সমাজ পরিবর্তনের জন্য চিন্তার পুনর্গঠন ও আত্মশুদ্ধি অপরিহার্য

দিন বদল করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন ‘দিল’ বদল

মুহাম্মদ আবুল হুসাইন

আমরা দিন বদল করতে চাই।কিন্তু ‘দিল’ বা অন্তর পরিবর্তনের কথা ভুলে যাই।আপনি সমাজকে পরিশুদ্ধ করতে চান? তাহলে সবার আগে আপনাকে পরিশুদ্ধ হতে হবে।আপনি যদি একটি অফিসের ‘বস’ হন আর চান যে, আপনার অফিস দুর্নীতিমুক্ত হোক, তাহলে অবশ্যই আপনাকে আগে দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে।একইভাবে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে দেশের কাণ্ডারীদেরকে আগে দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে।একইভাবে যারা দেশকে আলোকিত করতে চান তাদের উচিত নিজেদের অন্তরের অন্ধকারকে আগে দূর করা।আর যারা জোর করে দেশের মানুষের উপর কোন আদর্শ চাপিয়ে দিতে চান তাদের বুঝা উচিত, মানুষের মনের স্বাধীনতা আল্লাহ’ই প্রদান করেছেন। আর আল্লাহ’র রাসূলও এমনটি করেননি।

আসলে মানুষের ঈমান বা তাদের বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনার পরিশুদ্ধিই হলো আত্মশুদ্ধি ও সমাজ-সংস্কারের প্রথম সোপান। আর এ চিন্তার বিশুদ্ধি বা ঈমানের অনিবার্য দাবীই হচ্ছে তা মানুষের কর্মধারাকে আখেরাতমুখী করে দেবে, আল্লাহ’র হুকুম পালনে, স্রষ্টার সামনে নিজেকে সোপর্দ করে দিতে, তাঁর কাছে আত্মসমর্পন করতে উদ্বুদ্ধ করবে। তখন নফসের গোলামী, লোভ, হিংসা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, জিঘাংসা মানুষের কাছে খুবই জঘন্য, হীন ও ইতরতা বলে মনে হবে। নফসের তাড়নায় কখনো কোন ভুল করে ফেললেও এ ঈমানই আবার তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনবে এবং নফসের গোলামী ও পাপের জন্য সে অনুতপ্ত হবে এবং এজন্য বার বার সে প্রভুর কাছে লজ্জিত হবে, ক্ষমা ভিক্ষা করবে। এ প্রসঙ্গে মহানবী বলেছেন -‘ঈমানদার ব্যক্তি ও ঈমানের দৃষ্টান্ত হচ্ছে খুঁটির সাথে (দড়িবাঁধা) ঘোড়া, সে চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত খুঁটির দিকেই ফিরে আসে। অনুরূপভাবে ঈমানদার ব্যক্তিও ভুল করে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ঈমানের দিকেই ফিরে আসে। অতএব তোমরা মুত্তাকী লোকদেরকে তোমাদের খাদ্য খাওয়াও এবং তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করো।’ [বায়হাকী]

কাজেই ঈমানদারী আর নফসের গোলামী এ দুটো কখনো একসাথে চলতে পারে না। বরং আমলের পরিশুদ্ধিই হলো ঈমানদারীর বৈশিষ্ট। মহানবী (সঃ) বলেছেন – ‘ছবর (ধৈর্য ও সহনশীলতা) আর ছামাহাত (দানশীলতা, নমনীয়তা ও উদারতা) হচ্ছে ঈমান।’ -[মুসলিম]

নফসের সংকীর্ণতার কারণে দেখা যায় যে, মানুষ নিজের জন্য তো সব সময় ভাল জিনিসটি পছন্দ করে, কিন্তু অপরের বেলায় তা ভুলে যায়; নিজে ভাল জিনিসটি গ্রহণ করে অপরকে খারাপটি প্রদান করে। যেমন অনেক সময় দেখা যায় যে, আমরা পঁচা ও পুরাতন টাকা বেছে বেছে অন্যকে দেই, আর ভাল ও নতুন টাকা নিজের কাছে রেখে দিই। কিন্তু ইসলামী সংস্কৃতি কিন্তু এর বিপরীত। এ প্রসঙ্গে মহানবীর (সঃ) বাণী হচ্ছে – ‘তোমাদের মধ্যে কেউই ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, তার ভাইয়ের জন্যও তাই পছন্দ না করবে।’ [বুখারী-মুসলিম]

ঈমানদারীর বৈশিষ্ট সম্পর্কে মহানবী (সঃ) আরো বলেছেন – ‘তোমাদের মধ্যে কেউই ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ তার কামনা-বাসনাকে আমার উপস্থাপিত দ্বীনের অধীন না করবে।’ -[শরহু সুন্নাহ]

একবার এক সাহাবী মহানবীকে জিজ্ঞেস করলেন যে, ঈমান কাকে বলে, তার নিদর্শন বা পরিচয় কি? তখন মহানবী যা উত্তর করলেন তা হলো- ‘তোমাদের ভাল কাজ যখন তোমাদেরকে আনন্দ দিবে এবং অন্যায় ও খারাপ কাজ যখন তোমাদেরকে অনুতপ্ত করবে তখন তুমি বুঝবে যে, তুমি মুমিন ব্যক্তি।’ -[মুসনাদে আহমদ]

কাজেই বাস্তব কর্মক্ষেত্রের কঠিন ময়দানে আল্লাহ’র আনুগত্যই হচ্ছে ঈমানের অনিবার্য দাবী। ইসলামের পরিভাষায় একেই আমলে সালেহ বা নেক আমল বলা হয়। বাস্তব আনুগত্যের ক্ষেত্রে এসে মানুষের ঈমান ও বিবেক যে অগ্নি-পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, সে পরীক্ষার আগুনে পুড়ে পুড়ে মানব সত্তার যে বিনির্মাণ হয় তাতেই হয় তার যথার্থ তাযকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি। আর ইসলামের দৃষ্টিতে এটিই হচ্ছে মনুষ্যত্বের যথার্থ বিকাশ-প্রক্রিয়া। কিন্তু এই বাস্তব কর্ম ও পরীক্ষা ক্ষেত্রকে শয়তানের হাতে ছেড়ে দিয়ে যদি কেউ শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক উপাসনা আর বাহ্যিক বেশভুষাকেই আত্মশুদ্ধির একমাত্র উপায় মনে করে তাহলে সে ব্যক্তি সমাজে একজন দ্বীনদার পরহেজগার হিসেবে পরিচিতি পেয়ে হয়তো আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারে, কিন্তু তার এ আত্মতৃপ্তি পরকালে বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

পৃথিবিতে আল্লাহ’র কালাম এবং সেই সাথে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’র জীবনের প্রধান মিশন ছিল মানুষের জীবনকে পরিশুদ্ধ করা, তাদেরকে নৈতিক মানে সমুন্নত করা। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন মহানবীর এই মিশন সম্পর্কে বলেছেন:

‘তিনিই উম্মিদের মধ্য থেকে একজনকে রাসূল রূপে প্রেরণ করেছেন; যে তাদেরকে তাঁর আয়াত আবৃত্তি করে শোনায়, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে কিতাব (কুরআন) ও কৌশল শিক্ষা দেয়। ইতিপূর্বে তো এরা ঘোর বিভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।’-[জুমু’আ : ২]

‘তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তাদের কাছে একজন রাসূল পাঠিয়ে আল্লাহ মোমেনদের প্রতি অবশ্য অণূগ্রহ করেছেন। সে তাঁর (আল্লাহ’র) আয়াত তাদের নিকট আবৃত্তি করে শোনায়, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়। এর পূর্বে তো তারা সুস্পষ্ট গোমরাহির মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।’-[আলে ইমরান : ১৬৪]

পিবিএ/এ এএইচ

আরও পড়ুন...