিকগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবারও ক্ষমতায় এসে (আরসিএইচআইবি) প্রকল্পের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো চালুর উদ্যোগ নেন।

সব ক্লিনিকে হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার পদ সৃষ্টি করে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে নিয়োগ ও অক্টোবর মাসে যোগদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাস ও কম্পিউটার বিষয়ে অভিজ্ঞ প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে বলে উল্লেখ ছিল। বিজ্ঞপ্তিতে আর কোনো যোগ্যতা কিংবা অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়নি। নিয়োগের পর তিনমাস প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তাদের।
কিন্তু সচেতন মহলের অভিমত, মাত্র তিন মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে একজন ‘আনাড়ি’কে ‘নাড়ি জ্ঞান সম্পন্ন’ করে তোলা যায় না। তাই ওষুধ ও রোগ সম্পর্কে তাদের প্রাথমিক নির্ণয় নির্ভুল না হওয়াই স্বাভাবিক।
বাস্তবে ‘নাড়ি জ্ঞানে কাঁচা’ এইসব হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে বেশকিছু গুর”ত্বপূর্ণ ওষুধ (৩১টি প্রিপারেশনের ওষুধ সরবরাহ করা হয় এইসব ক্লিনিকে)। সচেতনদের পরামর্শ, সঠিক (যোগ্য) পদ সৃষ্টি করে কমিউনিটি ক্লিনিকে আরো প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও সেবাসহায়ক লোকবল নিয়োগ করতে হবে। তাহলে ‘জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা’ নিশ্চিত করতে গ্রহণ করা সরকারের এই মহৎ উদ্যোগ আরো অর্থবহ হয়ে উঠবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি মাসে এইসব কমিউনিটি ক্লিনিকে প্যারাসিটামল, অ্যামোক্সাসিলিন, ডক্সাসাইক্লিন, কোট্রিমসহ ৩১ প্রকারের (প্রিপারেশনের) ওষুধ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এছাড়া কাটা-ফাটা সেলাই ও ডায়াবেটিস পরীক্ষার যাবতীয় সরঞ্জামাদিও সরবরাহ করা হয়। ক্লিনিকে দেয়া হয়েছে ল্যাপটপসহ ইন্টারনেট সুবিধাও।
নিয়োগকৃত হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের ১২ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দেয়া হয়েছে গ্রামীণ জনপদের চিকিৎসাসেবার দায়িত্ব। শুধুমাত্র চাঁদপুর জেলার ৮ উপজেলায় রয়েছে ২৯১টি ক্লিনিক। যার মধ্যে ১৮৪টি চলমান রয়েরেছ। এ সব ক্লিনিকে প্রতিদিনই গুরুত্বপুর্ণ ডাক্তারগণ রোগী দেখছেন। পাশ-পাশি যথাসম্ভব প্রয়োজন ঔষধও প্রদান করা হচ্ছে।
এসব ক্লিনিকে সর্দি-জ্বর, মাথা ব্যথা, কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডায়রিয়াসহ অনেক রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা পাচ্ছেন প্রত্যন্ত জনপদের মানুষ।

সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানাযায়, সপ্তাহের তিনদিন স্বাস্থ্য সহকারী ও তিনদিন পরিবার কল্যাণ সহকারী নিয়মিতভাবে চিকিৎসা পরামর্শ প্রদান করছেন। গর্ভবতী ও প্রসূতি মাসহ শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার যাবতীয় পরামর্শও মিলছে এইসব কমিউনিটি ক্লিনিকে। গৃহবধূরা পাচ্ছেন জন্ম নিরোধ পিল, ইনজেকশন ও গর্ভকালীন টিকার সুবিধা।
স্বাস্থ্য সচেতন সুধীদের অভিমত, এইসব কমিউনিটি ক্লিনিককে গ্রামীণ জনপদের স্বাস্থ্য সেবার কেন্দ্রে পরিণত করে তুলতে হলে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল নিয়োগ করতে হবে। তারা মনে করেন, ‘স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত’ করতে হলে কমিউনিটি ক্লিনিকের পরিসর আরো কিছুটা বাড়াতে হবে। মা ও শিশুর চিকিৎসায় কমিউনিটি ক্লিনিককে আরো নির্ভরযোগ্য করে তুলতে হবে। তাছাড়া গ্রামীণ জনপদে ‘ধাত্রী সেবা’ নিশ্চিত করার গুরুত্বের কথাও বিশেষভাবে পরামর্শে আনছেন তারা।

পিবিএ/এমএ/হক

আরও পড়ুন...