ওসি মোয়াজ্জেম লাপাত্তা?

গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর লাপাত্তা ওসি মোয়াজ্জেম

পিবিএ, ফেনী: গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন এখন কোথায় তা বলতে পারছেন না কেউ। সোনাগাজী থেকে গত ১০ এপ্রিল তাকে প্রত্যাহারের পর রংপুর রেঞ্জে বদলি করা হয়। গত ৮ মে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার পর গত সপ্তাহে তিনি রংপুর রেঞ্জ অফিসে যোগ দেন। দুই দিন আগেও তাকে রংপুরে দেখা গেছে। কিন্তু এখন তিনি কোথায় আছেন সেই তথ্য নেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে।

গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।

ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ডে আলোচিত ব্যক্তিদের অন্যতম সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ওই হত্যা মামলাটির তদন্ত সংস্থা পিবিআইয়ের তদন্তে নুসরাত’র জবানবন্দী ইন্টারনেটে ছড়ানোর ‘প্রমাণ’ পাওয়ায় পিবিআইয়ের দেয়া তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মাদ আস সামছ জগলুল হোসেন সোমবার মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করে।

আদালতের পরোয়ানা জারির এই আদেশ জারির আগ থেকেই ওসি মোয়াজ্জেম লাপাত্তা। এখন কোথায় তা বলতে পারছেন না কেউ। সোনাগাজী থেকে গত ১০ এপ্রিল তাকে প্রত্যাহারের পর রংপুর রেঞ্জে বদলি করা হয়।

গত ৮ মে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার পর গত সপ্তাহে তিনি রংপুর রেঞ্জ অফিসে যোগ দেন। দুই দিন আগেও তাকে রংপুরে দেখা গেছে। কিন্তু এখন তিনি কোথায় আছেন সেই তথ্য নেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে। জানা গেছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। তবে গ্রেফতারি পরোয়ানা হাতে পেলে তাকে গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে থানায় জেরা করেন সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। একইসঙ্গে তিনি সেই দৃশ্য নিজের মোবাইল ফোনে ধারণ করার পর ছড়িয়ে দেন। এ অভিযোগে ওসির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করার পর সেই মামলায় ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে, ওসির অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়া ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার কি তবে রেহাই পেয়ে যাবেন?

নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনা ভিডিওতে ধারণ এবং সেটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে এই মামলা সাইবার ট্রাইব্যুনালে এই মামলা করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন বাদী হয়ে গত ১৫ এপ্রিল সাইবার আদালতে এ মামলাটি দায়ের করেন। পরে বিচারক মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। পিবিআই’র সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রীমা সুলতানা তদন্ত শেষে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে সাইবার আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। এরপরই আদালত ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন।

রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি অফিসের স্টাফ অফিসার সহকারী পুলিশ সুপার শরিফুল ইসলাম জানান, ‘রংপুরে রেঞ্জে সংযুক্তির আদেশ দেয়ার পর কয়েকদিন আগে মোয়াজ্জেম হোসেন যোগদান করেছেন। এরপর তাকে ঢাকায় পুলিশ সদর দফতরে তলব করায় তিনি ঢাকায় গেছেন বলে শুনেছি। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ হওয়ার বিষয়টি শুনেছি। তবে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র আমরা হাতে পাইনি।’

রংপুর মহানগর পুলিশের মিডিয়া শাখার মুখপাত্র সহকারী পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন জানান, সোনাগাজীর সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করা সংক্রান্ত কাগজপত্র না পেলে তাদের কিছু করার নেই।

ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন কোথায় জানতে চাইলে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, ‘আট-দশ দিন আগে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন রংপুর রেঞ্জে যোগ দিয়েছেন। নুসরাতের ঘটনায় ঢাকায় গিয়েছেন শুনেছি।’ গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা জানি না। তবে আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা হাতে পেলে তাকে গ্রেফতারে পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন এখন কোথায় জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ শাখার এআইজি মো. সোহেল রানা জানান, কয়েকদিন আগে তিনি রংপুর রেঞ্জে যোগ দিয়েছেন। সেখানেই তার থাকার কথা।

সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা যৌন নিপীড়ন করে বলে অভিযোগ ওঠে। নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে ২৭ মার্চ এ ব্যাপারে সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে নুসরাতের পরিবারকে হুমকি দেয়া হচ্ছিল। গত ৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথমপত্রের পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে যান নুসরাত। এ সময় তাকে কৌশলে মাদরাসাটির সাইক্লোন শেল্টার ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে যায় সিরাজ উদ দৌলার সহযোগী দুর্বৃত্তরা। সেখানে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়া হয়। গুরুতর দগ্ধ নুসরাত পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ১০ এপ্রিল মারা যান।

এদিকে নুসরাত জাহান রাফির আনা যৌন হয়রানির অভিযোগ ভিডিওতে ধারণ এবং তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয়। নুসরাত হত্যাকা-কে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন তিনি।

নুসরাত হত্যার ঘটনায় গাফিলতি খতিয়ে দেখতে ১৩ মে পুলিশ সদর দফতর ডিআইজি রুহুল আমিনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। গত ৩০ এপ্রিল রাতে কমিটি সদর দফতরে প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে বলা হয়, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনের সঙ্গে মিলে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালানোর সব ধরনের চেষ্টা করেন। বিষয়টি মিডিয়ায় আসার কারণে অপচেষ্টা সফল হয়নি। প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টার অংশ হিসেবেই ঘটনা বিকৃত করে ওসি মোয়াজ্জেমের পক্ষে পুলিশ সদর দফতরে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন এসপি জাহাঙ্গীর আলম। এ কারণে এসপি জাহাঙ্গীর আলমকে বদলি এবং সোনাগাজীর তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন ও এসআই ইকবাল হোসেনকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

একই অপরাধে রেহাই পাচ্ছেন এসপি?

মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে থানায় জেরা করে সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন সেই দৃশ্য নিজের মোবাইল ফোনে ধারণ করার পর ছড়িয়ে দেন। এ অভিযোগে ওসির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়েরের পর সোমবার (২৭ মে) সেই মামলায় ওসির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। প্রশ্ন উঠেছে, ওসির অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়া ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার কি তবে রেহাই পেয়ে যাবেন?

নুসরাতের শরীরে আগুন দেয়ার ঘটনা নিয়ে ফেনীর এসপি জাহাঙ্গীর আলম গত ১১ এপ্রিল পুলিশের সদর দফতরকে একটি প্রতিবেদন দেন। ওই প্রতিবেদনে তিনি দাবি করেন, ‘নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় মামলা করতে পরিবার কালক্ষেপণ করেছে।’ পরবর্তী সময়ে ঘটনা তদন্তে পুলিশ সদর দফতরের গঠিত তদন্ত কমিটি ফেনীর পুলিশ সুপার ও সোনাগাজী থানার ওসির বিরুদ্ধে গাফিলতির প্রমাণ পায় এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে। এরপর জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে ফেনীর পুলিশ সুপারের দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকায় পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়।

প্রত্যাহার কোনও অপরাধের শাস্তি না উল্লেখ করে মানবাধিকারকর্মী, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নুর খান গতকাল মঙ্গলবার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই জায়গায় আইনের বড় ধরনের ব্যত্যয় লক্ষ করা যায়। ক্যাডার সার্ভিসভুক্ত হলে যেকোনও ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। যেহেতু এই এসপিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে তার বিরুদ্ধে আইনবহির্ভূত কার্যক্রমের সত্যতা মিলেছে ধরে নেয়া যায়।’ তিনি বলেন, ‘একজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও অন্যজনের বিষয়ে এখনও কিছু জানা যায়নি। একই ধরনের অপরাধ করে দুই রকমের পদক্ষেপ কেন হবে। সেই এসপির বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, না হয়নি সেটি স্পষ্ট করে বলতে হবে। যদি না হয়ে থাকে তাহলে বিনা কারণে কাউকে হয়রানি করা হোক, সেটি আমরা চাই না। তেমনই কেউ নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে নিয়ে যাক, সেটিও কাম্য নয়। এতে আইনের প্রতি সাধারণ মানুষের সম্মান কমে আসবে।’

নুর খান আরও বলেন, ‘প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তাদের আইনের বাইরে রাখার সুযোগ নেই। সেই সুযোগ করে দিলে এ ধরনের অপরাধ সংঘটন থেকে নিবৃত্ত করা যাবে না, এটি ক্রমান্বয়ে বাড়বে। ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংশ্লিষ্টতার কথা এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দলগুলো কী ব্যবস্থা নিলো, সেটিও মনিটরিং করা দরকার।’

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই’র প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘এসপির বিষয়টি সদর দফতর বলতে পারবে। আমরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলাম, সেটির বিষয়ে কাজ করছি।’

গাফিলতির অভিযোগ ওঠায় সোনাগাজীর তৎকালীন এসপির বিরুদ্ধে কোনও আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা প্রশ্নে পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক সোহেল রানা জানান, তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশ সুপারের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পুলিশ) নুরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আইন শাখা জানাতে পারবে। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (আনসার ও সীমান্ত) মো. সাহেদ আলীর (আইন অধি-শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত) কাছে জানতে চাওয়া হয়, পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা ‘জবাবে তিনি বলেন, ‘এমন কোনও ফাইল আমার কাছে এসে পৌঁছায়নি।’

ফেনীর সাবেক এসপি জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য জানতে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আপনারা পুলিশ সদর দফতরে যোগাযোগ করুন, যা বলার তারাই বলবে। এ বিষয়ে আমি কোনও মন্তব্য করবো না।’

পিবিএ/এএইচ

আরও পড়ুন...