জীবনযুদ্ধে পরাজিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ছকিন উদ্দিন

পিবিএ,রংপুর: রণাঙ্গনে ছিলেন তিনি অসীম সাহসী। টকবগে এক যুবক। বিয়ের আগের মহান মুক্তিযুদ্ধে যিনি পাক-হানাদার বাহিনীর হাত থেকে দেশ মুক্ত করার শপথ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। তিনি আর কেউ নয় রংপুর সদর উপজেলার গকুলপুর ধনীপাড়া এলাকার মৃত্যু তছির উদ্দিনের ছেলে ছকিন উদ্দিন (৭২)। বর্তমানে বয়সের ভারে নূয়ে পড়েছেন তিনি। শরীর রোগাক্রান্ত, জরাজীর্ণ হাড্ডি সার হয়েছে তাঁর।

সেদিনের সেই গৌরবময় ইতিহাস তার জীবনে ম্লান হয়ে ফুটে উঠেছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো হুঙ্কার দিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়াই ছিল তাঁঁর কাজ। যুদ্ধজয়ের ইতিহাস তার বীরত্বের হলেও জীবনযুদ্ধে তিনি চরম পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গ্লাানি আর বেদনার অশ্রু ভেজা অথৈ সাগরে ভাসছেন তিনি। তবুও জীবন যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মে-খেয়ে, না খেয়ে। পরিবার পরিজন নিয়ে তার জীবনে এখন ঘোর অন্ধকার।

চোখের আলোও তার নিভে গেছে। কেইবা তার পাশে এসে দাঁড়াবেন? পাশে নেই কেউ পরাজিত এই বীর মুক্তিযোদ্ধার। পরাজিত এই সৈনিকের নাম ছকিন উদ্দিন। ধূসর চেহারার ছাকিন উদ্দিন সাহস যুদ্ধকালীন যেমন ছিল এখন তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। ক্ষুধা-দারিদ্র্য অসহায় করে তুলেছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ছকিন উদ্দিনকে। রোগ-শোকে শরীর ভেঙ্গে পড়েছে। বয়স বেড়েছে তার। এখন আর নেই সেই তাকত।

ক্ষুধা-দারিদ্র্য নামের শত্রুকে জয় করার ক্ষমতা নেই শরীরে। তিনি তার অসহায়ত্বের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। তার বীরত্বগাথার কথা এখন আর শহর-বন্দর-গ্রামের কেউ শোনে না। কিন্তু শাসক গোষ্ঠীর চোখ ছকিন উদ্দিনের দুঃখের জীবন গল্প, গল্পই থেকে যাচ্ছে। কিন্তু যারা ছকিন উদ্দিনের জন্য বড় কিছু করতে পারবেন তারা কি একটিবার ছকিন উদ্দিনের কণ্ঠ শুনবেন? শুনলে হয়ত ছকিন উদ্দিনসহ তার পরিবারের জীবন দুঃখ কিছুটা ঘুচতো।

জীবনযুদ্ধে পরাজিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ছকিন উদ্দিন
বীর মুক্তিযোদ্ধা ছকিন উদ্দিন

বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। এই সরকারের কাছ থেকেও তিনি কোন সাহায্য সহযোগিতা পাননি। হায়রে কপাল! কোথায় দাঁড়াবেন ছকিন উদ্দিনের মতো অসহায় মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের জীবন কি এমনি করেই কেটে যাবে? ৭২ বছরের বেশি বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা ছকিন উদ্দিনের পক্ষে পরিবার-পরিজনের দু’বেলা খাবারের সঙ্গতি নেই।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মাসিক ভাতার ১০ হাজার টাকাই সম্বল। ১০ হাজার টাকা দিয়েই ছকিন উদ্দিন স্ত্রী রিনা বেগম (৫৫), স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ে শিউলী, এবং শিউলীর ছেলে মেয়ে শিবলু ও ইসিতা,সন্তানসহ ৫ জনের সংসার চলছে খেয়ে না খেয়ে। তার উপর চিকিৎসা খরচ তো আছে। দুই ছেলে, ২ মেয়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ছকিন উদ্দিন জীবন সংসার। মেয়ে শাইবুদা বেগম ও শিউলী স্বামী পরিত্যাক্তা ছেলে রেজাউল ইসলাম, ও মিষ্টার আলী। এক ছেলে রিক্সা চালক আর অন্য জন খড়ির ব্যবসা করে জীর্বিকা নির্বাহ করে থাকেন।

জীবন সংগ্রামে পরাজিত এই সৈনিকের নিদারুণ অভাবের কথা দেশের অনেক মানুষ জানলেও কেউ বড় ধরনের সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসেননি। বীর মুক্তিযোদ্ধা কখনও কারও কাছে সাহায্যের হাত পাতেননি। ক্ষুধা আর দারিদ্র্যকে নিজের মধ্যে চেপে রেখেই মানুষের সঙ্গে চলেছেন। কিন্তু বয়সের ভারে এখন তিনি আর পথ চলতে পারছেন না।

পরিবার-পরিজন চালাবেন কিভাবে দিনরাত এই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ছকিন উদ্দিনের তার জীবনের সুখ-দুঃখের হাজারও কথা এই প্রতিবেদকের কাছে বলে কিছুটা হাল্কা হয়েছেন কিন্তু অভাবের বিরাট পাথরটি তার বুক চেপে বসে আছে। এখান থেকে তিনি কিভাবে হাল্কা হবেন।

বঙ্গবন্ধুকন্যাই মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ আশ্রায়স্থল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কানে ছকিন উদ্দিনের কথাগুলো এখনও পৌঁছেনি। কবে তার দুঃখের কথা জানবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা সেই অপেক্ষা করতে করতে এখন তিনি মৃত্যুর কাছাকাছি অবস্থান করছেন। জীবনযুদ্ধে পরাজিত এই সৈনিকের দুঃখের দিন কবে শেষ হবে তিনি তা জানেন না।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশের দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সবার মত ছকিন উদ্দিনও যুদ্ধে অংশ নেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ছকিন উদ্দিন ৬নং সেক্টর থেকে যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। লালমনির হাটের গিদালদাও হয়ে ভারতের দাজিলিং গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহন করে দেশে এসে যুদ্ধ শুরু করেন তিনি।

ধূসর ইতিহাস নিয়ে তিনি আজ পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথচ এই বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবনের কোথাও যদি একটুখানি আপোস করতেন তাহলে তিনিও হয়ত বাড়ি-গাড়ির মালিক থাকতেন। তা তিনি করেননি। বাবা মায়ের দেয়া ২ শতক জমির উপর তার বাড়ি। সেই দুই শতকের আবার কিছু অংশ দখল করে নিয়েছের এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী।

তার বীরত্ব আমাদের রণাঙ্গনে এক গৌরবময় ইতিহাস অর্জন করে। তার সাহসের কাছে আমরা নিজেরাই অনেক সময় ভয় পেয়ে যেতাম। সেই সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিণতি আজ বড় করুণ-অসহায়। জাতির কি দুর্ভাগ্য প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে বাড়তি সময় চাকরি করে যাচ্ছে। ছকিন উদ্দিনের মতো একজন মুক্তিযোদ্ধাকে যখন না খেয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে হয় তখন মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ছকিন উদ্দিনের জীবনের গৌরবগাথা আর দুঃখ- বেদনার কথা শুনতে শুনতে অনেক সময় কেটে যায়। কিন্তু তাঁর কথা শেষ হচ্ছিল না। তিনি বলতেই থাকেন। অভিমানী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কোনদিন কারও কাছে হাত পাতেননি।

আজও তিনি হাত পাতার কথা একবারও বলেননি। ছকিন উদ্দিনের শেষ চাওয়া তার জরাজীর্ণ বাড়িটিতে ছেলে,মেয়ে নাতি-নাতনি ও ছেলের বউ নিয়ে গদাগদি করে বসবাস করতে হয়। তা থেকে একটু খোলা মেলা পরিবেশে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চান তিনি। এ জন্য সংশ্লিষ্ট মহদয়দের প্রতি তিনি আকুতি জানিয়েছেন।

পিবিএ/এসআই/আরআই

আরও পড়ুন...