‘কদর’ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ মর্যাদা ও মাহাত্মা। এখানে বলা প্রয়োজন, কেন এই রাতটিকে ‘শবে কদর’ বা কদরের রাত বলা হয়। আদতে একজন বান্দা জীবন সাহারায় বিশাল পথ অতিক্রম করেছে। আল্লাহর দেয়া অগণিত নিয়ামত ভোগ করেছে। পাপের কলঙ্কে মুছে গিয়েছে তার প্রকৃত অস্তিত্ব। তার জীবন সংসারের কোথাও মানবতার কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। মানুষ হিসেবে শির উচিয়ে দাঁড়াতে পারছে না। সে আজ বড় অসহায়। হতমান লাঞ্চিত এই অভাগার জীবনেও যদি একটি ‘লাইলাতুল-কদর’ এসে দাঁড়ায়, যদি একটি শবে কদরের আহ্বানও ধ্বলিত হয় তার জিন্দেগীতে, ওই বান্দা যদি অতীতের কৃত সকল পাপে অনুশোচনায় বিগলিত মন নিয়ে ইবাদত করতে পারে। সকল অপরাধ বর্জনের বলিষ্ঠ শপথে প্রত্যয়ী হতে পারে। আগামী জীবনে আর ঘুনাক্ষরেও পাপ না করার সংকল্পে বদ্ধ পরিকর ও অনুতপ্ত হয়ে মন থেকে তওবা করতে পারে, যদি নিখাদ ইবাদত সাধনায় এমন একটি মহিমান্বিত রজনী কাটাতে পারে তাহলেই তার এই আঁধার জীবন এক মহিমান্বিত জীবনে বদলে যাবে। আর এভাবেই শবে কদর সম্মান ও মর্যাদার রাত।
একটি অসহায় ও অবহেলিত জীবনে এনে দেয় চিরন্তন মর্যাদার প্রবাহ। সেখানে থাকে না তখন আর অপরাধের বিন্দু চিহ্ন। তখন আর বুঝতে কষ্ট হয় না। সত্যিই শবে কদর মহিমান্বিত জীবনের আশ্বাস সম্বলিত জীবনের পয়গাম।
শবে কদর ওই মহিমান্বিত রাত, যে রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। এই রাতকে পুরো মাসব্যাপী তালাশ করতে হুকুম করা হয়েছে। আর শেষ দশ বেজোড় রাতে তালাশের বিশেষ হুকুম করা হয়েছে। যদি এই রাত সমূহ জাগরণ সম্ভব না হয় তাহলে ২৭ এর রাত্রে তুলনামূলক অধিক ইবাদত করবে। শবে কদরের ছাওয়াব হাসিলের জন্য নূর ইত্যাদি দেখা আবশ্যক নয়
সকলকেই রমজানের প্রতি রাত্রে অধিক পরিমাণ ইবাদত করা উচিত এবং প্রত্যেক রাতকে শবে ক্বদর মনে করা উচিত। আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনুল করীমে ঘোষণা করেন যে, সে রাত্রে ফেরেস্তারা ও রুহ্ (হযরত জিব্রাইল আঃ) তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করেন। শান্তিময় সেই রাত ফজরের সূচনা পর্যন্ত।
(সূরা ক্বদর আয়াত: ৪-৫) ইবনে হুবাইশ (রাঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, আমি উবাই ইবনে ক্বা’আবকে বলতে শুনেছি। আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন- ‘যে ব্যক্তি সারা বছর রাত জাগ্রত থাকবে, সে লাইলাতুল কদর লাভ করবে’। উবাই বলেন- ‘আল্লাহর শপথ করে বলছি, যিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, সন্দেহ নেই লাইলাতুল কদর রমজানে’। তিনি নির্দিষ্টভাবে কসম করে বলেন- ‘আল্লাহর শপথ আমি জানি তা কোন রাত, এটা সে রাত, যার ক্বিয়ামের নির্দেশ আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) প্রদান করেছেন, তা হচ্ছে সাতাশের সকালের রাত, তার আলামত হচ্ছে সেদিন সকালে সূর্য উদিত হবে সাদা, তার কোনো কিরণ থাকবে না’। (মুসলিম শরীফ)
ইবনে হিব্বানের এক বর্ণনায় আছে- ‘তার আলামত হচ্ছে সেদিন সকালে সূর্য ঊদিত হবে সাদা, তার কোনো কিরণ থাকবে না, যেন তার আলো মুছে দেয়া হয়েছে। (মুসলিম-৭৬২ ইবন হিব্বান-৩৬৯০)
হযরত ইবনে আব্বাছ (রাঃ) বলেন- ‘আমি সূর্যের দিকে তাকিয়ে সেরূপ দেখেছি, যেরূপ নবীয়ে করীম (সঃ) বলেছেন। (আহমদ:১/৪০৬ ইবনে আবি শায়বাহ্ ২/২৫০)
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবীয়ে করীম (সঃ) বলেছেন- ‘লাইলাতুল ক্বদর হচ্ছে সাতাশ অথবা ঊনত্রিশের রাত। সে রাতে কঙ্করের চেয়ে অধিক সংখ্যায় ফেরেস্তারা পৃথিবীতে অবস্থান করিবেন’। (আহমদ: ২/৫১৯)
উবাদা ইবনে সামেত (রাঃ) থেকে বর্ণিত: নবীয়ে করীম (সঃ) বলেন- ‘নিশ্চয়ই লাইলাতুল ক্বদরের আলামত, তা হবে সাদা ও উজ্জ্বল, যেন তাতে আলোকিত চাঁদ রয়েছে, সে রাত হবে স্থির, তাতে ঠাণ্ডা বা গরম থাকবে না, তাতে সকাল পর্যন্ত কোনো তারকা দ্বারা ঢিল ছোঁড়া হবে না। তিনি ইঙ্গিত দেন, ‘সেদিন সকালে সূর্য উদিত হবে সমানভাবে, চৌদ্দ তারিখের চাঁদের ন্যায়, তার কোনো কিরণ থাকবে না, সেদিন শয়তানের পক্ষে এ রাতে বের হওা সম্ভব নয়।’ (আহমদ: ৫/৩২৪)
জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবীয়ে করীম (সঃ) বলেন- ‘আমাকে লাইলাতুল ক্বদর দেখানো হয়েছিল, অতঃপর তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে, আর তা হচ্ছে শেষ দশকে। সে রাত হবে সাদা উজ্জ্বল, না গরম, না ঠাণ্ডা, যেন আলোকিত চাঁদ নক্ষত্রগুলোকে আড়াল করে আছে, ফজর উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সে রাতের শয়তান বের হতে পারে না।’ (ইবন খুযাইমাহ-২১৯০, ইবন হিব্বা-৩৬৮৮)।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত: নবীয়ে করীম (সঃ) বলেন- লাইলাতুল ক্বদর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দেন।‘লাইলাতুল কদর সাদা-উজ্জ্বল, না গরম না ঠাণ্ডা, সে দিন ভোরে সূর্য উদিত হবে দুর্বল রক্তিম আভা নিয়ে।’ (ইবন খুযাইমাহ-২১৯২)।
আমাদের প্রত্যেক মুসলিমের উচিত যে, আজকের মহান পূণ্যময় রজনী লাইলাতুল ক্বদরকে যথাযথভাবে তালাশ করা। আল্লাহ পাক আমাদিগকে পবিত্র লাইলাতুল কদরের রাত্রিতে পূর্ণাঙ্গ ইবাদত করার তাওফিক দান করেন। আমীন! ছোম্মা আমীন!