গুম খুনের শিকার স্বজনদের কান্না

বিশেষ প্রতিনিধি, পিবিএ: সাত বছর বয়সী শিশু আদিবা ইসলাম হৃদি। বাবা পারভেজ হোসেন যখন নিখোঁজ হন, তখন শিশুটির বয়স মাত্র দেড় বছর। এই শিশু নিখোঁজ বাবাকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়েছে সরকারের কাছে।

আজ শনিবার (২৫ মে) সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গুম হওয়া সন্তানদের মায়েদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর উদ্যোগে আয়োজিত এক মানববন্ধন অনুষ্ঠানে গুম খুন ও নিখোঁজদের শিশুরা এই আকুতি জানায়।

নিখোঁজদের ফেরত চেয়ে স্বজনদের মানববন্ধনে সাত বছর বয়সী শিশু লামিয়া আক্তার মীম কাঁদতে কাঁদতে বলে, বাবা ফিরিয়ে দেন। শিশুটির আড়াই বছর বয়সের সময় তার বাবা কাওসার হোসেন নিখোঁজ হন।
মানববন্ধনে শিশু লামিয়া আক্তার মীমে মা মিনু আক্তার জানান, তার স্বামী কাওসার হোসেন গাড়ি চালক। তিনি ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন। সন্তান নিয়ে কোনোভাবে টিউশিনি করে সংসার চালাচ্ছেন মিনু আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমি কোনোভাবে সংসার চালিয়ে নিচ্ছি। এ রকম আর কত দিন চালাতে পারবো, জানি না। আমার স্বামীকে আমি ফেরত চাই।’

কাওসার যখন নিখোঁজ হন, শিশু মীমের বয়স মাত্র আড়াই বছর। এখন যত বড় হচ্ছে, ততই বাবার কথা চায় সে।

মানববন্ধনে মীম বলে, ‘আমার বাবাকে ঈদের আগে ফেরত চাই।’

মিনু আক্তার জানান, কাওসারের গ্রামের বাড়ি বরিশালের বিমানবন্দর এলাকায়। প্রায় সাত বছর ধরে নিখোঁজ থাকায় তারা এখন অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে সময় পারছেন।তাদের বিশ্বাস কাওসার একদিন ফিরে আসবেন। আরেক শিশু আদিবা ইসলাম হৃদি পারভেজ নিখোঁজ বাবা পারভেজ হোসেনের ছবি বুকে নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনে অংশ নেয়, শিশুটি তার মা ফারজানা আক্তারের সঙ্গে মানববন্ধনে এসেছে। বাবা যখন গুম হন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর।

শিশুটির মা ফারজানা আক্তার বলেন, ‘২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর শাহবাগ থেকে চার যুবকের সঙ্গে পারভেজ হোসেনওক তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন পর্যন্ত আর খোঁজ মেলেনি। পারভেজ যখন গুম হন, তখন হৃদির বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। তখন হৃদি কিছুই বুঝতো না। এখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে, সবার মতো তার বাবা নেই। তবে ওর বাবার কী হয়েছে, কেন সে নেই, তা আমি তাকে বলতে পারছি না।’

কাঁদতে কাঁদতে ফারজানা আক্তার বলেন, ‘সাত বছর ধরে হৃদি তার বাবাকে নিয়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। এসব প্রশ্নের কোনও জবাব দিতে পারছি না।’

পারভেজ বংশাল ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন উল্লেখ করে ফারজানা প্রশ্ন ছুড়ে দেন—‘রাজনীতি করা কি অপরাধ? তাহলে দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক। আমাদের সন্তানদের বাবাদের ফেরত দিন, তারা আর রাজনীতি করবেন না।’

হৃদি এখন তার মায়ের সঙ্গে যাত্রাবাড়ির মাত্যুয়াইলে নানাবাড়িতে থাকেন। নানাবাড়ির পাশের একটি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। নিখোঁজ পারভেজের বাবা ছেলের শোকে মারা যান দুই বছর আগে। বর্তমানে তার মাও শয্যাশায়ী বলেও জানান ফারজানা আক্তার।

আমাদের গুম পরিবারের সদস্য হিসেবে চেনেন। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নিখোঁজ হওয়া সাজেদুল ইসলামের বোন আফরোজা ইসলাম। সম্বনয় করেছেন মানববন্ধনের। তিনি বলেন, ‘সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান ফিরে এসেছেন। আমরাও মনে করি, আমাদের স্বজনদেরও এভাবে ফেরত দেওয়া হয়।

২০১৩ সালে মিরপুর পল্লবী থেকে নিখোঁজ হন বিএনপিকর্মী সেলিম রেজা পিন্টু। তার বোন মুন্নী মানববন্ধনে অংশ নিয়ে বলেন, ‘৫ বছর ছয়মাস ধরে মানুষের দ্বারে-দ্বারে ঘুরছি। কত মানুষের কাছে গেছি, প্রধানমন্ত্রীকে
বলেছি, তাও আমাদের ভাইকে ফেরত পাইনি। আমাদের বাবা-মা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা হয়তো বাঁচবেন না। আমরা এই বেঁচে থেকে মরে আছি। আমরা প্রতিদিনই মারা যাই।’ তিনি বলেন, ‘হয় আমাদের গুম করুণ, না হয় আমাদের ভাইদের ফেরত দিন।’

ইউপিডিএফ-এর অন্যতম সংগঠক ও ইউনাইটেড ওয়াকার্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাইকেল চাকমা গত ৯ এপ্রিল কাঁচপুর থেকে নিখোঁজ হন। তার বড়বোন সুভদ্র চাকমা মানববন্ধনে
অংশ নিয়ে কথা বলার আগে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। মাইকেল পাহাড়ি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে কাজ করে থাকেন।

নিখোঁজ ও গুম হওয়া মানুষের ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে আয়োজিত এই মানববন্ধনে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, সমাজকর্মী, মানবাধিকারকর্মী ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতারা ছিলেন। এর মধ্যে গণস্বাস্থ্য
কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘গুম-খুনের জন্য দায়ীরা আপনার পাশেই আছে। আপনি তাদের বলুন, তারা যেন দ্রুত নিখোঁজদের ফেরত
দেয়।’

পিবিএ/জেডআই

আরও পড়ুন...