কোরআন অধ্যয়ন ও প্রচারের গুরুত্ব [চার]

আল কোরআন: সৌভাগ্যের পরশ পাথর

মুহাম্মদ আবুল হুসাইন

আল্লাহর কালাম থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্য কিছু বিভ্রান্ত অথচ লেবাসধারী লোক আল কোরআন সম্পর্কে মানুষকে অহেতুক আতংকিত করে তুলছে। তারা একে অত্যন্ত জটিল অস্পৃশ্য গ্রন্থ বলে বর্ণনা করে এ গ্রন্থের অর্থ জানা থেকে লোকদেরকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। যেমনটি করতো কুরাইশ মুশরিকেরা। তারা কোরআন সম্পর্কে নানা অপপ্রচার করে বেড়াতো যাতে লোকেরা কোরআন না শোনে। কারণ কোরআন শুনলেই লোকেরা কোরআনের কথায় আকৃষ্ট হতো। এক সময় খ্রিস্টান পাদ্রী-পুরোহিত ধর্মগ্রন্থ পাঠ থেকে লোকদেরকে বিরত রাখতো। হিন্দু-ব্রাহ্মণগণও এ কাজটি করতো। তারা বাংলা ভাষায় ধর্মীয় গ্রন্থের অনুবাদকে নিষিদ্ধ করেছিলো। যারা মাতৃভাষায় ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করার চেষ্টা করতো তাদেরকে রৌরব নরকের ভয় দেখানো হত। এ সবেরই উদ্দেশ্য ছিল ঐশী আদর্শের পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া মতকে প্রাধান্য দেয়া। আল্লাহর কথার চেয়ে নিজেদের কথাকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই কোরআনের কথাকে অত্যন্ত কঠিন, জটিল ও বোধগম্যহীন বলে বর্ণনা করে এর অর্থ জানা থেকে লোকদেরকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ আল কোরআন হচ্ছে বিশ্বের সকল মানুষের জন্যই আল্লাহ প্রদত্ত এক সুস্পষ্ট হেদায়াত বা পথ-নির্দেশ। আল্লাহ বলেন :

‘নিঃসন্দেহে এ কোরআন এমন পথ প্রদর্শন করে, যা একেবারেই সহজ-সরল।’-[বনি ইসরাইল : ৯]

এসব বৈরী প্রচারণা এবং জ্ঞানার্জনের প্রতি নিস্পৃহতার কারণে আমাদের সমাজে কোরআনের শিক্ষা জানার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখা যায় না, কোরআন পড়া হয় শুধু তেলাওয়াতের উদ্দেশ্যে।

অথচ যে কোন গ্রন্থ পড়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে জানা। আমরা যদি কোন গ্রন্থের শিক্ষাকে নিজেদের জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করি তাহলে সে গ্রন্থের শিক্ষা জানার জন্যই আমরা তা পড়ে থাকি। গ্রন্থটি যদি এমন ভাষায় লিখিত হয়, যা আমরা জানি না, তাহলে আমরা গ্রন্থটির শিক্ষাকে অত্যন্ত জরুরী মনে করার কারণেই তার অনুবাদ জানার চেষ্টা করি। কারণ অর্থ না জানলে গ্রন্থাকার কী বলতে চান তা আমরা কীভাবে বুঝব? আর কোন একটি বই পড়ে তা থেকে কোন কিছু জানতে ও বুঝতে যদি আমরা নাই পারি তাহলে সে গ্রন্থ পড়াকে আমরা অর্থহীন বলে থাকি। কোন সুস্থ ব্যক্তিই নিশ্চয়ই এমন আচরণ করেন না। অর্থাৎ কেউ যদি নিয়মিতভাবে এমন একটি বই পড়ে যে বইটির ভাষা সে জানে না, গ্রন্থটি সে খুবই শুদ্ধ করে পড়তে পারে কিন্তু তার অর্থ কিছুই জানে না এবং জানার চেষ্টাও করে না অথচ সেই ব্যক্তি দাবী করে যে সে ঐ গ্রন্থের লেখককে খুবই ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে আর একই ভাবে তার গ্রন্থটিকেও সে তার জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে; তাহলে ঐ ব্যক্তির কথা যে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তাও নিশ্চয়ই আমরা চিন্তা করে দেখতে চাইব।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল কোরআনের সাথে আমরা প্রতিনিয়ত উদ্ভট ও হাস্যকর আচরণ করে যাচ্ছি। আরবদের কাছে আল কোরআন তো কোন দুর্বোদ্ধ গ্রন্থ ছিল না। তারা তো কোরআন তেলাওয়াত করে এর অর্থ সহজেই বুঝতে পারতেন। যার কারণে আল্লাহর রাসূল তাদেরকে বেশি বেশি করে কোরআন তেলাওয়াতের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং এর জন্য অশেষ সওয়াব প্রাপ্তির কথা বলেছেন। কারণ, বেশি বেশি করে কোরআন তেলাওয়াত করার কারণে কোরআনের শিক্ষা তাদের হৃদয়পটে গাঁথা হয়ে যেত। আর ইসলামী জিন্দেগী যাপনের জন্য এর অপরিহার্য প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু আমরা যারা আরবি ভাষা জানি না তারা যদি কোরআনের অর্থ জানার চেষ্টা না করে শুধু তেলাওয়াত করি তাহলে আমাদের কোরআন পড়ার হক কতটুকু আদায় হবে তা কি ভেবে দেখা উচিত নয়? আল্লাহ আমাদেরকে কোরআন পড়ার যে নির্দেশ দিয়েছেন তা কি কোরআনের শিক্ষাকে জানা ও বুঝার জন্য নয়? আমরা যদি কোরআনের শিক্ষাকে না জানি তাহলে কোরআন থেকে হেদায়াত নেয়া আমাদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব হবে?

পবিত্র কোরআনের শিক্ষাকে জানা ও বুঝার কারণে দ্বীনের যে ধরনের বুঝ, যে ধরনের ঈমান ও উপলব্ধি তৈরি হওয়া সম্ভব তা কি অর্থ না জেনে তেলাওয়াতের মাধ্যমে, আল্লাহর বড়ত্ব ও মাহাত্ম সম্পর্কে বেখবর থাকার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব? মোটেই সম্ভব নয়। কারণ স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনই এ প্রসঙ্গে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে, জ্ঞানী আর মূর্খের উপলব্ধি সমান নয়। আর জ্ঞানীরাই আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে, তারাই হেদায়াত থেকে বেশি উপকৃত হয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন :

‘এটা কি করে সম্ভব হতে পারে যে, যে ব্যক্তি তোমার আল্লাহর এই কিতাবকে, যা তিনি তোমার প্রতি নাযিল করেছেন, সত্য বলে জানে আর যে ব্যক্তি এ মহাসত্য সম্পর্কে অজ্ঞ-অন্ধ তারা দুজনই সমান হতে পারে? উপদেশ তো বুদ্ধিমান লোকেরাই কবুল করে থাকে।’ -[রা’দ : ২০]

সুবহানাল্লাহ! কী দুর্ভাগ্য আমাদের! আল কোরআনের এমন সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও আজ আমরা উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করেছি! আল্লাহর কথার চেয়ে আজ আমরা তথাকথিত মুরুব্বিদের কথাকেই যেন বেশি প্রাধান্য দিয়ে চলেছি। আল্লাহ বলছেন জানো, জানতে চেষ্টা কর! আর মুরুব্বি/বুযুর্গ রূপী আযাযিল ওয়াসওয়াসা দিয়ে বলছে খবরদার, কোরআনের অর্থ জানার চেষ্টা ক’রো না, শুধু তেলাওয়াত কর, শুধু তেলাওয়াত…!

কিন্তু কোরআন যিনি পাঠিয়েছেন সেই পরওয়ার দিগার এ সম্পর্কে কী বলছেন :

‘এ কিতাব আমি অবতীর্ণ করেছি, এটি বরকতপূর্ণ। এতএব তোমরা এর অনুসরণ কর এবং নিষিদ্ধ সীমা পরিহার করে চল। তবেই তোমরা রহমত প্রাপ্ত হবে।’-[আল আনআম : ১৫৫]

‘(হে নবী!) এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যেন বুদ্ধিমান লোকেরা একে গভীর ভাবে অধ্যয়ন ও চিন্তা-ভাবনা করে।’ -[আস সোয়াদ : ২৯]

‘তোমাদের কিছু লোক নিরক্ষর। তারা মিথ্যা আকাক্সক্ষা ছাড়া আল্লাহর কিতাবের কিছুই জানে না। তাদের কাছে কল্পনা ছাড়া কিছু নেই।’ -[আল বাকারা : ৭৮]

‘আমি তোমার প্রতি আমার জিকির (আল কোরআন) অবতীর্ণ করেছি, যাতে লোকদের সামনে ঐসব বিষয় বর্ণনা করতে পারো, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে। যেন তারা চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।’

আল্লাহ আমাদের মাফ করুন। আমরা প্রতিদিন, প্রতি ওয়াক্তে অত্যন্ত তাযিমের সাথে কোরআন তেলাওয়াত করি কিন্তু ভুলে একবারও আমাদের জানতে ইচ্ছে করে না এই পবিত্র বাণী গুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন কী বলেছেন। আর ঠিক এ কারণেই নিরক্ষর লোকদের মতই আমরা আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে আন্দাজ-অনুমান, ধারণা-কল্পনা নির্ভর আকিদা-বিশ্বাস লালন করছি আর মিথ্যা আকাক্সক্ষার আশ্রয় নিয়ে অজ্ঞতা ও মূর্খতার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি। মানসিক এই বৈকল্যের কারণেই আজ আমাদের চিন্তা-চেতনাও হয়ে গেছে পঙ্গু ও নিষ্প্রাণ। এ কারণেই আমাদের ঈমান আজ চেতনাহীন।

অথচ আল্লাহ বলেছেন:

‘আমি যদি এই কোরআনকে কোন পাহাড়ের উপরও নাযিল করতাম, তাহলেও তুমি দেখতে যে, সে পাহাড় আল্লাহর ভয়ে কেমন বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে! এই দৃষ্টান্ত গুলো আমি এ জন্য দেই, যেন লোকেরা নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে।’-[আল হাশর : ২১]

পিবিএ/এএইচ

আরও পড়ুন...