খুলনায় ঈদ উৎসবের আয়োজন নেই কৃষকের ঘরে

শেখ হারুন অর রশিদ, পিবিএ, খুলনা: খুলনার কয়রা উপজেলার মসজিদকুড় গ্রামের কৃষক সদর উদ্দীন সানা এবার বোরো মৌসুমে তার ৮ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। কয়েকদিন আগে সে ধান কেটে ঘরে তুলেছেন। কিন্তু উৎপাদন খরচের সঙ্গে ধানের দামের বিস্তর ফারাক ভেবে ধান বিক্রি করছেন না তিনি। এ কারনে ধানের উপর নির্ভরসীল কৃষক সদর উদ্দীনের ঘরে ঈদ উৎসবের কোন আয়োজনই নেই এবার।

তিনি জানান, প্রতি বিঘা জমির ধান কেটে ঘরে তোলা পর্যন্ত তার খরচ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার টাকার মত। প্রচন্ড খরায় প্রয়োজনীয় সেচের অভাবে বিঘা প্রতি ধান হয়েছে সাড়ে ১২ মণ। এলাকার বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ি প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৭২০ টাকা দরে। এই দামে বিক্রি করলে তার প্রতি বিঘা জমির ধানে লোকসান হয় ৩ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘মহাজনের ধারের টাকা শোধ করবো কিভাবে এ চিন্তা সারাক্ষন মাথায় ঘুরপাক খায়। সেখানে ঈদ উৎসবের কথা মাথায় আসেনা।’

একই এলাকার কৃষক জুলফিকার আলী জানান, তার পৌণে চার বিঘা জমিতে ফলন তুলনামূলক ভালই হয়েছে। তবে কৃষি শ্রমিকের খরচ ও সেচ খরচ বেশি হওয়ায় এবার ধান বিক্রি করে তার আসল টাকা বাঁচবে না।
কৃষক সদর উদ্দীন ও জুলফিকার আলীর মত খুলনার ৯টি উপজেলার অন্তত ৪৫ হাজার কৃষক পরিবারের একই অবস্থা। প্রত্যেকের বাড়ির খামারে ধান উঠেছে বটে। তবে কারো চোখে মুখে প্রশান্তির ছায়া নেই। কৃষকদের দুশ্চিন্তা উৎপাদন খরচ উঠানো নিয়ে। শ্রমিক খরচ বাঁচাতে অনেক কৃষক নিজের পরিবারের লোকজন দিয়ে ধান কাটিয়েছেন। তবুও লোকসানের শঙ্কা কাটছে না কারো। চারিদিকে ঈদ উৎসবের অগ্রীম
আয়োজন লক্ষ্য করা গেলেও এসব পরিবারের সদস্যদের চোখে মুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট।

খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রাসরণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ি, এ মৌসুমে খুলনায় ধান উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৯৮৭ মেট্রিক টন। অথচ এখানে সরকারিভাবে মাত্র ১ হাজার ৯১৩ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অপরদিকে চাল সংগ্রহ করা হবে ১৬ হাজার ৩৪৩ মেট্রিক টন।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, সরকার যখন ন্যায্য মূল্যে ধান ক্রয় বাড়িয়ে দিবে তখন কৃষকের হাতে ধান থাকবে না। মহাজনদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করতে হবে। আর সরকারের দেয়া কৃষকের সুবিধা ভোগ করবে মহাজন। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ি প্রতি কেজি ধানের দাম ২৬ টাকা নির্ধরণ করা হয়েছে। আর প্রতি কেজি চাল কেনা হবে ৩৬ টাকা দরে। অবশ্য চাল মিল মালিকদের কাছ থেকে নেয়া হবে। এখানেই অসাধু চক্রের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ কৃষক নেতাদের। তাছাড়া উৎপাদনের সামান্য অংশই ক্রয় করছে সরকার। ফলে লোকসানের হাত থেকে কৃষককে রেহাই দেয়া সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য খুলনার ফুলতলা মহিলা কলেজের প্রভাষক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কৃষকের কাছ থেকে প্রতি মণ ধান এক হাজার ৪০ টাকায় ক্রয় করলেও তাদের লোকসান ঘুচবে না। তাছাড়া কৃষকের উৎপাদিত অতি সামান্য অংশই কিনছে সরকার। তাও কতজন প্রান্তিক কৃষক এ সুবিধা পাবে সেটা নিয়েও শঙ্কা রয়ে যায়। ফলে এবার কৃষক পরিবারে কোন উৎসব দুরের কথা হতাশায় দিন কাটবে
তাদের।

গত ২১ মে দুপুরে জেলার ফুলতলা উপজেলায় সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে বোরো ধান সংগ্রহ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন।
সে সময় তিনি জানান, একজন কৃষক সর্বনিম্ন ১২০ কেজি ও সর্বোচ্চ তিন মেট্রিক টন ধান বিক্রি করতে পারবেন। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি উপজেলায় কৃষকের কাছ থেকে এভাবে বোরো ধান সংগ্রহ
করবে উপজেলা খাদ্য বিভাগ।

স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, সরকারিভাবে ধান কিনতে কৃষকদের দীর্ঘ তালিকা বাছাই শেষে যে নাম প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে সাধারণ কৃষকদের নাম নেই। বেশিরভাগই দলীয় সুবিধাভোগীরা তালিকায় স্থান পেয়েছে।

জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার মিকসিমিল গ্রামের কৃষক আঃ রশিদ বলেন, ‘নায্য দাম পাওয়ার আশায় আমরা ধান কেটে অপেক্ষায় আছি। কৃষি অফিসের লোক এসে নাম লিখে নিয়াও গেছে। কিন্তু পরে শুনি তালিকায়
আমার নেই। বাছাইতে বাদ পড়েছি। সামনে ঈদ, ধান বেচতি না পারলি কি হবেনে তা ভাবতিই কষ্ট লাগে।’

এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ধান কাটা শেষে কৃষকরা নিজেদের খামারে ধান মজুদ করে রেখেছেন। সরকারিভাবে নায্য দামে ধান বিক্রির আশায় দিন গুনছেন তারা। অনেকেই ঈদে সন্তান ও পরিবারের চাহিদা মেটাতে কম
দামে ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন। স্থানীয় বাজার অনুযায়ি বর্তমানে প্রতি বস্তা (৬০ কেজি) ধান বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪০ টাকায়। লোকসান জেনেও অনেক কৃষক বাজারে মধ্যস্বত্তভোগী ফোড়িয়াদের কাছে বাধ্য হয়ে ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন। আবার অনেকেই দামের আশায় দিন গুনছেন।

খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ পরিচালক কৃষিবীদ পঙ্কজ কান্তি মজুমদার বলেন, ধানের নায্য মূল্য পাচ্ছেন না কৃষক এটা ঠিক। এ জন্য কৃষকের কাছ থেকে সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের জন্য তালিকা করা হচ্ছে। যদিও স্থানীয় কৃষকের সংখ্যা অনুযায়ি তা অনেক কম। তবুও কৃষকরা যাতে নায্য মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারেন সে জন্য স্থানীয় বাজারগুলোতে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। যাতে মধ্যস্বত্তভোগীরা
কারসাজি করে কৃষককে ঠকাতে না পারে।

পিবিএ/এসএইচঅআর/জেডআই

আরও পড়ুন...