পিবিএ,ঢাকা: দেশের বর্ষীয়াণ অভিনয়শিল্পীদের মধ্যেও অন্যতম দিলারা জামান। অভিনয় দিয়ে তিনি দর্শকের মন জয় করেছেন অনেক আগে। পাঁচ দশকের অভিনয়ের ক্যারিয়ার তার। ১৯৬৬ সালে
বিটিভি’তে ‘ত্রিধারা’ নাটকের মাধ্যমে অভিনয় শুরু করেন। এরপর অসংখ্য টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি।
তার মধ্যে ১৯৯০ এর দশকের মোরশেদুল ইসলামের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ’চাকা’ (১৯৯৩) এবং হুমায়ুন আহমেদর ’আগুনের পরশমণি’ (১৯৯৪)অন্যতম। এছাড়া ২০০০ এর দশকে তিনি ব্যাচেলর (২০০৪), মেড ইন বাংলাদেশ (২০০৭), চন্দ্রগ্রহণ (২০০৮), প্রিয়তমেষু (২০০৯), ও মনপুরা (২০০৯) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
শিল্পকলায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন। এছাড়া ২০০৮ সালে ‘চন্দ্রগ্রহণ’ ছবিতে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে অভিনয়ের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
সম্প্রতি ফটো ও নিউজ এজেন্সি পিবিএ (ফটো বাংলা এজেন্সি) অফিসে এসেছিলেন এই গুণী অভিনত্রী। কথা বলেছেন বিভিন্ন প্রসঙ্গে। আর সে সময় তাকে দেখে তাঁর কাছে গেলেন অফিসের বেশ কয়েকজন সহকর্মী। সে সময় তিনি অভিনেত্রী হিসেবে নন, একজন মমতাময়ী মায়ের মতো সবার সাথে কথা বললেন, খোঁজ-খবর নিলেন, ছবি তুললেন। পাশাপাশি ফটো ও নিউজ এজেন্সি হিসেবে পিবিএ’র কার্যক্রমের প্রশংসাও করেন। বলেন, ছোট্ট একটা অফিস, অথচ এত গোছানো। আমার খুব ভালো লাগছে, এখানে এত কাজ হচ্ছে আমি জানতামই না। আমি সত্যিই বিষ্মিত। আমি আশা করি পিবিএ আরো এগিয়ে যাবে।
এরপরেই পিবিএ সম্পাদক জাহিদ ইকবালের সাথে শুরু হলো সাক্ষাৎকার পর্ব। সাক্ষাৎকারে সংক্ষিপ্তভাবে অভিনয় জীবনের অতীত ও বর্তমানের গল্প।
দিলারা জামান জানান, ষাটের দশকে তিনি যখন অভিনয় জগতে আসেন, সে সময়ে মুসলিম সমাজ ছিল খুবই রক্ষণশীল। বিশেষ করে নোয়াখালীর মেয়েরা ছিল আরো বেশি রক্ষণশীল। তাই মুসলিম মেয়েরা অভিনয়ে আসতো না বললেই চলে। তখন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছেলে-মেয়েদের এক সাথে অভিনয় হতো না। ছেলেদের হলে ছেলেরা মেয়ে চরিত্রে নাটক করতো মেয়ে সেজে, আর মেয়েদের হলে মেয়েরাই ছেলে সেজে নাটক করতো। সেই পরিবেশে ছেলে-মেয়ে এক সাথে নাটক করা সহজ ছিল না, বিশেষ করে মুসলিম মেয়েদের জন্য। সে সময় হিন্দু মেয়েরা অবশ্য ছেলেদের সাথে মিলে অভিনয় করতো। কিন্তু মুসলিম মেয়েদের সংখ্যা ছিল খুবই দুর্লভ। দিলারা জামান বলেন, ”এমনি এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আমার অভিনয়ে আসা। এটা সম্ভব হয়েছিল আমার মায়ের কারণে। আমার মা যথেষ্ট সাংস্কৃতিকমনা ছিলেন। যার কারণে স্কুল জীনেই আমার অভিনয়ের সূত্রপাত।”
”বাংলাবাজার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় মেট্টিক পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠান বার্ষিক ফেয়ারওয়েলের সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রথম অভিনয় করি। ছোট একটা অভিনয় ছিল, অল্প একটু, ঝড়ের মত করে আসলাম আর ঝড়ের মত করে চলে গেলাম। কী অভিনয় করেছিলাম তা আর আজ মনে নেই। তবে ম্যাক-আপের কথা মনে আছে; তখন মেকআপের জন্য শাঁখারী বাজার থেকে আনা সিঁদুর আর চুন মুখে মাখা হতো লালচে ফর্সা দেখানোর জন্য। আমার মনে আছে, সেদিন অভিনয়ের পর রাস্তা দিয়ে বাড়ী ফেরার রাস্তায় চুনমাখা মুখ বের করে রেখেছিলাম যাতে সবাই বুঝতে পারে আমি অভিনয় করেছি। আজ সে কথা মনে পড়লে হাসি পায়। সেই সাথে এটাও মনে পড়ে অভিনয়ের প্রতি কতটা ভালোবাসা ছিল আমার। কলেজ জীবনেও বছরে দু-একটি অনুষ্ঠান হতো, তখন অভিনয় করেছি।
আমার জীবনের মোড় ঘুরে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। সে সময় আমার নাট্যগুরু ছিলেন প্রফেসর নূরুল মোমেন। তিনি সারাদেশ শিক্ষা সফরে যেতেন এবং সারা দেশ থেকে আগ্রহী ছেলে-মেয়েদের যোগার করে মঞ্চ নাটকের ব্যবস্থা করতেন এবং অভিনয়ের উপর পুরষ্কার দেয়া হতো। সে সময় আমি পরপর চারবার অভিনয়ের জন্য পুরষ্কার লাভ করি। আমার অভিনিত প্রথম নাটক ছিল মায়াবী প্রহর।”
দিলারা জানান, তাঁর অভিনয় জীবন প্রথম পথ খুঁজে পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। এ সময় বাংলা একাডেমির পুরষ্কার প্রাপ্ত কথা সাহিত্যিক ফখরুজ্জামান চৌধুরীর সাথে তার পরিচয় হয় এবং ১৯৬৪ সালে তা পরিণয়ে পরিণত হয়। তাঁর অভিনয় জীবনে স্বামী ফখরুজ্জামানের বিরাট অবদান আছে উল্লেখ করে কিছু সময় স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন দিলারা। তাঁর জীবনসঙ্গী আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে পরপারে চলে গেছেন।
তাদের দুই কন্যা – তানিয়া ও যুবায়রা। দুজনই প্রবাসী। বড় মেয়ে ডাক্তার তানিয়া কানাডায় থাকে। ছোট মেয়ে যোবায়রা আমেরিকা রয়েছে। পেশায় যোবায়রা আইনজীবী। তানিয়ার দুই ছেলে রাইয়ান, রেদোয়ান। ছোট মেয়ের দুই কন্যা হুমায়রা, ইসরাতুল। এই নাতী-নাতনীদেরকে নিজের বন্ধু-বান্ধবী উল্লেখ করা জানান, অবসর সময়ে তাদের সাথে কথা বলে, গল্প করে সময় কাটে। মেয়েরাও প্রতিদিন ফোন করে খোঁজ-খবর নেয়। তাছাড়া দিলারা জামানের একজন পালক ছেলে রয়েছে, যার নাম আশফাক।
তবে, দেশে বর্ষিয়ান এই অভিনেত্রী অনেকটা নিঃসঙ্গ। বাসায় এমনকি তার কোন কাজের লোকও নেই। নিজেই বাজার করেন, ঘরের কাজ ও রান্না-বান্না করেন।
নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্যই তিনি কাজের মাঝে ডুবে থাকতে চান।
মাঝে দু বছর তিনি মেয়েদের সাথে ছিলেন। কিন্তু দেশের জন্য তার মন কাঁদে। অভিনয়কে তিনি ভালোবাসেন। কাজের মাঝেই তিনি বেঁচে থাকতে চান। তাই দেশে চলে আসেন।
কিন্তু দেশে একাকী জীবনে আবার সন্তান-নাতী-নাতনিদের কথা মনে পড়ে।
পিবিএ অফিসে এসেছিলেন ইফতারির পরে, নামাজ-কালাম শেষ করে। বলেন, এক সময় তো সৃষ্টিকর্তার কাছেই ফিরে যেতে হবে।
ধর্ম প্রসঙ্গে বলেন, ধর্ম তো নিজের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। তবে প্রত্যেকের উচিত অন্যের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। কারো ধর্ম পালনে বাধা দেয়া উচিত নয়। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ী আল্লাহও পছন্দ করেন না। আমাদের নবীও অন্যের ধর্ম পালনে অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন।
অভিনয় সম্পর্কে দিলারা জামান বলেন, এক সময় অভিনয় নিয়ে আমাদের মুসলিম সমাজে একটা দ্বিধা থাকলেও এখন অভিনয় একটি পেশা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। যে কেউ আন্তরিকতা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার মাধ্যমে এ পেশায় সফলতা লাভ করতে পারে।
বর্তমানে যারা অভিনয় করছে তারা যথেষ্ট মেধাবী উল্লেখ করে দিলারা জামান বলেন, জানার সব জানালা এখন তাদের জন্য খোলা, যে কোন বিষয় খুব সহজেই তারা জানতে পারছে, বুঝতে পারছে। কিন্তু আমাদের সময় এত সুযোগ ছিল না। তবে তাদেরকেও সাধনা করতে হবে, লেগে থাকতে হবে। পরিপক্কতা অর্জনের জন্য অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার কোন বিকল্প নাই।
শিক্ষকতা থেকে অভিনয়ে আসা দিলারা জামান ষাটের দশকে ‘ত্রিধরা’ নাটকের মাধ্যমে অভিনেত্রী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘এইসব দিনরাত্রি’ ও ‘অয়োময়’ ধারাবাহিকে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে বেশ সাড়া পেয়েছিলেন। এরপর থেকে মায়ের ভূমিকাতেই বেশি দেখা যায় তাকে।
দিলারা ১৯৪৩ সালের ১৯ জুন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ) বর্ধমান জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রফিকউদ্দিন আহমেদ এবং মাতার নাম সিতারা বেগম। তার জন্মের কিছুদিন পরে তার পরিবার আসানসোল জেলায় চলে যান। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তারা যশোর জেলায় চলে আসে। তিনি ঢাকার বাংলাবাজার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। স্কুলে তিনি প্রথম মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন। পরে তিনি ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি নাট্যগুরু নুরুল মোমেনের ছাত্রী ছিলেন।
দিলারা জামানের কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতা দিয়ে। তার প্রথম টেলিভিশনে অভিনয় করেন ১৯৬৬ সালে ত্রিধরা নাটকে। এই নাটকে তার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী লিলি চৌধুরী।
তার অভিনীত প্রথম ধারাবাহিক নাটক সকাল সন্ধ্যা। ১৯৯৩ সালে তিনি মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ’চাকা’য় অভিনয় করেন। তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি [২০০৮ সালে]। তিনি মুরাদ পারভেজ পরিচালিত ‘চন্দ্রগ্রহণ’ চলচ্চিত্রে ময়রা মাসী চরিত্রে অভিনয় করেন। এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি একই চলচ্চিত্রের তার সহশিল্পী চম্পার সাথে যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
২০১৪ সালে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে নির্মিত চয়নিকা চৌধুরী নির্দেশিত ভোরের ফুল ও রেদওয়ান রনি নির্দেশিত ভালোবাসা ১০১ নাটকে অভিনয় করেন। এছাড়া মুরাদ পারভেজ পরিচালিত বৃহন্নলা চলচ্চিত্রে গ্রামের এক বুড়ি চরিত্রে অভিনয় করেন।২০১৬ সালে তিনি সাদাত হোসাইন পরিচালিত প্রযত্নে শীর্ষক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এছাড়া থ্রি সিস্টার্স ও ফেরদৌস হাসান রানার নির্দেশনায় ফুল আর কাঁটা টিভি নাটক, গুগল সব জানে ও মতিয়া বানু শুকুর নির্দেশনায় কালো আল্পনা ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করেন। ২০১৭ সালে তৌকীর আহমেদের পরিচালনায় হালদা চলচ্চিত্রে তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ নারী সুরৎ বানু চরিত্রে অভিনয় করেন।
পিবিএ/এএইচ