কমতে যাচ্ছে ফেইসবুকের একচ্ছত্র আধিপত্য !

পিবিএ ডেস্ক: আজকাল ফেসবুকের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযোগ উঠছে তথ্য চুরির। এ কারণে সামাজিক যোগাযোগের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুক নিয়ে নানা কথা উঠছে। অনেকেই বলছেন, ফেসবুকের জনপ্রিয়তা কমছে। অনেকেই এর ব্যবহার থেকে সরে আসছেন।এসব কারণে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটির আধিপত্য কমানোরও কথা বলছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেইসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম— ফেইসবুকের মালিকানাধীন তিনটি প্রতিষ্ঠান আলাদা হওয়া উচিত। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র সরকারও চাইছে ফেইসবুক ভেঙে তিনটি আলাদা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে।

তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে ফেসবুক সামনে আসছে নতুন লুকে। গ্রাহকের মন ফিরে পেতে ডিজাইনে আমূল পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ফেসবুক প্রধান মার্ক জাকারবার্গ এই ডিজাইন সামনে এনেছেন। সেখানে কোম্পানির আইকনিক নীল রঙের বার বাদ গিয়েছে। এছাড়াও নিউজ ফিড থেকে গুরুত্ব কমেছে নতুন ডিজাইনে। নতুন ডিজাইন যোগ হয়েছে কোম্পানির মেসেজিং অ্যাপেও। এছাড়াও নতুন ডিজাইন দেখা যাবে কোম্পানির অনলাইন মার্কেটপ্লেস, ভিডিও অন ডিমান্ড ওয়েবসাইটেও। সব ওয়েবসাইটেই এবার থেকে ছবিসহ স্টোরিতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও চেনা মানুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য আসছে একটি নতুন ফিচার। থাকছে সিক্রেট ক্র্যাশসহ ফেসবুক ডেটিং টুল।

পৃথিবী ক্রমশ বড় হওয়ার কারণে আমাদের আগের থেকে আরও কাছে আসার প্রবণতা জন্মাচ্ছে। এই কারণে ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত জীবনে বেশিও গুরুত্ব দিচ্ছে ফেসবুক। ডেভেলপারদের সঙ্গে বার্ষিক সম্মেলনে এই ঘোষণা করেছেন ফেসবুক প্রধান। জাকারবার্গ বলেন, প্রাইভেট মেসেজ, ছোট সময় থাকা, স্টোরি আর ছোট গ্রুপ অনলাইন যোগাযোগে ভবিষ্যতে দিশা দেখাবে। ব্যক্তিগত চ্যাটে এনক্রিপশান যোগ করে সুরক্ষা করলে গ্রাহক ফেসবুক এ চ্যাট করতে আরও সুরক্ষিত বোধ করবেন। শিগগিরই পিসি ও ম্যাক অপারেটিং সিস্টেমের জন্য নতুন মেসেঞ্জার অ্যাপ নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিটি। গত বছর ডেভেলপার সম্মেলনে ঘোষণা করা একাধিক ফিচার সামনে আনতে দেরি করেছিল ফেসবুক। ডেভেলপার সম্মেলনের ঠিক পরে ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা বিতর্কে এই প্রোডাক্টগুলি সামনে আনতে দেরি হয়েছে। জাকারবার্গ বলেন, আমরা জানি সুরক্ষা প্রসঙ্গে আমরা নিজেদের নাম খারাপ করেছি।

গত বছর মোট ৫৬ বিলিয়ান মার্কিন ডলার আয় করেছিল ফেসবুক। এর মধ্যে বেশিভাগ এসেছিল কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখানোর ব্যবসা থেকে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে নতুন কোনো গ্রাহক ফেসবুক ব্যবহার করছেন না। তাই কোম্পানির আয় বাড়াতে নতুন উপায় খুঁজতে হচ্ছে। নতুন ফিচার ঘোষণা করায় কোম্পানিটির লগ্নীকারীরা তুলনামূলক সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। যদিও দিনের শেষে ফেসবুক স্টকের দাম কমেছে ০.৭ শতাংশ।
প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ ‘এনফোর্সমেন্ট রিপোর্ট’ প্রকাশ করেছে ফেইসবুক। ২০১৮ সালের অক্টোবর হতে ২০১৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত কী পরিমাণ পোস্ট এবং অ্যাকাউন্টের ওপর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তার বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ছয় মাসের মধ্যে তিনশ’ কোটির বেশি ভুয়া অ্যাকাউন্ট সরিয়েছে ফেইসবুক, যা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ভুয়া অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি এই সময়ের মধ্যে রেকর্ড ৭০ লাখ “ঘৃণামূলক বক্তব্যের” পোস্ট সরিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক মাধ্যমটি। কী পরিমাণ মুছে ফেলা পোস্টের জন্য আপিল করা হয়েছে এবং যাচাইয়ের পর তা অনলাইনে ফেরত আনা হয়েছে তাও প্রথমবারের মতো জানিয়েছে ফেইসবুক। ফেইসবুকে ভেঙ্গে ফেলা নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনার বিপক্ষে কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠান প্রধান মার্ক জাকারবার্গ।

জাকারবার্গ বলেন, আমি মনে করিনা প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে ফেলার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যাবে। প্রতিষ্ঠানের সাফল্য আমাদেরকে এই উদ্যোগগুলোকে বিশাল পরিসরে তহবিল জোগাতে আমাদেরকে অনুমোদন দেয়। আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যে পরিমাণ বাজেট খরচ করা হয়, আমি বিশ্বাস করি তা এ বছর টুইটারের আয়ের চেয়েও বেশি। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মাধ্যমে অসংখ্য অ্যাকাউন্ট তৈরি করায় ভুয়া অ্যাকাউন্ট সরানোর সংখ্যাও বেড়েছে বলে জানিয়েছে ফেইসবুক। এই অ্যাকাউন্টগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই ক্ষতিকর উদ্দেশে ব্যবহারের আগেই কয়েক মিনিটের মধ্যে মুছে ফেলা হয়েছে। মাদক এবং বন্দুকের মতো মালামাল বিক্রির জন্য কী পরিমাণ পোস্ট সরানো হয়েছে তাও জানাবে ফেইসবুক। ছয় মাসে বন্দুক বিক্রির দশ লাখের বেশি পোস্ট সরিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। শিশু নির্যাতনের ছবি, সহিংসতা এবং সন্ত্রাসী কর্মকা-ের পোস্ট কী পরিমাণ গ্রাহক দেখেন তারও একটি ধারণা দিয়েছে ফেইসবুক। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রতি ১০ হাজার কনটেন্টের মধ্যে ১৪ জন নগ্নতা দেখতে পারেন, ২৫ জন সহিংতা এবং তিন জনের কম শিশু নির্যাতনের ছবি দেখেন। সার্বিকভাবে ফেইসবুকের সক্রিয় ব্যবহারকারীর মধ্যে পাঁচ শতাংশ অ্যাকাউন্ট ভুয়া। এই প্রথমবারের মতো, ঘৃণামূলক পোস্টের জন্য সরিয়ে দেওয়া পোস্টগুলো নিয়ে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চে ১০ লাখেরও বেশি আবেদন পড়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এই সময়ের মধ্যে নীতিমালা লঙ্ঘন করেনি এমন প্রায় দেড় লাখ পোস্ট ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ‘আমাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে এমন মানুষদের জন্য আরও জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতা তৈরিতে যে জায়গাগুলো নিয়ে আমরা আরও উন্মুক্ত হতে পারি’ প্রতিবেদনে সেই জায়গাগুলোতেই আলোকপাত করা হয়েছে বলে ভাষ্য ফেইসবুকের।

হোয়াটসঅ্যাপ, ফেইসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম তিনটি প্রতিষ্ঠানই ফেইসবুকের মালিকানাধীন। এই কম্পানির সিইও মার্ক জাকারবার্গ সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাধর। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিষ্ঠান তিনটি আলাদা হওয়া উচিত। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র সরকারও চাইছে ফেইসবুক ভেঙে তিনটি আলাদা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দুনিয়ায় একাই রাজত্ব করতে চায় ফেইসবুক। সম্প্রতি ফেইসবুকের মনোপলির বিষয়টি বেশ জোরেশোরে আলোচনায় এসেছে। বর্তমানে টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, স্ন্যাপচ্যাট, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ফেইসবুকসহ ছয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আছে। এতগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থাকার পরেও ফেইসবুকের মনোপলির কথা ওঠার কথা নয়। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে ফেইসবুকের প্রতিযোগিতা নীতি। ফেইসবুকের প্রতিযোগিতার নীতি হচ্ছে প্রতিযোগিকে কিনে নাও বা প্রতিযোগির ফিচারকে নকল করো। ফেইসবুকের বাইরে যে পাঁচটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নাম বলা হয়েছে, তার মধ্যে দুটি অর্থাৎ ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপকে এরই মধ্যে কিনে নিয়েছে ফেইসবুক। টুইটার থেকে হ্যাশট্যাগের ফিচারটি ধার করা হয়েছে। স্ন্যাপচ্যাট থেকে স্টোরিজ ফিচারটি চুরি করা হয়েছে এবং ইউটিউবকে টেক্কা দেওয়ার জন্য চালু করা হয়েছে ফেইসবুক ওয়াচ। এই পুরো বিষয়টি ফেইসবুকের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের একটি চেষ্টা। ফেইসবুকের আধিপত্য এতটাই ব্যাপক যে ২০১১ সালের পর থেকে আর কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স্টার্টআপ গড়ে ওঠেনি। এমনকি ব্যর্থতা মেনে নিয়ে ‘গুগল প্লাস’-এর মতো সেবাও বন্ধ করে দিতে হয়েছে খোদ গুগলকে।

এ রকম মনোপলি বা একচ্ছত্র আধিপত্যের একটি সমস্যা আছে। কোনো ব্যবসা মনোপলিতে রূপ নিলে সেখানে স্বেচ্ছাচার তৈরি হয়। নিয়ম-নীতির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঢিলেমি দেখা যায়। গোপনীয়তার বিষয়টি তারা আর গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না। মার্ক জাকারবার্গ তো কয়েক দিন আগে প্রাইভেসির বিষয়টি নিয়ে বেশ ঠাট্টা-মসকরাও করার চেষ্টা করলেন। করবেন নাই বা কেন। ৩০০ কোটি মানুষের তথ্য যে তাঁর হাতে। ফেইসবুকের সর্বেসর্বা তিনি। তিনি কারো কাছে জবাব দেন না। তিনি চাইলেই যেকোনো দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে পারেন। ফলাফল পরিবর্তনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন। মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতে পারেন। যা তিনি করছেনও। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির পর বিষয়টি আরো বেশি আলোচনায় এসেছে।

ফেইসবুক এখন মাইক্রোসফট ও গুগলের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। মাইক্রোসফট ও গুগল প্রতিষ্ঠান হিসেবে বড় হওয়ার পর বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠাতারা নিজেদের কর্তৃত্ব দেখানো বন্ধ করেন। ফেইসবুকও এমনটি করতে পারে। মার্ক জাকারবার্গ একা সব কয়টি কম্পানিকে সামাল দিতে পারছেন না বলে প্রমাণিত হয়েছে বহুবার। একেকটি শাখাকে একেকটি কার্যকর পরিষদের ওপর ছেড়ে দিতে পারেন মার্ক। প্রতিটি বিষয়ে নিজের নাক গলানোর অভ্যাসটি পরিহার করতে পারেন। এটি যেমন ফেইসবুকের জন্য মঙ্গল, তেমনি গ্রাহকদের জন্যও।

বলাই বাহুল্য, ফেইসবুক বর্তমানে সমাজের একটি মূল উপাদানে পরিণত হয়েছে। সামাজিক আচার-আচরণ, রাজনৈতিক পরিক্রমা, সব কিছুই ফেইসবুকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই প্রতিটি দেশের সরকারের উচিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা। কিভাবে এই মনোপলি ভেঙে নতুন উদ্ভাবনকে উৎসাহ দেওয়া যায়, সেই দিকটির দিকেও খেয়াল রাখা। ফেইসবুক যেন কোনো স্পর্শকাতর তথ্য কোনো স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা। ফেইসবুকে কোনো অ্যালগরিদম চালু করার আগে প্রতিটি দেশের সরকারকে সেটি সম্পর্কে অবহিত করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

আরও পড়ুন...