মরণ কি শ্যাম সমান !

খোন্দকার মহিতুল ইসলাম: দিনটি ছিল ৮ এপ্রিল ২০১৯। সোমবার। উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের ১৬ নম্বর রোডে একটি অনলাইন মিডিয়ায় কাজ করি। ১৪ নম্বর রোডে নতুন বাসা নিয়েছি। যাতে বাসে না উঠতে হয়। বিকেল ৫ টায় অফিস শেষে বাইরে বের হতেই দেখি ঝিরিঝিরি হালকা বৃষ্টি। মনে করলাম মাথা বাঁচিয়ে সংক্ষিপ্ত পথে বাসা পর্যন্ত চলে যেতে পারব। ১৬ নম্বর থেকে ১৫ নম্বর রোডে সহজেই চলে এলাম। কিন্তু ১৪ নম্বর রোডের মাথায় আসতেই মাথাটা চক্কর দিল।ভাবলাম, আর এগুনো ঠিক হবে না। দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিলাম। কিন্তু গায়ে বৃষ্টির ছিঁটা। মাথা বাঁচানোর মতো ছাউনি হলে ভাল হতো। একটা অচেনা বাড়ির গেট ধরে দাঁড়ালাম।তারপর আরেক ধাপ এগুলাম। এখন আর পা চললো না। বসে পড়লাম। এরপর প্রায় তিন মিনিটের জন্য আমার জ্ঞান ছিল না। আমার ধারণা, এই তিন মিনিট আমি ছিলাম মৃত। আমাকে অচেতন পড়ে থাকতে দেখে এলাকার এক লন্ড্রির কর্মচারি এগিয়ে আসেন। এলাকায় আমি নতুন হলেও যৎসামান্য চিনতেন। তিনি আরো দুতিনজনকে সাথে নিয়ে ধরাধরি করে আমাকে আমার বাসার গ্যারেজ পর্যন্ত পৌঁছে দেন। ততক্ষণে আমার স্ত্রী ও সন্তানরা ছুটে এসেছে । আমাকে একটি চেয়ারে বসানোর পর দুই দফা সামান্য বমি হলো। জ্ঞান ফিরলো। মনে করলাম, শোবার ঘরে যেয়ে বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা ততক্ষণে উবার ডেকে ফেলেছে। আমাকে তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ে যাওয়া হলো উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালের জরুরি বিভাগে।

।।২।।
  • ক্রিসেন্ট হাসপাতালে শুরু হলো নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা।প্রেসার মাপা হলো। ট্রপাইন নামে একটি পরীক্ষা করা হলো। পরীক্ষার ফল হাতে পাওয়ার পর বলা হলো: আমার হার্ট
অ্যাটাক হয়েছে। প্রাথমিক ওষুধপত্র দিয়ে বলা হলো: সময় নষ্ট না করে রোগীকে মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশনে নিয়ে যান্। কিন্তু আমি গররাজি। ডাক্তার আমাকে ব্রিফ করে পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা দিলেন।বাইরে বৃষ্টি। পথঘাট পানিতে সয়লাব। আমাদের উবার ট্যাক্সি ছুটলো ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অভিমুখে। উত্তরা থেকে মিরপুর হাসপাতাল পৌঁছতে জ্যাম ডিঙ্গিয়ে সময় লাগলো তিনঘন্টা । সেখানে জরুরি বিভাগে দ্রুত আমার হাতে ক্যানোলা সেট করে ইঞ্জেকশন দেয়া হলো। অনেকগুলো ওষুধ খেতে দেয়া হলো।
চিকিৎসক বললেন, এই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। আমাদের এখানে সিট নেই। আপনারা দ্রুত জাতীয় হৃদরোগ ইন্সস্টিটিউটে নিয়ে যান। এই হাসপাতালের ডাক্তার জসিম আমার স্কুল জীবনের সহপাঠী। আমার স্ত্রী ফোনে জসিমকে ধরলেন। চলতে থাকলো জসিমের সাথে ইমারজেন্সির অনডিউটি ডাক্তারের কথোপকথন। আশায় বুক বেঁধে আছি। কিন্তু জসিম ফেল করলো। বললো: বহু চেষ্টা করলাম। কাজ হলো না। সময় নষ্ট না করে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সষ্টিটিউতে চলে যাও। রাত তখন ১২টা। আবার ছুটলাম জাতীয় হৃদরোগে। জরুরি বিভাগের ডাক্তার দেখেই ভর্তি করে নিলেন। বারান্দার ফ্লোরে একটি সিট দিলেন। ছারপোকায় আচ্ছাদিত সিটে আমি শুয়ে পড়েছি। বসার ক্ষমতা নাই। আমার মুখের উপর দিয়ে বিড়াল লাফ দিয়ে চলে গেল। বললাম: আমি একজন সাংবাদিক। একটা সিট কি জোগাড় করে দেয়া যায়? নিষ্ঠুর জবাব পেলাম:‘ সাংবাদিক হন আর প্রাইম মিনিস্টার হন, সিট না থাকলে কৌথ্থেকে দেব’? আমি সর্বদা উঁচু গলায় কথা বলা মানুষ। কিন্তু এখন এর কোনো জবাব দেওয়ার ক্ষমতা আমার নাই।কোনো ডাক্তার আমাকে এটেন্ড করছেন না। এভাবে ভোরের আজান কানে এলো। সকাল হতেই আমার ছেলে বললো: এভাবে বাবাকে এখানে ফ্লোরে ফেলে রেখে বাঁচাতে পারব না। বাংলাদেশে চিকিৎসা সেবার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে-একথা ঠিক নয়। তাই যদি হতো, ওবায়দুল কাদেরকে সিঙ্গাপুর নেয়া হতো না। দেশের কান্ডারিদেরই এখানকার চিকিৎসার উপর আস্থা নাই। তোমরা যে যাইই বলো না কেন- ঢাকার মধ্যে ভাল একটা হাসপাতালে আমি বাবাকে নিয়ে যাবই। এখন টাকা পয়সার কথা ভাববো না। যা হবার হবে।
যখন শুনলাম, আমাকে ওরা ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে, বাধা দিলাম। বললাম, ওই হাসপাতাল আমাদের জন্য নয়। ওখানে আমাকে নিও না। কিন্তু ওরা আমার কথা শুনলো না। অর্ধ অচেতন অবস্থায় আমি ইউনাইটেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পৌঁছলাম।
।।৩।।
ইউনাইটেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আবার নতুন করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলো। তারপর নিশ্চিত করা হলো, আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে । বলা হলো,আমাকে হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নিতে হবে। ট্রলিতে করে নেয়া হলো সেখানে। পরিবারের সদস্যদের সাথে আমার তথন থেকে সংযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ওখানে কোনো ভিজিটরের ঢোকার অনুমতি নাই।
৯ এপ্রিল দুপুরে ইউনাইটেড হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. এন. এ.এম.মোমেনুজ্জামান সিসিইউতে আমাকে দেখলেন। বলা বাহুল্য, তিনি আমাদের আত্মীয়। কেমন আত্মীয় সেটা জানাতে পরিচয় বলতে হলো। শুনে এগিয়ে এসে তিনি আমার হাত ধরে ফেললেন। তারপর তুলনামূলক একটু বেশী সময় নিয়ে কথা বললেন। বললেন, ১১্ এপ্রিল এনজিওগ্রাম করে দেখব, কি হয়েছে। এখন ওষুধপত্র চলুক। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঘোরের মধ্যে ১০ তারিখ কেটে গেল। সেদিন বিকেলে আমাকে পোস্ট ক্যাথ বিভাগে স্থানান্তর করা হলো। ১১ তারিথ ভোরে আমার দুই কব্জি ও উরুতে শেভ করে দিল হাসপাতালের কর্মী্। ভয় পাচ্ছি। বিকেল নাগাদ হুইল চেয়ারে বসিয়ে লিফটে করে নিয়ে যাওয়া হলো এনজিওগ্রাম করার ক্যাথ ল্যাব রুমে। এসময় বাইরে প্রতীক্ষারত আত্মীয় স্বজনের সাথে সামান্য চোখের ইশারায় কথা হলো। ডান হাতে প্রি এনজিওগ্রাম অপারেশন করার সময় খুব কষ্ট পেলাম। সন্ধ্যা নাগাদ এনজিওগ্রাম করা হলো। ডাক্তার মোমেনুজ্জামান আমার মাথার কাছে এসে বললেন, একটা স্টেন্টিং করতে হবে। ঠিক পনের দিন পর করব। তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।
।।৪।।
১২ এপ্রিল ২০১৯ আমাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হলো। আমি নানান দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এর মধ্যে এই হাসপাতালে আমার ৮০ হাজার টাকা বিল হয়ে গেছে। তাই যত তাড়াতাড়ি রিলিজ পাওয়া যায় তত ভাল। দিন গুণতে লাগলাম ১৫ দিনের।মূল খরচ তো হবে তখন। ওষুধও দেয়া হয়েছে এই সময়ের জন্য। ১৫ দিন পরের স্টান্টিং এর তারিখ নিতে যেয়ে ধন্দ্বে পড়ে গেলাম। বলা হলো, ডা মোমেনুজ্জামান বিদেশ চলে গেছেন। ফিরবেন ১১ মে। আপনাকে ১৪ মে তারিখটি স্ট্যান্টিং এর জন্য দেওয়া যায়। বাধ্য হয়ে সে তারিখের কম্পিউটার পাতার প্রথম নামটা্ নথিভুক্ত করালাম আমার।
শুরু হলো নতুন দুশ্চিন্তা। শুভাকাঙক্ষীদের কেউ কেউ বললেন, অতো সময় নষ্ট না করে বারডেমে যোগাযোগ করো। কেউ বললেন, ভারতের কলকাতা চলে যাও।কলকাতার অ্যাপোলোতে ভারতীয় ১ লাখ ৭০ হাজার রুপিতে স্ট্যান্টিং করা হয়। আমার টানাটানির বাজেট। এখানে লাগবে মোট ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার কাছে পাওনা পড়ে আছে ১ লাখ টাকা। আমার পাওনা টাকা ওরা আমাকে চিঠি লেখার পরেও দেয়না। গুরুতর অসুস্থতার কথা জানিয়ে আবার চিঠি লিখে টাকা দাবি করলাম। সেখান থেকে এবার ৫০ হাজার টাকা পাওয়া গেল। আমার সহকর্মী পরলোকগত সুনীল ব্যানার্জির ছেলে শুভাশিস ব্যানার্জি ফোন করে বললো: কাকা আমার বাবা হার্ট অ্যাটাকে প্রাণ হারান। আপনি ছিলেন তার অন্যতম ঘনিষ্ট বন্ধু। আপনার চিকিৎসা বাবদ আমি ২০ হাজার টাকা কন্ট্রিবিউট করতে চাই। আপনি কিছুতেই না করবেন না। আমার চোখে তখন জল। আমার ভালবাসার মানুষজন ও আত্মীয়স্বজন যে যেভাবে পেরেছেন, আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। তারপরেও একটা ভাল অঙ্ক ঋণ করতে হয়। আত্মবিশ্বাস রাখি, এ ঋণ শোধ করতে পারব। বাসসতে এখনও আরো ৫০ হাজার টাকা পাব। সরকার স্ট্যান্টিং এর দাম ধার্য
করে দিয়েছে। তারপরেও তো এই চিকিৎসা নেয়া সাধ্যাতীত।
কিন্তু মুশকিল হলো, ১৪ মে সকালে আমার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা থাকলেও ১১মে বিকেল থেকে আবার অবস্থার অবনতি হয়। ডা মোমেনুজ্জামান দেশে নাই। আমার প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমাকে সন্ধ্যায় বাসার পাশে বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী সরকারী হাসপাতালে নেয়া হলো। প্রেশার অবর্ণনীয় হাই। ২১০/১০০। নি:শ্বাস নিতে পারছি না। অক্সিজেন মাস্ক পরানো হলো। লেসিস নামের ইঞ্জেকশন দ্রুত পুশ করা হলো। আমি তখন দ্বিতীয় দফা মৃত্যুর মুখোমুখি। জরুরি বিভাগের ডাক্তার বললেন, দ্রুত মূল হাসপাতালে নিয়ে যান। রোগীর হার্ট ফেল করার উপক্রম হয়েছে। সময় নষ্ট করা যাবে না।
আবার ইউনাইটেড হাসপাতাল। ট্রাফিক জ্যামে গাড়ি থামছে। সিগনালে থামছে। প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে আবার ইমারজেন্সি। আবার সিসিইউ। ১২ মে দুপুরে ডা. মোমেনুজ্জামান আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। ১১ মে তিনি দেশে ফিরেছেন। বললেন, আমার অনুপস্থিতে এতো ঘটনা ঘটে গেল। তার মুখ গম্ভীর। আমাকে বললেন- কা্লই (১৩ মে) আমি স্টেন্টিং করে দিচ্ছি।
১২ মে সিসিইউতে দুজন রোগী মারা গেল। আমিঅনেক ভীতু। এ মৃত্যু আমাকে বিচলিত করে। রোগীর মৃত্যুর পর ডাক্তারদের সেখানে জটলা বাড়ে। একজন ডাক্তার চড়া সুরে গাইলেন, ‘হাওয়া হাওয়া ও হাওয়া, হাওয়ামে মিলা দে।‘ এ গান কানে যাওয়ার সাথে সাথে অসহ্য যন্ত্রণায় আমি বেদনাহত। মানবতার এই পরাজয় আমি কিছুতেই মানতে পারছি না। একজন চিকিৎসক কি করে এমন নিষ্ঠুর হতে পারেন? আমি হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেওয়ার সময় আমার অভিমত জানতে চেয়ে মন্তব্য লিখতে বলা হয়। তখন আমি এই মর্ম ন্তুদ ঘটনাটি না লিখে পারলাম না। নার্সকেও বিষয়টি জানাই। তিনি বললেন, ‘স্যার, ওরা মৃত্যু দেখতে দেখতে অভ্যস্ত। এসব ওদের গায়ে লাগে না’। না, এই যুক্তিও আমার কাছে গ্রাহ্য বলে মনে হলো না। কেন এমন হয়?
আমার স্ট্যান্টিং করা হয়েছে। এখন বাড়িতে বিশ্রামে আছি। প্রতিদিন গাদাগাদা ওষুধ খাচ্ছি। খাওয়া দাওয়ার নিষেধাজ্ঞা পুরো মেনে চলছি। প্রথম প্রথম হাঁটতেই পারতাম না। সাপোর্ট লাপতো। এখন হাঁটাচলা করছি খুব সীমিতভাবে। ঠিক একমাস পর আমার আবার চেকআপ করা হবে। এখন প্রতীক্ষার প্রহর গুণছি সেই দিনটির জন্য।
পিবিএ/জেআই

আরও পড়ুন...